নাহিদুল ইসলামের গল্প ‘রতিসংক্রান্তি’
প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০২০
এক
শেষ ট্রিপের বাস ভাড়া তুলে গুনে নিল রফিক| আজ কামাই ভাল হয়নি| রোডে মানুষ নাই ছুটির দিনে| অথচ আজ অতিরিক্ত কিছু টাকার দরকার ছিল রফিকের| বাড়িতে মা আর ছোট বোন ওর পথ চেয়ে বসে আছে| রফিক উত্তোলিত ভাড়ার টাকা থেকে দুইটা একশো টাকার নোট সরিয়ে ওর প্যান্টের চোরাপকেটে গুঁজে নিল|
বাসস্ট্যান্ডের হিসেব নিকেশ চুকিয়ে ফেলে রফিক বাজারে গেল| সদাইপাতি কিনে বাজার সংলগ্ন পরিতোষের বাংলা মদের দোকানে গিয়ে বসল সে|
দুই পেগ বাংলা মাল শূন্য উদরে ঢেলে দেয়ার মিনিট দুয়েকের মধ্যে কান গরম হয়ে উঠল ওর। আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে সেলিনার কথা। হারুন মুন্সির ডাগরমেয়ে সেলিনার সাথে বেশ খাতির হয়েছিল রফিকের। কিন্ত মুন্সি ব্যাটা রফিকের মতন ভূমিহীন বাস কন্ডাকটরের চুলের মুঠি ধরে একদিন রাস্তার মাঝখানে দুদ্দাড় থাবায় থাবায় কানমুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর রফিকের আর সাহস হয়নি কোনদিন সেলিনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে।
একদলা চানাচুর মুখে দিয়ে তৃতীয় পেগটা গিলে নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল রফিক|
শহরের শেষপ্রান্তের নদীর ধার ধরে আবর্জনায় ছেয়ে থাকা জমির একাংশ দখল করে বাঁশখুটি আর ভাঙ্গাচোরা টিন-পলিথিনের ঘর তুলে থাকছে ভূমিহীনেরা। সেই বস্তির এককোণের একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকে পড়ল রফিক। সন্ধ্যার অন্ধকার মাখানো আলোকরশ্মির শেষকণাটুকু লুফে নিয়ে জানালার ধারে বসে ওর মা কাঁথা সেলাই করছে। রফিক “বসন্ত” বলে ডাক দিল|
বসন্ত ওর একমাত্র ছোটবোন। মা আর বোন ছাড়া আমাদের ভাড়াচোর কন্ডাকটর রফিকের আর কেউ নেই|
তবে বসন্তকে সহসাই পাওয়া গেল না। আশেপাশের ঘরগুলোতে খুঁজে এল ওর মা। পাওয়া গেল না। রফিক মাঠের আল পেরিয়ে রাস্তার দোকানের মোড় পর্যন্ত খুঁজে এল। পাওয়া গেল না। তারপর হাকাহাকি, ডাকাডাকি, চিৎকার, চেঁচামেচি করে করেও বসন্তকে পাওয়া গেল না। অবশেষে বস্তির কিছুদূরে সুনসান শ্মশানঘাটের দালানের এককোণে দলা হয়ে পড়ে থাকা কোমল কলির মত উলঙ্গ, রক্তাক্ত, নিথর বসন্তকে পাওয়া গেল।
বসন্তের মৃতদেহটা কোলে নিয়ে রফিক প্রথমেই তার বুকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ওর হৃদপিন্ডের ঢিপঢিপ শব্দটা হচ্ছে কিনা। তারপর বসন্তকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ডাকতে ডাকতে রফিক সাহেব মূর্ছা গেল।
তবে তা মুহূর্তের জন্যই। সম্বিত ফিরে এল। রফিক চুপচাপ বসে রইল সেখানেই। সঙ্গীরা কান্নাকাটি, হল্লাহাটি করতে করতে বসন্তের মৃতদেহ আর রফিকের জীবিত দেহ তুলে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হল।
ভাগ্য সেদিন সুপ্রসন্ন ছিল রফিকের। মরা বসন্তকে দেখে ওর মা সেখানেই আছড়ে পড়ে কাটা কই মাছের মত তড়পাতে তড়পাতে ভবলীলা সাঙ্গ করে ফেলল।
পুলিশ এসে বসন্তের মৃতদেহ নিয়ে গেল ময়নাতদন্তের জন্য। এম্বুলেন্স এসে মায়ের মৃতদেহ দিয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। পরদিন দুপুরে জোড়া মরার জানাজা পড়ে নদীর পাড়ে নতুন স্থাপিত কবরখানায় দাফনকার্য সুসম্পন্ন হয়ে গেল।
দুই
একমাস হয়ে গেল রফিক সেই ঘরটিতেই একা থাকে। এই ঘরেই থাকত ওরা তিনজন। কিন্ত আজ রফিক সাহেব একা থাকে।
প্রতিদিন কন্ডাকটরি শেষে পরিতোষের দোকান থেকে তিন-চার-পাঁচ-ছয়-সাত পেগ বাংলা ঠুসে টলতে টলতে ঘরে ফেরে।
