তৃষ্ণাকুমারী (১)

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০১৬

ফুল তুলছে মালিনী।
ভোর হচ্ছে। রোদের নরম রঙ আস্তে-ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে বাগানে। হাওয়া বইছে। কাঁপছে পাতা। কাঁপছে ফুল। লাল নীল হলুদ আর নানা রঙের ফুল নরম রোদের রঙ মেখে নিয়ে ঝলসে দিচ্ছে সোনালি ভোর। হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে সেই ফুলের গন্ধ। এ গন্ধ পৌঁছে যাচ্ছে রাজবাড়ির প্রতিটা কক্ষে। কেননা খুব ভোরেই কক্ষের জানলাগুলো খুলে দেয় দাসী। রাজার এ রকমই আদেশ। ভোরের প্রথম আলোয় ঘুম ভাঙে তার। তারপর রানিকে সঙ্গে নিয়ে বাগান ঘুরতে বের হন। প্রতিদিন একই নিয়ম।
প্রাচীর ঘেঁষা গাছপালার ওপর ঘুমভাঙা পাখিরা খুব ডাকছে। উড়ে উড়ে এডাল থেকে ওডালে ছুটছে। আনন্দ লেগে গেছে চারদিক, যেন ভোরের উৎসব।
আর সবই শান্ত। পাতার আড়ালে এক একটা ফুল অহংকারীর মতো ফুটে রয়েছে। মালিনী সেই অহংকার ভেঙে দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে তাদের আর রেখে দিচ্ছে হাতের ডালিতে। ডালি প্রায় ভরে এসেছে। ফিরে যাবে ভাবছে এমন সময় চোখ পড়ল পুকুরঘাটে। রাজা আর রানি হাঁটছেন পাশাপাশি। ডালি হাতে বাগান থেকে বেরিয়ে এলো মালিনী। দাঁড়ালো এসে রাজা আর রানির সামনে। মাথা নোয়ালো একটু।
বাগানের শ্রী তো আগের মতো আর দেখছি না। ব্যাপার কি বলতো শুনি। গোপালটা খুব ফাঁকি দিচ্ছে বুঝি আজকাল?
রাজার কথায় একটু ভড়কে গেল মালিনী। চোখ না তুলেই বলল, আজ্ঞে না রাজা মশাই, তার খুব জ্বর এয়েছে। বিছনা ছেড়ে উঠতে পারে না। কিছু মুখেও তুলতে পারছে না।    
সে কী কথা, কবে আবার অসুখ করল ওর।
এই সপ্তা ধরেই তো জ্বর চলছে।
আমাকে বলবি না তুই। ঠিকাছে সন্ধেয় একবার আসিস, আমি রাজবদ্যিকে বলে দেব। দেখি এখন কি কি ফুল পেয়েছিস আজ।
মালিনী তার হাতের ডালি বাড়িয়ে ধরল। রাজা ডালির ভেতর থেকে আর সব ফুলের ছোঁয়া বাঁচিয়ে একটা লাল গোলাপ তুলে নিলেন। তারপর বললেন, ঠিকাছে তুই তবে যা। চাইলেন রানির দিকে।
মালিনী যেমন এসেছিল, চলেও গেল তেমনই চুপচাপ।
রাজা আর রানী হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন বাগানে। বাগানের মাঝ বরাবর পেতে রাখা বিঞ্চু মূর্তির বেদিতে বসলেন মুখোমুখি।
পাতার আড়াল ছেড়ে পাখিরা বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। ছুটোছুটি করছে এখন তারা খোলা আকাশে। রোদের রঙ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। লুটোপুটি খাচ্ছে রাজা আর রানিকে ঘিরে। রানির কপালের ওপর ছড়িয়ে পড়া কিছু চুল উড়ছে হাওয়ায়।
উঠে দাঁড়ালেন রাজা।
রানী তাকালেন রাজার মুখের দিকে। তারপর হাসলেন। রাজার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিতে নিতে রানি বললেন, এটা কী পাগলামী আপনার।
হোক পাগলামী। রানির মুখের দিকে চেয়ে আছেন রাজা।
এটা তো পাপ।
কে বলেছে পাপ, কোনও পাপ নেই এতে।
পুজোর জন্যে তোলা ফুল কেবল ঠাকুরেরই প্রাপ্য। সে ফুল অন্য কাউকে দিলে যদি অমঙ্গল হয়? ঠাকুর যদি বিমুখ হন?
এসব একদম ভাববে না রানি। ঠাকুরের যা প্রাপ্য তাকে তা আমি দেই। সেখান থেকে একটা ফুল যদি আমার রানিকে দেই, এতে এমন কিছু মনে নেবেন না ঠাকুর। রাজা এগিয়ে এসে রানির মাথার ঠিক ওপরে ফুলটা ছুঁয়ে দিয়ে রানির সামনে ধরলেন।
