নুরুল ইসলাম মানিকের প্রবন্ধ ‘মহাবিশ্বের সূচনা’
পুনর্মুদ্রণ
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৫, ২০২৩
পৃথিবীর জন্ম কীভাবে হয়েছে তা জানতে আমাদেরকে চলে যেতে হবে পৃথিবী ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে। যেতে হবে সেখানে, সেখান থেকে প্রথম মহাবিশ্বের সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল। কারণ সৃষ্টিজগরে সবকিছু একই সূত্রে গাঁথা, একই উৎস থেকে সৃষ্ট।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, সৃষ্টির আদিপর্বের যেহেতু কেউ সাক্ষি নেই, কাজেই বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে যা কিছু বলেন, এর সবটাই ‘মতবাদ’। মতবাদ স্বতঃসিদ্ধ হতে পারে, আবার নাও পারে। দেখা যাবে, একটা শক্তিশালী এবং আরও গ্রহণযোগ্য মতবাদ আবিষ্কার হওয়ার ফলে আগের মতবাদটা বাতিল হয়ে গেছে। এভাবেই বিজ্ঞানের সূত্র এগিয়ে চলে।
মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে এপর্যন্ত যতগুলো মতবাদ জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে এরমধ্যে মহাবিস্ফোরণ মতবাদ তত্ত্বটি অন্যতম। এ মতবাদের প্রথম প্রবক্তা হলেন বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জেস লিম্যাট্রি। তিনি ১৯৩১ সালে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে তার এ মতবাদ প্রকাশ করেন। পরে আমেরিকার বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো ১৯৪৬ সালে এ মতবাদটি বিশদ ব্যাখ্যা করে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত জয় করে নেন। তাদের এ মতবাদ অনুযায়ী মহাবিশ্বের সূচনার আগে অনন্ত শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এরপর এক অদৃশ্য নিয়মে মহাশূন্যের ভেতর সৃষ্টি হয় একটি বৃহৎ পরমাণু বা সুপার অ্যাটম। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন আদিম অগ্নিগোলক। এ গোলকে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু অতি উত্তপ্ত, অতি উজ্জ্বল ও অতি ঘন অবস্থায় জমাট বেঁধে ছিল। বিজ্ঞানীরা বলেন, আজ থেকে প্রায় ১৫-২০ বিলিয়ন বা ১৫০০ থেকে ২০০০ কোটি বছর আগে সেই আদি অগ্নিগোলকে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। তারা এর নাম দিয়েছেন আদি মহাবিস্ফোরণ।
বিজ্ঞানীরা বলেন, আদি মহাবিস্ফোরণের ফলে সূক্ষ্মতম কেন্দ্র থেকে বস্তুপিণ্ড মহাশূন্যের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই আদি বিস্ফোরণের এক সেকেন্ডের একশো ভাগ সময় পার হলে বিস্ফোরণ কেন্দ্রের তাপমাত্রা উঠে দাঁড়ায় কয়েখ হাজার কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এর মিনিট তিনেক পরে তামপমাত্রা নেমে আসে একশো কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। আদি মহাবিস্ফোরণের প্রথম মুহূর্তে যে মহাজাগতিক রশ্মি সৃষ্টি হয়েছিল, মিনিট তিনেক পরে তাপমাত্রা এক কোটিতে নেমে আসার সাথে সাথেই মহাজাগতিক রশ্নিপুঞ্জ থেকে জন্ম নেয় পরমাণুর ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। আর এই পরমানু একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হয় মৌলিক পদার্থের অণু। এসব মৌলিক পদার্থ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ছায়াপথ, নীহারিকা, নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ, আগুন, পানি, বাতাস সবকিছু।
মহাবিস্ফোরণে সেই যে একটি ক্ষুদ্র কেন্দ্র থেকে বস্তুপুঞ্জ বাইরের দিকে যাত্রা আরম্ভ করেছিল, সে গতি আজও থেমে নেই। মহাবিশ্ব কেবল দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। দিনে দিনে সৃষ্টি হয়ে চলেছে নতুন নতুন ছায়াপথ, নীহারিকা, নক্ষত্র, ধূমকেতু ইত্যদি। মহাবিশ্বের সবকিছু দল বেঁধে দ্রুত ছুটে চলেছে বাইরের দিকে।
এভাবে আমাদের সৌরজগৎও সৃষ্টির পর থেকে বিরামহীনভাবে প্রতি ঘণ্টায় ৬৬ হাজার ছ’শো মাইল বা এক লাখ সাত হাজার একশো সত্তুর কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। যেহেতু আমাদের পৃথিবী সৌরজগতেরই একটি অংশ, তাই পৃথিবীও একই গতিতে সৌরজগতের সাথে ছুটে চলেছে। মহাবিশ্বের এ অনন্ত যাত্রা কোথায় শেষ হবে তা কেউ জানে না। কেউ জানে না আল্লাহর সৃষ্টি জগতের শেষ কোথায়।
সৃষ্টি সম্পর্ক পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করতে চান, তখন তিনি বলেন, ‘হও’, আর অমনি হয়ে যায়। তিনি কোনো কিছু সৃষ্টি করতে চাইলে তার আদেশই যথেষ্ট। সৃষ্টিতে তাঁর কোনো আয়োজন বা উপায়-উপকরণের প্রয়োজন হয় না।
একদিন মহাশূন্যের অসীম আঁধার থেকে আল্লাহর অমোঘ নির্দেশ- ‘হও’ বলার সাথে সাথে সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তাকে যতদিন তিনি থেমে না যাওয়ার নির্দেশ দেবেন, ততদিন মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়ে চলবে, আল্লাহর বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী।
‘হও’ বলার সাথে সাথে সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার যে তথ্যটি আল্লাহ আমাদের পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে জানিয়েছেন, এর সাথে হুবহু মিল রয়েছে বিজ্ঞানের তত্ত্ব- মহাবিস্ফোরণবাদের।
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনিই একমাত্র অনাদি ও অনন্ত। তিনিই এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে, সূচনার পর থেকে বিরামহীনভাবে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। নতুন নতুন ছায়াপথ, গ্রহ-নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে। নিয়মের বাইরে যাবার উপায় কারো নেই। সবাই মহাবিশ্বের সড়ক-সরণি দিয়ে যার তার পথ ধরে ছুটে চলেছে, দূরে বহু দূরে- অসীম অজানার পথে। আবার একই নিয়মে চাঁদ-তারা, গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ নিজেদের কক্ষপথেও ছুটে চলেছে বিরামহীনভাবে।
ইসলামিক ফাইন্ডেশন প্রকাশিত নুরুল ইসলাম মানিক রচিত ‘আমাদের এই পৃথিবী’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো