
নিতির গল্প
উপন্যাস ১২
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : মে ০৮, ২০২০
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিতি ও দীপের রান্নার আয়োজন শেষ হয়ে এলো। দুজন পরম বন্ধুর মতো হাসিমুখে ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে এলো। এরপর বিস্তর হাসাহাসি, ঠাট্টা-তামাশা করে, রান্নার ভালোমন্দের দায় একে অপরের উপর চাপিয়ে খেতে বসল। দুষ্টুমির সময় রান্নার ভালোমন্দ নিয়ে হাজারটা কথা হলেও রান্না খারাপ হয়নি। বরাবরের মতো এবারও নিতির রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। দুজনে খাবার খেয়ে যারা যার রুমে চলে এলো। দীপ ঠিক করেছে, নিতি না ডাকলে ওর কাছে আর যাবে না।
দীপ ওর ঘরে যেয়ে দরজা বন্ধ করল। এসিটা চালিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিল। বেডে এলো। পাতলা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে বালিশে মাথা রাখল। স্মার্ট ফোন হাতেই ছিল। তাতে এয়ারফোন লাগিয়ে নিল। এয়ারবার্ডস দুটি কানে লাগিয়ে নেট অন করল। অপের মিনি ব্রাউজারের সার্স অপশনে গিয়ে টাইপ করল এক্সএনএক্সএক্স। এরপর দীপের চোখ স্মার্টফোনের স্কিনে আটকে থাকল। দীপ সমস্ত বাহ্যজগতের সব চিন্তা ভুলে ধ্যনস্ত হরো। মন দিল স্মার্টফোনের পর্দায়।
ওদিকে নিতিও এসে তার রুমের ছিটকিনি তুলে দিল। গল্পগুচ্ছ পড়া শুরু করেছিল। সে বইটিই টেনে নিল বেডে। জানালার পর্দা সরিয়ে আলো আসতে দিল ঘরে। পার্কের সবুজ গাছগুলো এ ঘর থেকে বড্ড মনোরম লাগে। সে গাছের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল, মানুষ বলো আর প্রকৃতি বলো, সর্বদা দ্বিচারিতা অবলম্বন করে। যখন কোনও বিষয় বিশেষ তার পক্ষে থাকে, তখন সে পঞ্চমুখে প্রশংসা করে। যখন বিষয় তার প্রতিকূল হয়ে যায়, তখন সেই একই বিষয়কে সে নিন্দা করে।
এখানে বস্তুর কোনও পরিবর্তন হয় না। শুধু বস্তু বিশেষের অবস্থানগত পরিবর্তন হয় মাত্র। যেমন বসন্তকালে যে প্রকৃতিকে বড় মনোরম মনে হয়, শীতকালে তাকেই আবার রুক্ষ-শুষ্ক মনে হয়। গ্রীষ্মে সেই প্রকৃতিকেই বড় কঠোর, বড় তপ্ত মনে হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃতি একই থাকে, শুধু তার অবস্থাগত পরিবর্তন হয় মাত্র। যেমন জল। কখনো তরল, কখনো কঠিন, কখনো বাষ্পীভূত হয়। তাতে জলের মৌলিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় না। সর্বঅবস্থাতেই জলে অক্সিজেন-হাইড্রোজেনের মিলিত রূপ থাকে। শুধু বাহ্যিক আকারের ও আচরণের পরিবর্তন হয় মাত্র। পারিপার্শ্বিক শীত-গ্রীষ্মের প্রভাবে জল শীতল বা উত্তপ্ত হয়ে যায়।
শীতকালে জল স্পর্শ করে কেউ যদি বলে জল ঠাণ্ডা জাতীয় বস্তু, আবার গরম কালে জল স্পর্শ করে কেউ যদি বলে জল গরম জাতীয় বস্তু, তবে কি তার বিচার ঠিক হবে? অথবা বিভিন্ন রঙ মিশে জল যখন বিভিন্ন রং ধারণ করে, বা বিভিন্ন রঙের পাত্রে রেখে জলের রং যখন বিভিন্ন হয়, তখন কি আমরা যার চোখে যে রং দেখব, জলের রং তাই ধরে নেব? না, সে সিদ্ধান্তে এলেও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যায় না।
অর্থাৎ কিনা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে আমরা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা যখন যা উপলব্ধি করি তাই শাশ্বত বা সত্য এটা আমরা বলতে পারি না। সত্য এত সহজে নির্ণয় করা যায় না। যে ব্যক্তি সুখী, স্বাস্থ্যবান, ধনী; যে ইচ্ছা করলেই অনেক কিছু সুখ প্রাপ্ত হতে পারে, তার কাছে পৃথিবী সুন্দর। পৃথিবীর রঙ, রূপ, গন্ধ বড় মনোহর। কিন্তু যে ব্যক্তি অনাহার ক্লিষ্ট, রোগে ভোগা, দরিদ্র, তার কাছে পৃথিবী তত মনোরম নয়। এখানে পৃথিবীর কোনও পরিবর্তন কিন্তু হচ্ছে না। শুধু ব্যক্তির চিন্তাধারা ও বিবেচনাবোধের তারতম্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে পৃথিবী ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিয়মান হচ্ছে।
অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি, স্বতসিদ্ধ বা যথাযথ বলে কিছু নেই। আমার কাছে যা সুখের, অন্যের কাছে তা দুঃখ উদ্রেককারী হতে পারে। আমার কাছে যা ভালো, অন্যের কাছে তা মন্দ হতেও পারে। সতত বিপরীতমুখী আচরণ করছে এই পৃথিবী। এর থেকে ক্ষুদ্র পতঙ্গ বা বনের বিহঙ্গ কেউই নিস্তার পাচ্ছে না। নিতি ভাবছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের `একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্পে` কীট যখন সুলভ ছিল প্রকৃতিতে, তখন কাঠঠোকরা ও কাদাখোঁচা পাখির কাছে পৃথিবী বড় মনোরম ছিল। পৃথিবীর যশকীর্তন করে বেড়াত তারা। যখন পৃথিবীর কীট কোনও এক দৈববলে দুর্লভ হয়ে গেল, তখন তারাই পঞ্চমুখে পৃথিবীর দুনার্ম করে বেড়াতে থাকল। অরণ্য ও নদীর উপর তাদের বিদ্বেষবিষ বর্ষিত হতে থাকল।
এই দুই বিহঙ্গের দ্বিমুখী আচরণ তাদের সুবিধা ও অসুবিধার করণে বা প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির কারণে। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। যখন আপনার কাছ থেকে কেউ প্রভূত উপকার পাবে, সাহায্য সহযোগিতা পাবে, তখন আপনি তার কাছে দেবতার আসন গ্রহণ করবেন। আবার যখন আপনি নিজের দীনতা, দুর্ভাগ্য বা অন্য কোনও কারণে সেই একই ব্যক্তিকে সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হবেন। তখন আপনি তার কাছে আর দেবতার আসন পাবেন না। এমনকি কল্পনায় আপনাকে দানবে রূপান্তরিত করতেও তার বাধবে না। পঞ্চমুখে সেই পুরাতন উপকারভোগী ব্যক্তিটিই সমাজে আপনার নিন্দা করে বেড়াবে।
এখন প্রশ্ন হলো এরকম কেন হয়? উত্তর হলো দুর্বলের দুর্বলতার কারণেই এমনটি হয়। মরলে ঐ দুই দুর্বল, ক্ষুদ্র পাখিই মরে। নদী বা অরণ্য নয়। নিতি ভাবছে, আমি নারী। এ সমাজে নারীদের অধিকার যাই থাকনা কেন, সে দুর্বল। প্রকৃতিই তাকে নানাভাবে দূর্বল ও বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। আবার, যে দান করে তার কখনো ক্ষতি হয় না, বরং যে গ্রহণ করে ক্রমে সেই ঋণী হয়ে পড়ে। পুরুষ বীর্য দান করে স্ত্রীর গর্ভে। পুরুষ হয়ে ওঠে বীর্যবান। বীর। নিতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখায় পড়েছিল, `পুরুষের দশ মিনিটের সুখ, নারীর দশ মাসের অসুখ।` নিতির মনে হতে থাকল, দীপ যা চাচ্ছে তাতে দীপের কোনও ক্ষতি হবে না। তাকে কেউ অসৎ বলবে না কিন্তু সমাজে সে অসতি হয়ে যাবে।
যেমন জগতে সূর্যের কোনও ক্ষোভ নেই। কারণ সে অনন্ত আলো ও তাপের উৎস। প্রদীপের ক্ষোভ থাকে, কারণ তেলের উপরে তার নির্ভর করতে হয়। নির্ভরশীল ব্যক্তি পরিবর্তিত পরিস্থিতির স্বীকার। তার কাছে প্রকৃতি পরিবর্তনশীল মনে হয়। আসলে প্রকৃতি একই রকম থাকে। শুধু রূপবদলায় মাত্র। নিতি ভাবছে, মেয়েরা প্রদীপের মতো। সমাজে আলো ছড়ালেও, সমাজ নামক জগদ্দল পাথরের উপর তাদের ভালোমন্দ নির্ভর করে।
নিতি গল্পগুচ্ছ পড়তে পড়তে যখন এসব ভাবছে, তখন নিতিদের গ্রামের বাড়ি একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। নাম রাধা। নিতির বাবার স্কুলে পড়ে মেয়েটি। নিতিশ বাবুর কাছে এসেছে। রাধা যখন নিতিশ বাবুর খোঁজে তার বাড়িতে এল, তখন নিশিত বাবু খাচ্ছেন। স্কুল থেকে ফিরে, স্নানাহার করে, তিনি কিছু ছাত্র পড়ান। রাধা তাদেরই একজন। আজ অবশ্য পড়তে আসেনি। তবে কেন আসল?
নিতিশ বাবু রাধাকে বসতে বলে হাত ধুয়ে ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাধা স্যারকে দেখে হাত তুলে প্রণাম জানাল। এরপর সসংকোচে অপরাধির মতো বলল, স্যার কাল ফরমফিলাপের শেষ দিন, কিন্তু আমি এখনো টাকা যোগার করতে পারিনি। চলবে
৭ মে ২০২০