নাও, এটা গ্রহণ করো।
রানি নিলেন। রাজা এবার রানির চিবুক ধরে বললেন, কেবল ঠাকুর তো নয়, তুমিও আমার পুজনীয়, রানি। কতবার বলব তোমায়, তোমাকে পুজো করাও যে আমার কর্তব্য।
কেঁপে উঠল রানির ঠোঁট, তবু, তবু ভয় হয় আমার। যদি আপনার মনোবাঞ্ছা পূরণ না হয়। যদি ঠাকুর মনে কিছু নিয়ে ফেলেন।
রানির কাছ ঘেঁষে বসলেন রাজা। রানির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন, আমার জীবনে কোনও পাপ নেই রানি। এই খাগড়া মুল্লুকের সবাইকে আমি ভালোবাসি। আমার চরম শত্রুও বলতে পারবে না, আমি কারও কোনও অনিষ্ট করেছি। তবে কেন ঠাকুর আমাকে পূর্ণ করবেন না রানি? এসব তুমি ভেবো না। ঠাকুর নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন আমাদের দিকে।
তবু আমার ভয় রাজা। আমি কী এমন যে, আমাকে ঠাকুর পুজোর ফুল দিতে হবে।
কী হয়েছে আজ তোমার রানি? প্রতিদিনই তো ঠাকুরকে দেবার আগে তোমাকে পুজোর ফুল দেই, কই এভাবে তো বলোনি।
গত রাত্রে আমি ঠাকুরকে স্বপ্নে দেখেছি।
চমকে ওঠেন রাজা। হাত ছেড়ে দিয়ে রানির চোখে তাকান তিনি। কী দেখলে?
একটি ফুল।
কি ফুল?
জানি না।
রং কেমন?
জানি না।
ফুল দেখলে কেবল?
হ্যাঁ। দেখলাম, ঠাকুর আমার শিথানের থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি কতবার করে ডাকলাম তাকে, তিনি শুনলেনই না। কোনও দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ চলে গেলেন।
তারপর?
তারপর আবার কী, ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম আপনি ঘুমোচ্ছেন, তাই আর জাগালাম না।
এতক্ষণ বললে না কেন?
ভাবছিলাম। আচ্ছা কেন দেখলাম এ রকম স্বপ্ন, মানে কী এর?
কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন রাজা রানির মুখের দিকে। কথা বললেন না কোনও। তার মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।
রানি হঠাৎ করেই হাত ধরলেন রাজার। মুখটা একটু নামিয়ে এনে বললেন, কী ভাবছেন রাজা?
চমক ভাঙে রাজার। ভাবছি রাজজ্যোতিষীকে ডেকে ব্যাপারটা খুলে বললে কেমন হয়।
কিন্তু...
কী?
বলাটা কি ঠিক হবে, এমনিতে প্রজাদের নানা ধারণা আপনার সম্বন্ধে। স্বপ্নের ঘটনা যদি পাঁচকান হয়ে যায়।
তুমি ভুলে যাচ্ছ রানি সে আমাদের রাজজ্যোতিষী। পাঁচকান হবার প্রশ্নই ওঠে না।
না থাক, এমন তো কোনও গুরুতর ব্যাপার নয়।
তুমি এত ভাবছ কেন?
আমার ঠিক ভালো লাগে না। আপনাকে সবাই আঁটকুড়ে রাজা বলে এমনিতেই ঠাট্টা-মশকরা করে। আবার এসব নিয়ে যদি নানা কথা ছড়ায়।
আচ্ছা, ঠিকাছে। তুমি যখন চাচ্ছ না, তখন না হয় থাক রাজজ্যোতিষী। তবে কেন দেখলে এ রকম স্বপ্ন, ভাবনা যে রয়েই গেল।
ঠাকুর যা করবেন নিশ্চয়ই আমাদের ভালোর জন্য করবেন। আপনি অত চিন্তা করবেন না।
কিন্তু রানি...
চলুন উঠি, আপনার পূজার সময় হয়ে গেছে। রোদ বাড়ছে, দেখেছেন?
ও হ্যাঁ, চলো। রাজা উঠলেন। রানিও। হাঁটতে হাঁটতে বাগান পেরিয়ে এলেন তারা। রানি গেলেন নিজ কক্ষে। রাজা গেলেন স্নানে। স্নান শেষে পরলেন পুজোর সাজ, শ্বেতশ্রভ্র সে পোশাক। ঢুকলেন এসে ঠাকুরঘরে। ঠাকুরের সামনে ডালিতে ফুল সাজানোই ছিল। তিনি একটা একটা করে সেই ফুল ঠাকুরের চরণে ছুঁইয়ে দিলেন আর চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন।

