অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ১০

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০১৮

রানি বললেন, তুই গতকালই রওনা দিয়ে দে। দুজন সৈন্য নিয়ে যাবি। ওরা তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
বিমলা বলল, কিন্তু রাজকুমারীর দেখাশোনা কে করবে রানিমা?
রানি জবাব দিলেন, আমিই করব বিমলা। রাজকুমারী এখন থেকে আমার সঙ্গেই থাকবে। আমিই ওকে স্নান করাবো। খাইয়ে দেব। বুঝি, রাজকুমারীর প্রতি তোর টান। এসব নিয়ে তুই ভাবিস না বিমলা। তুই বরং কেষ্টনগরে থেকে আয় কিছু দিন। এই যে দ্যাখ না, কতদিন হয়ে গেল, বাবার বাড়ি যাই না। তোদের এই খাগড়া মুল্লুকেই আমার শেকড় গেড়ে গেছে রে।
বিমলা বলল, যান না কেন রানিমা? গেলেই তো হয়।
রানির মুখে কী যেন মায়া ঘনিয়ে এলো। মনে পড়ে গেল তার বাবার বাড়ির কথা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, রাজপরিবার ফেলে বাইরে থাকা যায় না রে বিমলা। রাজা সামলান রাজ্য, আর রানি সামলান রাজপরিবার। দেখিস না, আমার দাদা প্রতাপচন্দ্রকে। সেই যে কত বছর আগে একবার এসেছিলেন। এর মধ্যে আর সময়ই হলো না তার। শুনেছি, প্রজাদের কল্যাণ চিন্তাতেই তার সময় কেটে যায়।
দু’হাতে একগাদা ফুল নিয়ে তৃষ্ণা এলো। বিমলার কোলের ওপর ফুলগুলো রেখে বলল, বড় দেখে গেঁথো কিন্তু মালাটা। আহা, শুধু গাঁদাফুল কেন দিচ্ছ? গাঁদাফুলের মাঝে মাঝে এই যে গোলাপ গন্ধরাজ এসবও দ্যাও।
বিমলা মুখ তুলে বলল, আমার যে হাত ধরে আসে রাজকুমারী। ঠিকাছে, মালিকে বলে তোমাকে একদিন অনেক বড় একটা মালা বানিয়ে দেব। বাগানে যত রকমের ফুল আছে, সব ফুল থাকবে সে মালাতে। খুশি তো?
তৃষ্ণা হাসল। তার মুখের দিকে চেয়ে টনটন করে উঠল রানির বুক। কী নিষ্পাপ হাসতে পারে মেয়েটি। আর তার কীনা এমন নিয়তি! দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। ডাকলেন, আয় তো মা, এদিকে আয়।
তৃষ্ণা এসে বসল মায়ের গা ঘেঁষে। ওর মাথা রানি টেনে নিলেন বুকে। তার চোখ ভিজে এলো। চুলে বিলি কাটতে কাটতে তিনি বললেন, বিমলাকে খুব ভালোবাসিস, নারে তৃষ্ণা?
রানির বুকের ভেতর থেকে তৃষ্ণা জবাব দেয়, হুঁ বাসি তো। বিমলা কত ভালো! আমাকে কত আদর করে।
রানি বললেন, বিমলা মাসখানেকের জন্যে তোমার মামাবাড়ি কেষ্টনগরে যাবে। এ ক’দিন তোমার সঙ্গে আমি থাকব। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গেই ঘুমোবে। আমিই তোমাকে স্নান করিয়ে দেব।
মুখ তুলে তৃষ্ণা জিগেশ করল, মামাবাড়ি অতদিন থাকতে হবে কেন রানিমা?
রানি বললেন, তোমার মামার পুত্র হয়েছে। তার দেখাশুনার জন্যে বিমলাকে পাঠাচ্ছি।
আর কিছু বলল না তৃষ্ণা। চেয়ে রইল বিমলার দিকে। বিমলা মালা গাঁথা প্রায় শেষ করে এনেছে। তৃষ্ণা বলে উঠল, তুমি তো কাল চলে যাবে। বাগানের সব ফুল দিয়ে মালা তবে গেঁথে দেবে কেন?
