ডা. লুৎফর রহমানের গল্প ‘মহৎ প্রাণ'

পুনর্মুদ্রণ

প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২৫

বড় বাজারে এক তাঁতির একখানা দোকান ছিল। একদিন দোকানে বেচাকেনা করার সময় জরুরি কাজে করিম বখশ বলে এক-ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেলেন। করিম বখশ এক ঘণ্টা দোকানে বসে থাকল। কিন্তু তবুও দোকানদার ফিরে এলো না। এদিকে ক্রেতারা জিনিসপত্রের জন্য তাগাদা করতে লাগল। করিম বখশের জিনিসপত্রের দাম জানা ছিল। সে কয়েকখানা কাপড় বিক্রয় করল। দুঃখের বিষয়, সারাদিন চলে গেল, তবুও দোকানদার ফিরে এলো না। করিম অগত্যা সেদিন আর বাড়ি যেতে পারল না, দোকানদারের অপেক্ষায় সেখানেই রাত্রি যাপন করল। পরের দিন যথাসময়ে দোকান খুলে করিম মালিকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু মালিকের আর সন্ধান নেই। করিম অগত্যা নিজেই বেচাকেনা করতে লাগল।

এইভাবে দু`তিন দিন শেষে এক মাস কেটে গেল, তাঁতি ফিরল না। করিম দোকানের ভার ফেলে যাওয়া অধর্ম মনে করে বিশ্বস্ত ভূত্যের মতো কাজ চালাতে লাগল। তাঁতি যাদের কাছে ঋণী ছিল, করিম তাদের সব টাকা পরিশোধ করল। তাঁতির হয়েই সে নতুন কাপড়ের চালান এনে দোকানের আয় ঠিক রাখল।

এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। করিমের আন্তরিক চেষ্টায় দোকানের ক্রমেই উন্নতি হচ্ছিল। শেষে এক দোকানের পরিবর্তে তিনটি দোকান স্থাপিত হলো। করিম সব দোকানই তাঁতির নামে চালাতে লাগল। লোকে ভাবল, করিম তাঁতির দোকান কিনে নিয়েছে। করিমের সম্মান-প্রতিপত্তি ইত্যবসরে খুব বেড়ে গেল, সে মস্ত সদাগর হয়ে বিরাট কারবার চালাতে লাগল।

প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। একদিন করিম দোকানের গদিতে বসে আছে, এমন সময় সে দেখল, একটা বুড়ো লোক লাঠিতে ভর করে তারই দোকানের সামনে করিম বলে একটা বালকের খোঁজ করছে। বুড়োর পরনে একখানা ময়লা কাপড়, রৌগা চেহারা। শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েছে। তাকে পথের ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল। করিম দৌড়ে এসে বুড়োকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বলল, আমি হচ্ছি সেই করিম, এই সাত বছর আমি আপনার দোকান পাহারা দিচ্ছি, দয়া করে এখন আপনি আপনার দোকানের ভার নিন।

বৃদ্ধ করিমের মহৎ প্রাণের পরিচয় পেয়ে দুই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন। বললেন, করিম, আমার আর কিছুই দরকার নেই, এ সবই তোর। আমার এ সংসারে যারা আপন ছিল, সবাই ছেড়ে গিয়েছে, এখন তুই আমার আপন। যেই সাত বছর আগেকার কথা, এখান থেকে বেরিয়ে পথে সংবাদ পেলাম, আমার পত্নীর সাংঘাতিক পীড়া, কালবিলম্ব না করে আমাকে বাড়ি যেতে হয়েছিল। বাড়ি গিয়ে দেখলাম পত্নীর মৃত্যু হয়েছে।

পত্নীর মৃত্যুর কয়েক দিন পরে ছেলে দুটিও মারা গেল। তারপর আমি নানা দুর্বিপাকে পড়ি। কিছুতেই বাড়ি ছাড়তে পারলাম না। তারপর এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে; এখন আমার কেউ নেই। অত্মীয়স্বজন, অর্থ, দেহের বল সব হারিয়ে এখন আমি পথের ফকির হয়েছি। অতি দুঃখে অনেক আশা-নিরাশায় মনে হলো, কলিকাতায় গিয়ে একবার করিমের সন্ধান করি। তাকে যদি পাই, তার কাছ থেকে দু`এক টাকা ভিক্ষা নেব। দোকান কি আর এতদিন আছে? করিম, আমি যে তোকে এমন রাজার হালে দেখব, এ কখনও মনে করিনি। আর, তুই যে এমন করে আমার কাছে পরিচয় দিলি, এ ভেবে আমার মনে যে আনন্দ হচ্ছে, তা আর কি বলব? বল্ বাবা, তুই মানুষ, না ফেরেশতা।

করিম সবিস্ময়ে বলল, আপনি পিতার মতো আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। সে বিশ্বাসকে আমি রক্ষা করতে পেরেছি, এই আমার পক্ষে ঢের। এর বেশি আমি কিছু আশা করি না।

তাঁতি করিমের হাত থেকে দোকানের ভার গ্রহণ করলেন না। জীবনে তার আর কোনো বন্ধন রইল না। একটা মাসিক বন্দোবস্ত করে তিনি অতঃপর তীর্থে চলে গেলেন।

মানুষের জীবন যে এত সুন্দর, এত পবিত্র হয়, তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই পাপময় মানব সমাজে মহৎপ্রাণ মানুষ আছে, মানুষ তাদের নাম জানুক আর না জানুক, এরা যে জগৎকে ধন্য করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।