তবে আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করল সে। ঘরে ফিরল না। চলে গেল সুনসান শ্মশানের কাছে। রাস্তা থেকে নেমে যাওয়া মাঠের একপ্রান্তে শ্মশানের দেয়ালটাকে দেখে মনে মনে হেসে ওঠে সে।
রফিক পথ বেয়ে মাঠে নামে। শেষ বিকেলের আলোয় মাঠে দাঁড়িয়ে রাস্তার দুইপ্রান্তে ফিরে ফিরে চায় সে। অনেকদূরে রাস্তার একদিকের সীমানায় আবছা মানুষের একটা মূর্তি এগিয়ে আসতে দেখা যায়। রফিক দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিকওদিক দেখে। মানুষের মূর্তিটা এখন স্পষ্ট। বুকের কাছে বইখাতা ঠেসে ধরে মাথানিচু করে হেঁটে যাচ্ছে একজন মেয়ে। হয়ত কলেজে বা স্কুলে পড়ে।
রফিক একটা আস্ত থান ইট তুলে নিয়ে মাঠের নীচ থেকে একলাফে রাস্তায় উঠে মেয়েটার মাথায় আঘাত করে।
একেবারেই বিনাশব্দে শরীরটা লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। রফিক পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় তাকে। দৌড়ে চলে যায় সুনসান শ্মশানের দেয়ালের আড়ালে। সবমিলিয়ে এক মিনিটের এই ঘটনা ঘটিয়ে রফিক যখন মেয়েটাকে শ্মশানের দেয়ালের কোণে এনে রাখে, বোঝে, ওর হাত আর পা কাঁপছে। বাংলা মদের একটা ঢেঁকুর ঠেলে বেরিয়ে আসে ওর মুখ থেকে। আবার ভালভাবে দেখে নেয় রাস্তার দিকে। ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলে ওর মুখ। তারপর মেয়েটার জামা খুলে ফেলে।
সদ্যপ্রস্ফুটিত রক্তজবার মত বুকে কান পেতে শোনে- ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ। তারপর চোখ ভরে দেখে। তারপর তুলে নেয় মুখে, দাঁতে, নখে, হাতে, বুকে এবং সভ্যতার সূচনার প্রাণীদন্ডে।
কিছুক্ষণ পরে, আমাদের ভাড়াচোর রফিক সাহেব বেরিয়ে আসে রাস্তায়। আর সুনসান শ্মশানের দেয়ালের ধারে পড়ে থাকে একটা মৃতদেহ।
সে রাতে রফিক প্রাণভরে ঘুমায়। সকালে ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে শোনে, শ্মশানের দ্বিতীয় লাশের ঘটনা নিয়ে বস্তির গন্ডারের মত মানুষগুলো সে কি আলাপ আর উৎকন্ঠায় মেতে উঠেছে!
তিন
এরপর থেকে নানাভাবে নানাদিকে নানাবয়েসী নানা নারীর ধর্ষিত মৃতদেহ রচনা করতে থাকে রফিক মহাশয়। ধর্ষণ আর খুনের ব্যাপারে রীতিমত সৃজনশীল হয়ে ওঠে সে। গোটাদশেক বড়ছোট মেয়েমানুষের রক্তের স্বাদ গ্রহণ করে সে।
তবে শহরে ধর্ষণ আর খুন একরকম নিয়মতান্ত্রিক একটা ব্যাপার তখন। সবাই ধর্ষণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর ঘটনার ঘনঘটার মাত্রাতিরিক্ততায় কোন মৃত্যুই আর মানুষকে নাড়া দিতে পারে না সেভাবে।
তবে ঘুঘু বারবার ধান খেলেও একদিন পড়ে তবু ফাঁদে। হারুন মুন্সির নতুন কন্সট্রাকশনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভরদুপুরে সেলিনাকে দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে রফিকের।
নির্মাণাধীন বিল্ডিঙের ভেতরে ময়লার বালতি হাতে নিয়ে হেটে যায় সেলিনা। আর একটা থান ইট হাতে নিয়ে যায় রফিক। প্রাথমিক আঘাতটার পরে অজ্ঞান সেলিনার নগ্নদেহ দেখে শরীর ঘিনঘিনিয়ে ওঠে ওর। তবু প্রবৃত্তির জোরে দ্বিতীয় ধাপের কাজটাও সেরে ফেলে। তবে শেষমেশ শ্বাসরোধ করতে গিয়ে সেলিনা যখন ওর দিকে দমফাটা আকুতি নিয়ে তাকায়, রফিক সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় সেলিনার মুখে। তারপর বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। সেলিনা নিজের গলা ধরে যন্ত্রণায় হাঁপাতে থাকে।
সেদিন রাতে বস্তির চারপাশে পুলিশের গাড়িতে গাড়িতে ছেয়ে যায়। চারিদিকে বেজে ওঠে সাইরেন। বস্তির এককোণের ঘরটার দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই বিশ্রী একটা গন্ধের ঝাপটা এসে লাগে। দেখা যায়, রফিকের মৃতদেহ ঝুলে আছে টিনের চালের সিলিং এর সাথে।
