বিমলা হাসল। ওই শোনও রাজকুমারীর কথা। সে মালা কি আর আমি গাঁথব? আমি বলে যাব মালিকে। সে-ই তোমাকে বানিয়ে দেবে মালা।
পরদিন সকালে বিমলা চলে গেল কেষ্টনগরে। তার সঙ্গে নবজাতকের জন্যে কিছু উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে দিলেন রানি। আর একটি চিঠি। চিঠিতে তিনি লিখেছেন:

পূজনীয় দাদা,
প্রণাম নিবেন। আমরা ভালো আছি। আপনার পুত্রপ্রাপ্তির সুসংবাদ শুনেছি। আমরা আহ্লাদিত। নতুন অতিথির সেবাযত্নের জন্যে অন্দরমহলের দীর্ঘদিনের দাসি বিমলাকে আপনার ওখানে পাঠাচ্ছি। শিশু লালনপালনে সে খুবই দক্ষ। আশা করি, বৌদি তাকে পেয়ে খুশিই হবেন।

আবারও প্রণাম
ইতি
চন্দ্রমালা

সভা থেকে ফিরলেন রাজা। কাঁসার ঝকঝকে গেলাশে রানি তাকে এনে দিলেন শরবত। রাজা জিগেশ করলেন, তুমি কেন? বিমলা কোথায়?
রানি বললেন, ওকে কেষ্টনগরে আমার বাবার বাড়ি পাঠিয়েছি। সেখানে থেকে আসুক মাসখানেক।
কেন? হঠাৎ এত লম্বা ছুটি দিয়ে দিলে বেচারীকে?
রানি বললেন, দু’কারণে।
হেসে ফেললেন রাজা। বললেন, বাহ, আমার রানি দেখছি রাজ্যচালনার কৌশলগুলোও শিখে ফেলছে। আগে থেকে ভেবে একটু একটু করে এগোনো। তা শুনি, প্রথম কারণ কি?
হাতে তুলে নিলেন তিনি শরবত।
রানি বললেন, শরবতটুকু খেয়ে নিন, বলছি।
রাজা শরবত খেয়ে রানির হাতে দিলেন গেলাশ। রানি বললেন, প্রথম কারণ, বিমলা শিশু পরিচর্যায় বেশ দক্ষ। দাদার ছেলেকে সে ভালো সেবা দিতে পারবে।
আচ্ছা, রাজার স্বরে প্রশংসা। আর দ্বিতীয় কারণ?
রানি বললেন, রাজকুমারী গর্ভবতী। তার লক্ষণও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বাপারটা যাতে গোপন থাকে, এজন্যে বিমলাকে সরানো।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন রাজা। পাথর চোখে তাকালেন রানির চোখের দিকে। ভাবলেশহীন রানির চোখ। রাজাকে বিমর্ষ দেখালো। আর অসহায়। এ যেন গ্লানি। সংসারের মায়া ছিন্ন করে বনবাসে যাওয়ার আয়োজন। সহসা কোনও কথা তার মুখে এলো না। আর রানি মাথা নিচু করে বসে আছেন। গ্লানির ভার তাকেও যে সইতে হচ্ছে। সে-ই তো এ ঘটনার জন্যে দায়ী।
মাথা নিচু করেই ধরা গলায় রানি বললেন, আমি আর ভাবতে পারছি না রাজামশাই। এসব আমারই জন্যে ঘটছে। আমিই এর জন্যে দায়ী।
অনেক দূর থেকে যেন রাজা বলে উঠলেন, আমিও কিছু ভাবতে পারছি না রানি। এ যে মহাসঙ্কট। তবে ভেঙে পড়লে চলবে না। ধৈর্য ধরে সবকিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। আমি ভাবছি, রাজজ্যোতিষীকে ডেকে করণীয় কিছু বের করা যায় কীনা।
রানির স্বরে ফুটে উঠল সাবধানতা। না-না, এ ভুলটি আপনি করতে যাবেন না রাজামশাই।
রাজা ঠিক বুঝলেন না রানির এ আতঙ্কের মানে। তিনি জিগেশ করলেন, কেন? কী হয়েছে রানি?
