নিতির গল্প

উপন্যাস ৯

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২০

মা ফোন রাখার পর নিতি কিছুক্ষণ মৌন থাকল। নিজের কাছে নিজের কিছু জবাবদিহিতা থাকে। মানুষের ভেতরের আমি, এই বাইরের আমিকে প্রশ্ন করে। তখন শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ক্রমে সে দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে প্রবল ঝড় তোলে। সে ঝড় থামে অশ্রুবারি বর্ষণে। মনের মেঘ অশ্রু হয়ে ঝরলে মনের আকাশে আলো আসে। সে আলো বয়ে আনে একরাশ শান্তি।

অনেকক্ষণ ধরে চোখের জল ঝরার পর নিতির মনটা হালকা হলো। মোবাইলটা পাশেই রেখেছিল। সেটা তুলে নিয়ে নেট চালু করল। ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ চেক করে ফেসবুকে ঢুকল। কিছুক্ষণ এর ওর পেজে লাইক কমেন্ট করে নোটিফিকেশন চেক করতে এলো। দীপ তাকে একটা স্টাটাস ট্যাগ করেছে। দীপ বরাবরই ট্যাগ করে। এটা নতুন কিছু নয়। সুতরাং ট্যাগিং নিয়ে নিতির মনে নতুন কোনও প্রশ্ন এলো না।

নিতি বিস্মিত হলো লেখাটা পড়তে যেয়ে। যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছে দীপ। এমন সাহসী স্টাটাস সে এর আগে দেখেনি। দীপ এতটা বোল্ডলি কিছু বলে না। নিতি অবাক হলো। তার মনে প্রশ্নের উদয় হলো, তবে কি যৌনতা নিয়ে দীপ এমনটাই বিশ্বাস করে, না তাকে সে কিছু বোঝাতে চাচ্ছে। নিতির মন দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত সাপোর্ট করল। নিতি ধরে নিল, এখানে এসে এমন একা একা থাকার কারণে দীপ নিতির উপর চটেছে। সরাসরি কিছু না বলে স্টাটাস দিয়ে বলছে।

নিতি একাধিকবার পোস্টটি পড়ল। এরপর নিজে একটি পোস্ট দিতে মোবাইলে লিখতে শুরু করল—

মানুষের যৌনতা শরীরবৃত্তীয় একটা ব্যপার। এটা সত্য। তবে এটার ব্যবহরের একটা সীমারেখা আছে। এর কিছু বেপরোয়া ব্যবহারে আমাদের সমাজের একদল মেয়েকে আমরা পতিতা করে রেখেছি। যদিও পতিতা শব্দটি ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। কেউ পতিতা হতে পারে না। কারো দেহ দূষিতও হতে পারে না। আর দশটি খেটে খাওয়া মানুষের মতো তারাও পরিশ্রমী। কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা দিনাতিপাত করে। সমাজের পতিত মস্তিষ্ক ওদের কাছে যায় এবং সেই অনুর্বর মস্তিষ্কই সেখান থেকে ফিরে এসে ওদেরকে পতিতা বলে।

আমার তো মনে হয়, সেক্স ওয়ার্কারদের যে পতিতা বা বেশ্যা বলে সে মানসিকভাবে নিকৃষ্ট মনের। সেক্স ওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পেশা। যদিও এখানে উদ্ধত যৌনতার বল্গাহীন চর্চা হয়, তবুও এটাকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। চরিত্রহীন বলারও কিছু নেই। চরিত্র শারীরিক ব্যাপার নয়। চরিত্র মানসিক। আমাদের সমাজে এমন অনেক চরিত্রহীন মানুষ আছে, যারা বহুগামী নয়। আবার অনেক চরিত্রবান মানুষ আছে যারা বহুগামী। আমরা কি তেমনটা দেখিনি?

চরিত্র যদি এনাটমিতে আটকে থাকত, তাহলে যত অপরাধ সব ব্রথেলেই সংগঠিত হতো। ঘুষ-দুর্নীতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতো। পৃথিবী নিঃকলঙ্ক হতো। অথচ আশ্চর্যের ব্যপার এর থেকে ঢের বেশি অপরাধ হয় তথাকথিত সভ্য সমাজে।

পরিস্থিতির স্বীকারে হোক বা স্বেচ্ছায় হোক, মানুষের অধিকার আছে তার পছন্দ মতো পেশা বেছে নেবার। এখানে জোর জবরদস্ত না থাকলেই হলো। যদিও স্বেচ্ছায় যৌনাচার আজও আমাদের সমাজে বৈধ নয়। মানুষ বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচারকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে না।

কাউকে জোর করে কোনও কাজ করতে বাধ্য করাটাই অন্যায়। সেটাই দাসত্ব। সে অফিসের কাজ হোক, কলকারখানার কাজ হোক, মাঠ-ঘাটের কাজ হোক, চা বাগানের কুলির কাজ হোক কিংবা ব্রথেলের কাজই হোক। জবরদস্তি অন্যায়। স্বেচ্ছায় খুশি মনে কেউ কোন পেশা বেছে নিলে সেটা অন্যায় নয়। তারপরও যৌনতার পেশা প্রায় সব সমাজে নিন্দিত। এমনকি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও নিন্দিত। সর্বজন বা সর্বস্তরে আদরনীয় নয়।