যদা যদা হি ধর্মেশ্বরী
গ্লানি ভবতীর্ণ হা কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু
দীনবন্ধু জগৎপথে
গোপেশী গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমস্কতে...    

এইভাবে ডালি শূন্য করে করজোড়ে ধ্যানস্থ হলেন রাজা। চোখ বুজে তিনি আওড়ালেন সেই বাণী যা শ্রীকৃষ্ণ মহামায়াকে বলেছিলেন, সর্বান পুত্রাদীন কাময়ন্তে যে তেষাং বরামীশ্বরীং শ্রেষ্ঠাং নিয়ন্ত্রীম, অর্চকানাং সর্বান কামবরান প্রদ্দাতি যা তাম।
কিছু সময় চুপচাপ। দুর্গার শ্রী মুখখানি স্মরণে আনলেন তিনি। মনে মনে উচ্চারণ করলেন, হে দুর্গে, তুমি বরদানকারিনী, পাপনাশকারিনী, শুষ্ক ও বিশুষ্ক দৈত্যদের বিনাশকারিনী। তুমি আমার দুঃখ দূর করে দাও মা। অস্ত্রধারী তোমার জয় হোক। অনন্ত শিবের অনুগামী তুমি, আমাকে পুত্রমুখ দর্শন করাও। পুন্নামো নরকাদ যস্মাৎ ত্রায়তে পিতরঙ সুতঃ তস্মাৎ পুত্র ইতি প্রোক্তৎ স্বয়মেব স্বয়ম্ভূব্য...
চোখ ভিজে উঠেছে রাজার। তিনি কাঁদছেন।
দুর্গার চোখে জল নেই। শিব ঠাকুরও কোনও ভাষা ব্যক্ত করেন না। কেবল রাজার বুকের খুব ভেতর থেকে ঢেউ ভাঙে।
আরও কিছু সময় বসে রইলেন রাজা। তারপর চোখ খুলে জল মুছলেন কাপড়ের খুঁট দিয়ে। ধীর পায়ে বের হয়ে এলেন পুজোর ঘর থেকে।
রানি বসে ছিলেন জলখাবার সামনে নিয়ে।

চলবে...