তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ১৪

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০১৮

আলোকচন্দ্র অবাক হয়। চোখ কপালে তুলে বলল, সে কী! আমি তাহলে আলোকচন্দ্র নই, আমি রাজপুত্র?
হ্যাঁ, তুমি রাজপুত্র। তোমার মায়ের নাম তৃষ্ণা। সে এখন পাষণ্ড এক সওদাগরের হাতে বন্দি। তোমার নানা খাগড়া মুল্লুকের রাজা তেপই। তুমি এখন তোমার মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো।
আলোকচন্দ্র জিগেশ করল, কিন্তু তাকে আমি এখন কোথায় খুঁজে পাব?
সন্যাসী বললেন, খুঁজতে বের হওয়ার আগেই যে বলে, কোথায় খুঁজব, সে কাপুরুষ। আগে বের হও। পথই তোমাকে পথ দ্যাখাবে। আমি এবার যাচ্ছি। ভুলে যেও না আমার কথা। বিদায়। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন সন্যাসী। আলোকচন্দ্রের চোখমুখের বিহ্বলতা তখনও মিলিয়ে যায়নি। তার শরীরে তবে রাজরক্ত! কিনু গোয়ালা তার বাবা নয়? খেদি নয় মা? কিন্তু এ ক্যামন কথা! ভাবনার থই পেল না আলোকচন্দ্র। তবে এটুকু বুঝল, সন্যাসীর কথা তাকে মান্য করতেই হবে। বেলা পড়ে আসছে। সে উঠল।
 
বাড়ির কাছাকাছি যখন গরুগলো নিয়ে পৌঁছলো, দেখল, রান্নাঘরে মা রান্না করছে। বাবা বসে খড় কেটে রাখছে। গোধূলির আলোয় রাঙা সন্ধ্যায় শুকনো খড়ির ধোঁয়া কুয়াশার মতো আচ্ছন্নতা তৈরি করছে। আলোকচন্দ্রের মন কেমন করতে লাগল। এই পরিবার থেকে আজ তাকে বিদায় নিতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে তার সত্যিকারের জননীকে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মায়ের মুখের হাসি তার চোখ এড়ালো না। আহা, স্নেহময়ী এই মাকে ছেড়ে যেতে হবে। গরুগলো বেঁধে রেখে সে বাবার কাছে এসে বসল। জিগেশ করল, বাবা, বলো তো আমি কে?

আচমকা এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল কিনু গোয়ালা। মাথা তুলে ছেলের মুখের দিকে চাইলো। অবাক চোখে জিগেশ করল, তুমি কে মানে? রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে খেদি। ওই দেখেছো, কইয়েছিলাম না, কী রকম চুপচাপ খেয়ালি হয়েছে আমাদের খোকাবাবু।  আলোকচন্দ্র বলল, খেয়ালি নয় মা। আমি সত্যি সত্যি জিগেশ করছি। আজ নদীর ধারে এক সন্যাসীর সঙ্গে আমার দ্যাখা হইছিল। সে বলে গেছে, আমি রাজপুত্র। খাগড়া মুল্লুকের রাজা তেপই আমার নানা। আমার মায়ের নাম তৃষ্ণা। এক সদাগর তাকে বন্দি করে রেখেছে। আমাকে মায়ের সন্ধানে যেতে হবে।

হকচকিয়ে আলোকচন্দ্রের দিকে এতক্ষণ চেয়ে ছিল খেদি। এবার সে কেঁদে ফ্যালে, এই রে, আমার খোকারে ভূতি ধরিছে গো, এখন কী হবে...। কিনু এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। কীসের সন্যাসী, তাও তার মাথায় ঢুকল না। তবে বুঝল, এইবার আলোকচন্দ্রকে তার সত্যি পরিচয় জানিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। তাই সে কিছুই গোপন করল না। খেদি কিন্তু কিছুতেই ছাড়তে রাজি হলো না আলোকচন্দ্রকে। কিনু বোঝালো তাকে সন্যাসীর কথা অমৃত। বলল, ওকে ছেড়ে দে বউ। ভাগ্যি থাকলে দ্যাখা আবার হবে।

খেদি-কিনু বিদায় দিল আলোকচন্দ্রকে। আলোকচন্দ্রও বিদায় দিল তাদেরকে। খেদির চোখে পানি। হাউমাউ করে সে কাঁদছে। কিনু কাঁদছে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয়টা আলোকচন্দ্রেরও তড়পাচ্ছে। আহা, মানুষ দুজন আবারও নিঃসন্তান হয়ে গেল।

নদীটা পেরিয়ে বিস্তৃত শর্ষেখেতের আল ধরে আলোকচন্দ্র হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো লোকালয়ে। আবার লোকালয় পেরিয়ে বিরান মাঠ পাড়ি দিল। কখনও হাঁটতে লাগল ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে। দিনের আলো নিভল। অন্ধকার এলো নেমে। দূরে একটি গ্রাম দ্যাখা যাচ্ছে। গ্রামে ঢোকার  মুখে একটা মন্দির। যদিও দেয়াল ধসে গেছে। আগাছায় ভয়ে উঠেছে ভেতরটা। পায়ে পায়ে মন্দিরটার দিকেই এগোলো আলোকচন্দ্র। রাতটা সেখানেই কাটিয়ে দিল। ভোর হলো। আবার হাঁটতে শুরু করল আলোকচন্দ্র। একটা ভাবনাও তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছে। এভাবে সে কোথায় খুঁজবে মাকে? কোনও চিনপরিচয় নেই। মাকে সে চিনবে কীভাবে, তাও তো কিছু সন্যাসী বলে যাননি।

হাঁটতে হাঁটতে দিন ফুরালো। নেমে এলো রাত। নদীর তীরে বটগাছ। তার নিচে আশ্রয় নিল আলোকচন্দ্র। কিন্তু ঘুম এলো না। একটা প্যাঁচা ডেকে যাচ্ছিল কাঠেপিঠে কোথাও। নদীর দিক থেকে ছুটে আসছিল শিরশির হাওয়া। তবু ঘুম এলো না আলোকচন্দ্রের। ঘুম এলো শেষরাতে।

খিলখিল হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। উঠে বসে দেখল, চারটে পরি। না তো, এই যে এখন দিন। সূর্য সে-ই কখন উঠে গেছে। সে তো ঘুমিয়েই ছিল। আর দিনের আলোয় কখনও পরিরা নামে না। তাহলে এরা কারা? চার কিশোরী চলেছিল নদীতে স্নান করতে। তাদের রূপের ছটায় চারদিক ঝলমল করে হাসছিল। বটগাছের নিচে অচেনা এক যুবককে দেখে তারা থমকে দাঁড়ালো। প্রতিদিন এ সময়টাতে তারা স্নানে আসে। কখনও তো এ যুবককে এখানে দ্যাখা যায়নি। এক কিশোরী বলল, চলরে ভানু, এখানে না দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের কাজে যাই। কোথাকার কে-না কে, উটকো ঝামেলা।

চলবে...