রানি বললেন, বিষয়টি যাতে গোপন থাকে, এজন্যেই আমি বিমলাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনি আবার রাজজ্যোতিষীকে এটা জানাবেন? যদি সে পাঁচকান করে দ্যায়?
দেবে না রানি। এ নিয়ে তুমি ভেবো না। রাজজ্যোতিষি হলেন রাজার খাস লোক। রাজপরিবারের যা যা গোপনীয়, তা গোপন রাখাই তার রাজদায়িত্ব। এর বিপরীত হলে তার গর্দান নেয়া হবে। আর এটাই রাজদণ্ড। বিমলাকে কেষ্টনগরে না পাঠালেও তুমি পারতে। যাক, পাঠিয়েছো যখন, দাদার পুত্রটাকে দেখভাল করতে পারবে। রাজকুমারী কোথায়?
বসে আছে বারান্দায়।
চলো, রাজা উঠলেন।
লম্বা টানা বারান্দায় বসে বাগানের দিকে চেয়ে ছিল রাজকুমারী। তার চারদিকে কয়েকটি পাখির খাঁচা। খাঁচায় নানা রঙের, নানা ঢঙের পাখি। চনমনে ডেকে যাচ্ছে তারা। রানিমা এসবের ব্যবস্থা করেছেন। রাজকুমারী তৃষ্ণা কয়েকদিন ধরে এ জায়গাটিতেই বসে থাকতে পছন্দ করছে। আর এ সময়গুলো কী রকম যেন বিষণ্ন থাকে রাজাকুমারী। রানিমা তাই পাখিগুলোর ব্যবস্থা করেছেন। এই ক’দিনে বেশ শুকিয়ে গেছে রাজকুমারীর চেহারা। দেখলেই কান্নার ঢেউ ভাঙে রানির বুকে।
তৃষ্ণা এতক্ষণ পাখিগুলোর সাথে কথা বলছিল। আশ্চর্য, সে তো এতদিন বোঝেনি, পাখির সাথেও কথা বলা যায়! কী যেন এক ভার তার বুকের খুব ভেতরে। সে অপরাধী। সে বুঝতে পারছে, রাজা আর রানিমা তাকে নিয়ে উদ্বেগে আছেন। এতদিনকার সম্পর্কের মাঝে সাত বছরের রাজকুমারী একটু যেন দূরত্ব টের পেল। আর সে এ-ও বুঝে গেছে যে, তার পেটে বেড়ে উঠছে একটি মানব শিশু। সে হতে যাচ্ছে তার মা। একদিকে ব্যাপারটা তার কাছে মজার লাগছে, আরেকদিকে ক্লান্ত আর বিষণ্ন হয়ে পড়ছে সে। খাঁচায় বন্দি ডানা ঝাপটানো এই পাখিগুলোর সাথে কথা বলে এখন তার ভালো লাগছে।  
রাজকুমারী দেখল, বারান্দা ধরে হেঁটে আসছেন রাজা-রানি। দুজনের মুখই কী রকম যেন থমথমে। রাজা এসে বসলেন রাজকুমারীর পাশে। রানি বললেন, আপনি রাজকুমারীকে নিয়ে বসুন। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি। অন্দরে কাউকে ঢুকতে আমি নিষেধ করে দিয়েছি।
ভালো করেছ রানি, যাও। পরম মমতায় রাজকুমারীর মাথায় রাজা হাত রাখলেন। রানি চলে গেলেন। বারান্দার ওদিকে উঠে এসেছে নিমগাছের একটি বড়সড়ো ডাল। ডালে বসে একটি কোকিল লেজ নাড়ছে। আর ডাকছে। কে জানে, হয়তো খাঁচার পাখিগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। ডেকে যাচ্ছে খাঁচার পাখিগুলোও। কিচিরমিচির শব্দে বেশ ঝরঝরে আজকের দিন। নরম রোদের দুপুর। সবুজ আর কী রকম ছায়া ছায়া চারদিক।
তৃষ্ণার পাশে বসলেন রাজা। বললেন, খুব যে দেখি ডাকাডাকি করে পাখিগুলো। বেশ লাগে শুনতে, তাই না মা?