তারপরও একজন সাধারণ মানুষের যে যে অধিকার আছে ব্রথেলের বা সেক্স ওয়ার্কারদেরও সেই সব অধিকার আছে। তাদের অধিকার খর্ব করাই চরিত্রহীনতা। অন্যায়। ব্রথেলগুলো তো আর এমনি চলে না। মুখোশধারী সমাজের প্রভুরাই সেটা চলতে সাহায্য করে। অর্থাৎ কিনা সেখানে যেয়ে সেটাকে চলমান রাখে। তবে ওই ওয়ার্কারদের দোষ কোথায়? দোষ নেই আবার তারা সমাজের চোখে আজও অস্পৃশ্য।

যদিও যৌনতা শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ যেমন চাল, ডাল, আলু, পেয়াজ কিনতে বাজারে যায়। ব্রথেলটাও তেমনি একটা বাজার। যৌনতার বাজার। সে বাজারের ক্রেতা আছে বলেই বিক্রেতা আছে। ক্রেতা শূন্য কোনও বাজার যেমন টিকে থাকে না, তেমনি সমাজের পাগুলো ব্রথেল অভিমুখে না গেলেও ব্রথেল টিকে থাকে না। একথা সত্য।

তারপরও কি আমরা পারছি আমাদের পিছিয়ে পড়া সেক্স ওয়ার্কারদের যোগ্য সম্মান দিতে। পারছি না। যদিও তারা দেশের একটি অংশ। সমাজের একটি অংশ। তাদেরকে ঘৃণা করার অধিকার যদিও কারো নেই। তবুও সমাজে তারা ঘৃণিত।

এখন প্রশ্ন হলো, কে সেক্স ওয়ার্কার আর কে না। কাকে সম্মান করব, আর কাকে করব না? জেনে রাখা জরুরি, যেমন সেক্স করলেই যে কেউ সেক্স ওয়ার্কার হয় না, তেমনি যৌনতা ব্রিক্রি করলেও সবাই সেক্স ওয়ার্কার হয় না। সমাজ বিচিত্র ও বহুমাত্রিক টানাপোড়েনে অভ্যস্থ।

যারা ঘোষণা দিয়ে এ পেশায় নামে, তারা প্রকৃত সেক্স ওয়ার্কার। তাদের সততা আছে। তারা তাদের পেশাকে সম্মান করে। সমাজকে অকারণে ভয় পায় না। সততা চরিত্রের মাপকাঠি। সুতরাং এরা নমস্য এবং সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তবুও এরা তা পায় না। আবার যারা ঘোষণা না দিয়ে নামে। যারা সমাজের ভয়ে ভীত। যারা নিজেদের পেশার পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক। যারা মুখোশের আড়ালে যৌনতা বিক্রি করে। তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেদেরকে ছোট করে এবং অন্যদেরকে ঠকায়। তারা সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়। নমস্য নয়। তারা প্রকৃত সেক্স ওয়ার্কার নয়। তাদের পরিচয় তারা প্রতারক। অথচ পরিচয় গোপন থাকার কারণে সমাজে এদের সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে।

যারা নিতান্ত বাধ্য না হয়, স্বজনের চোখে ধুলো দিয়ে, নিজের এই যৌন পেশাটা গোপনে চালিয়ে যায়। তারা সমাজকে কলুষিত করে। এ জাতীয় গোপনীয়তা বা অন্ধকারাচ্ছন্নতা মানুষকে অপরাধী করে তোলে। এরা ঘৃণার যোগ্য। কিন্তু এরা ঘৃণা পায় না, যতক্ষণ না এদের মুখোশ খুলে পড়ে। একই ভাবে আমরা যে সমাজে বাস করি, যে সমাজ হৃদয়ে ধারণ করি, সে সমাজে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা অবৈধ। এক্ষেত্রেও সমাজের মানুষ কোন ঘটনা প্রকাশ হবার পর খড়গহস্ত হয়। প্রকাশ না হলে তা সমাজের কিছু আসে যায় না। পূর্বেই বলেছি, ব্রথেলে সেক্স ওয়ার্কারদের কাজটা রাষ্ট্রীয় অাইনে বৈধ, কিন্তু সমাজের আইনে নয়। সমাজের অন্যত্রও সেটা নয়।

আমরা যদি সমাজের অন্যত্র বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তবে সমাজ কলুষিত হয়। পরিবার, স্বজন, সমাজ কেউ এটা মেনে নিতে পারে না। তাই এ জাতীয় সম্পর্ক চোরের মতো ঘটে থাকে। এতে সমাজ না জানলেও হৃদয় অপবিত্র হয়। আমাদের বাঙালি সমাজে সতীত্ব বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। আমরা বাঙালি মেয়েরা মনে প্রাণে সেটি বিশ্বাস করি। আমাদের বিশ্বাস আমরা অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়। এতেই সমাজের কল্যাণ, এতেই আমাদের মঙ্গল।

ব্রথেলের উদ্যাম যৌনতা হোক বা সমাজের মধ্যে কোনও নির্জন কক্ষে হোক, তাতে অবৈধ যৌনতা বৈধ হয়ে যায় না। মানসিক গ্লানিও কিছুতে কমে না। আমাদের উচিত নিজেদেরকে সংযত রাখা। সর্ব অবস্থায়, সর্ব পরিস্থিতিতে। এটা আমার মত, অন্য কেউ এ মতের সাথে একমত হতেও পারে, নাও পারে। তাতে আমার চিন্তার বদল হতে পারে না।

নিতি তার মন থেকে আসা এই বিচিত্র ভাবনার বহিঃপ্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট করতে উদ্যোগী হলো। চলবে

৪ মে ২০২০