নিতির গল্প

উপন্যাস ১১

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ০৭, ২০২০

মামা ফোন রাখার পর দীপও স্নানের জন্য ওয়াশরুমে গেল। স্নান সেরে বারান্দয় টাওয়েল শুকাতে দিল। এরপর কিছু না ভেবেই ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভিটা অন করল। এরই মধ্যে নিতিরও স্নান হয়ে গেছে। নিতি পোষাক পাল্টে, চুল পরিপাটি করে ড্রয়িং রুমে এলো। দীপ একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলের সংবাদ বুলেটিন দেখছে। নিতি দীপের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞেস করল, আজ কি খেতে চাও?

নিতির কণ্ঠস্বর শুনে দীপ সচকিত হলো। বলল, বসো। নিতি বলে উঠল, এখন বসলে চলবে না, দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কি রান্না করবো, বললে না তো? দীপ কয়েক মুহূর্ত ভাবল। এরপর বলে উঠল, ফ্রিজে খাসির মাংস রাখা আছে। চুই খাসি করতে পারো। নিতি দীপকে বলল, ঠিক আছে, চলো, মাংস বের করি।

দুজন উঠে মাংস বের করতে চলে গেল। ফ্রিজের কাছে দুজনের প্রায় গাঘেঁষা হয়ে দাঁড়াতে হলো। নিতির ভেজা চুলের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। দীপের শরীরটা কেমন কেমন করছে। নিতিকে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। নিতির ঠোঁট দুটি হিংস্র হয়ে কামড়ে চুষে রক্তাভ করে দিতে ইচ্ছে করছে। আরো অনেক কিছু, যা যা হয়। যা যা হতে পারে। কিন্তু কিছুই পারছে না। জোর করলে তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। সম্পর্ক ও সম্মান দুই-ই নষ্ট হয়। চুপ করে বসে থাকলে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। দীপের ঘোর লেগেছে, দীপ তবুও নিতিকে সহযোগিতা করল। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে জলে ভিজিয়ে রাখল। এরপর নিতি পেঁয়াজ কাটতে শুরু করলে, দীপ রসুনের খোসা ছাড়ানোর কাজে হাত দিল।

দীপ-নিতির এই স্বেচ্ছা গৃহবন্দি জীবন যখন নিতান্ত নিরস, নিতান্ত অনুত্তেজক ভঙ্গিতে অতিবাহিত হচ্ছে, তখন যশোর, মাগুরা ও দীপের মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি তিনটি ঘটনা ঘটে চলেছে।

বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা। যশোরে একটা গানের অনুষ্ঠানে আয়ানের সাথে রাখির পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। রাখির বেস্ট ফ্রেন্ড মিলির দূরসম্পর্কের কাজিন আয়ান। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, টল ফিগার আয়ানের উপস্থিত বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব ঈর্ষণীয়। যে কোনও মেয়ের পক্ষেই আয়ানকে এড়িয়ে যাওয়া দুরূহ। রাখির পক্ষেও সেটা সম্ভব হয়নি। ক্রমে মোবাইল, ম্যাসেঞ্জারে রাখি আয়ানের কথোপকথন বাড়তেই থাকল। একে অপরের বন্ধুত্বের সম্পর্কে নতুন নতুন মেরুকরণ হয়ে একপর্যায়ে তা গভীর প্রণয়ে পরিণত হলো।

অন্যদিকে মাগুরায় নিতিশ বাবুর স্কুলে শুরু হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। কিছুদিন আগে ক্লাসে পড়ানোর সময় তিনি কিছু একটা বলেছেন বা কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে যাতে ভেতরে ভেতরে কিছু ছাত্র-শিক্ষক নিতিশ বাবুর উপর ক্ষুব্ধ। গোপনে কয়েকটি মিটিং হয়ে গেছে। প্রধান শিক্ষকের কানে কথাটা তোলা হয়নি। তবে শীঘ্রই তোলা হবে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধর প্রতিনিধি। তাকেও জানানো হবে। তবে কাজটি যাতে পাকাপোক্ত হয় সেজন্য ক্ষুব্ধ ব্যক্তিবিশেষের ক্ষুদ্র দলটি ভেতরে ভেতরে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যপারে সোজা সরল মানুষ নিতিশ বাবু কিছুই জানেন না। তিনি সুমন বাবুর সাথে কথা হবার পর শান্তচিত্তে সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেন।

এদিকে অনেকদিন আগে দীপ হাইস্কুলে থাকার সময় একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত তার রেশ ছিল। কলেজে থাকতে এক স্কুল শিক্ষক ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। দেড় বছর পর কি এক অজানা কারণে ওদের ডিভোর্স হয়েছিল। আজ প্রায় তিনবছর পর মেয়েটি দীপকে ম্যাসেঞ্জারে নক করেছে। ছোট্ট করে লিখেছে, `কেমন আছো?`

এরই মধ্যে দীপের রসুনের খোস ছাড়ানো হয়ে গেছে। নিতি পরিমান মতো পেঁয়াজ কেটে, আদা বেটে, মাংস ধুয়ে রান্না চাপানোর পুরো প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে। নিতি বাড়িতে থাকতে মায়ের রান্নায় সহযোগিতার করত। মেসে, হোস্টেলে এসেও অনেকবার রান্না করেছে। রান্নাটা তার কাছে নতুন কিছু নয়। এমনকি রান্না করতে নিতির ভালোও লাগে। নিতি যখন চুলা জ্বেলে মাংস রান্নার পাত্রটি চুলার উপর তুলে দিল, তখন দীপ শসা, গাজর, লেবু, টমেটোর সালাদ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। দুজন মানুষ রান্নাঘরের দু`প্রান্তর বসে প্রায় নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে রান্নার আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় কথা দু`একটা হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ কথাই বলা হচ্ছে না। নিতান্ত মনের ভেতর থেকে ঠোঁটের কোনায় এসে আবার মনের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। এত নিরুত্তাপ জীবন বোধহয় নিতিও চায়নি। দীপতো চায়ই নি। চলবে

৬ মে ২০২০