হ্যাঁ বাবা। পাখিগুলোর সাথে আমি কথা বলি। আচ্ছা বাবা, পাখিরা কি মানুষের কথা বোঝে?
বোঝে হয়তো, কেন মা?
বসে বসে তাহলে পাখিগুলোর সাথে কথা বলা যেত। শুনতাম ওদের কথাও। পাখিগুলোরও তো কত কত বলার কথা থাকে, তাই না বাবা?
রাজা মাথা নাড়লেন। হুঁ, তা তো থাকেই। সেসব কথা বুঝতে পারলে তো খুবই মজা। তা সে চেষ্টাই কি করছে আমার রাজকুমারী?
তৃষ্ণাকুমারীর টলটলে মুখে হাসির ভাঁজ পড়ল। বলল, ওই কাকাতুয়াটাকে কথা বলা শেখাবো। বিমলা বলছিল, শেখালে নাকি কাকাতুয়া মানুষের মতো কথা বলতে পারে। সত্যি নাকি বাবা?
রাজা মাথা দোলালেন, হুঁ সত্যি। তুমি বুঝি কাকাতুয়াকে কথা বলা শেখাবে?
হ্যাঁ। কাকাতুয়া মানুষের মতো কথা বলবে, ভারি ভালো লাগছে আমার।
রাজা জিগেশ করলেন, কী কী শেখাবে?
অনেক কিছু। এই ধরো, আমার নাম। কাকাতুয়া ডাকবে, তৃষ্ণাকুমারী তৃষ্ণাকুমারী? কী দারুণ, না বাবা?
রাজার চোখ ভিজে উঠল। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন নিমগাছটার ডালটার দিকে। বুকের ভেতর কী এক ব্যথা মুচড়ে উঠছে।  
বিকেলবেলা এলেন রাজজ্যোতিষী। হালকা-পাতলা মানুষটি। বয়সের কোনও গাছপাথর নেই। গেরুয়া বসন। কপালে চন্দনের প্রলেপ। চোখে আজকাল কম দ্যাখেন। তিনি রাজা তেপইয়ের বাবা রাজা নারায়ণচন্দ্রেরও রাজজ্যোতিষী ছিলেন। তেপই তাকে নিয়ে রাজবাড়ির গোপন একটি কক্ষে ঢুকলেন। কাঁধের ঝোলা মেঝের ওপর রাখলেন জ্যোতিষী। এরপর বললেন, বলেন রাজামশাই, কী জন্যে খবর দিয়েছেন।
রাজা বললেন ঘটনার আগুপিছু বেত্তান্ত। জ্যোতিষী ঝোলার ভেতর থেকে কিছু পুথি বের করলেন। দেখেই বোঝা যায়, বেশ প্রাচীন সেগুলো। কী রকম ঝুরঝুর পাতা। খুব সাবধানী আঙুলে জ্যোতিষী পুথির পাতা ওল্টাতে লাগলেন, আর কী যেন খুঁজতে লাগলেন। চোখের চশমা নাকের ডগায় এসে ঝুলে পড়েছে। কিছুক্ষণ এভাবে খোঁজাখুঁজির পর জ্যোতিষী বললেন, শনির অপচ্ছায়া রাজামশাই। চক্রব্যূহ ভেদ করে যে গর্ভকুসুম রানিমা হাতে পান, তা হলো পারিজাত। স্বর্গে এই ফুল ফোটে। ধুলোমাটির মর্ত্যে এ ফুল দুর্লভ। শনির কুদৃষ্টি সবসময়েই ছিল ফুলটার ওপর। সুযোগ বুঝে শুভদিনটিতেই গ্রহটি তার কার্য সমাধা করল।
গভীর উদ্বেগে রাজা চাইলেন জ্যোতিষীর মুখের দিকে। কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল রাজার, এখন উপায় কি জ্যোতিষী?
জ্যোতিষীর স্বরও নিভু নিভু প্রদীপের মতো, একটা কিছু উপায় তো বের করতেই হবে রাজামশাই। রাজপরিবারের সুনাম বলে কথা। সারাজীবন রাজামশাই প্রজাদের নিন্দেমন্দ শুনে যাবেন, তা তো চলে না।
জ্যোতিষীর মুখে সত্যি সত্যি দুশ্চিন্তার ছাপ।
রাজার স্বরে আকুতি, যা হোক, একটা কিছু ব্যবস্থা বের করুন জ্যোতিষী। এই মহাসঙ্কট থেকে রাজপরিবারকে উদ্ধার করুন।
জ্যোতিষী চিন্তিত মুখে বললেন, এখনই অত বিচলিত হবেন না রাজামশাই। আমি দেখছি কী করা যায়।
মাটিতে আঁক কষলেন রাজজ্যোতিষী। বিড়বিড় করে কী সব মন্ত্র আওড়ালেন। এরপর আবার সাবধানী আঙুলে পুথির পাতায় কী যেন খুঁজতে লাগলেন। আর তার দিকে চেয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় বসে রইলেন রাজা।
বেশ কিছু সময় পর পুথির ওপর থেকে চোখ তুলে গায়ের বসন দিয়ে চশমার কাচ মুছলেন জ্যোতিষী। এরপর চশমাটা কানে আঁটতে আঁটতে বললেন, উপায় একটা পাওয়া গেছে ঠিকই, তবে তা মর্মান্তিক বিচ্ছেদ। ক্যামনে বলি...
আপনি বলুন, নির্ভয়ে বলুন জ্যোতিষী। ভাগ্যের ফেরে মানুষের জীবনে কত কিছুই তো ঘটে। আমার জীবনে যা-ই ঘটুক, আমি মেনে নেব।
জ্যোতিষী বললেন, রাজকুমারীকে বনবাসে পাঠাতে হবে।
সে কী! আঁতকে উঠলেন রাজা। হায় হায় করে উঠলেন রাজা, ওতটুকু মেয়েকে কীভাবে আমি জন্তু-জানোয়ারের মুখে ঠেলে দেব? এ কী বলছেন জ্যোতিষীমশাই? না-না, এ হতে পারে না। আপনি অন্য কোনও উপায় খুঁজে বের করুন। রাজকুমারীর এ বিচ্ছেদ আমি সইতে পারব না।
জ্যোতিষী বললেন, কিন্তু আর তো কোনও উপায় দেখছি না রাজমশাই। প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র বলছে, রাজকুমারীতে বনবাসে পাঠাতে। তবে তা কতদিনের জন্যে, তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। সময় চক্রে শনির কুপ্রভাব কাটিয়ে উঠলে রাজকুমারী আবার ফিরে আসবে রাজবাড়িতে। তখন সে ফেরা হবে রাজোচিত। বীরের মতো তিনি ফিরবেন পিতৃগৃহে।
রাজা বললেন, কিন্তু জ্যোতিষীমশাই, আমি ভাবছি গর্ভের ভ্রুণ যতি হত্যা করা হয়। তবে তো রাজকুমারীর বনবাস আটকানো যাবে। রাজপরিবারের সুনামও ক্ষুণ্ন হলো না।
জ্যোতিষীর স্বরে দৃঢ়তা, না মহারাজ, ভ্রুণ হত্যা শাস্ত্রে কঠোরভাবে নিষেধ। আমরা যেন ভুলে না যায় শাস্ত্রের বিধান।
তবে আর কি, এই যখন নিয়তি তখন মেনে তো নিতেই হবে। শোকের পাথর বুকে চেপে থাকলেও উঠলেন রাজা। ঝোলা গোছাতে লাগলেন জ্যোতিষী। রাজা বললেন, শুনুন জ্যোতিষীমশাই, আপনি আমার বাবার আমল থেকে রাজপরিবারে আছেন। আশা করি, রাজপরিবারের মর্যাদা আপনি রক্ষা করবেন। এ ঘটনা কোনোভাবেই যেন পাঁচকান না হয়। রাজপরিবারের সম্মান মানে আপনার পরিবারের সম্মান, ভুলে গেলে চলবে না।  
মাথা নুইয়ে জ্যোতিষী জবাব দিলেন, আজ্ঞে, সে জ্ঞান আমি কখনোই বিস্মৃত হই না রাজামশাই। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।  
রাজা বললেন, ঠিকাছে, আপনি এখন আসুন।
চলে গেলেন রাজজ্যোতিষী। রাজা ফিরলেন অন্দরে। চোখে জল এসে যাচ্ছে তার। আর তিনি ভাবছেন, আজ রাতেই বসবাসে পাঠাতে হবে রাজকুমারীকে। সবার অলক্ষ্যে। এমনকি রানিও যেন বুঝতে না পারে। কাজটা সারতে হবে খুবই কৌশলে। এবং এ কাজটি তিনি নিজেই সমাধা করবেন। কিন্তু কীভাবে? এখানে এসেই রাজা আটকে গেলেন। আর এগোতে পারলেন না। তার যে মন মানছে না। কলিজার টুকরোকে কীভাবে তিনি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বনবাসে বাঘের মুখে রেখে আসবেন? আর রানিমা, তার বুকের পাষাণ বইবার মেরুদণ্ড তার তো নেই।
রাজকুমারীকে নিয়ে জানলার কাছে বসে ছিলেন রানি। বাইরে দিনের ক্ষয়াটে রঙ। সন্ধে নেমে আসছে। কী রকম যেন বিষণ্নতা ছড়িয়ে আছে ঘরটাতে। রানির মুখ বিষণ্ন। রাজকুমারীর মুখ বিষণ্ন। ভেতরে ভেতরে বিষণ্ন রাজাও। রাজা এসে বসলেন তাদের সাথে।
রানি বললেন, রাজামশাই, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছেন কখনও?
রাজা জিগেশ করলেন, কী রানি?
জানলার বাইরে উদাস চোখে চেয়ে থেকে রানি বললেন, দিন যখন শেষ হয়ে যায় আকাশে তখন বিষণ্নতার রঙ ছড়িয়ে পড়ে।
রাজা বললেন, না রানি, এ তোমার মতো করে তুমি ভেবে নিয়েছো। আমার তো মনে হয়, গোধূলির আলোকচ্ছটা প্রাণের ওপর রাঙিয়ে যায়। আর তখন আনন্দে ভরে যায় মন। আর এই যে, তৃষ্ণা মা আমার, এসো তো আমার কাছে। আজ রাতে আমরা একজায়গাতে যাব।
রানি জিগেশ করলেন, কোথায় যাবেন আবার?
রাজা বললেন, সে তুমি চিনবে না রানি। দু’দিনের হাঁটার পথ। রাজজ্যোতিষী বললেন, সেখানে গভীর এক বন আছে। বনের ভেতর আছে একটি কালীমন্দির। তবে পরিত্যক্ত। সেখানে এক সন্যাসী থাকেন। তিনি রাজকুমারীর মাথায় হাত রাখলে রাজপরিবার শনির প্রভাবমুক্ত হবে।
রানি জিগেশ করলেন, রাজজ্যোতিষী এসছিলেন?
হ্যাঁ রানি। রাজার ছোট্ট জবাব। ভেতরে ভেতরে তিনি হাপাচ্ছিলেন। সহজেই তিনি যে এভাবে একটা গল্প বানিয়ে ফেলবেন, ভাবতে পারেননি। আর এখন ভাবছেন, সহজে তো হয়েই গেল। বেশ নির্ভার লাগছে ভেতরটা। রানির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনিও এ গল্প বিশ্বাস করে নিয়েছেন।
রাজার বুক ধড়াস ধড়াস কেঁপে উঠল।

চলবে...