
নেতাজির রাষ্ট্রভাবনা ও বর্তমান ভারত
পর্ব ৫
ড. জয়ন্ত চৌধুরিপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৮
বৃটিশের ভারত ত্যাগ নেতাজির জন্যই
তেষট্টি দিন লাহোরের বৃটিশ জেলে একটানা অনশনে শহিদ হন বাংলার বিপ্লবীকুলের নয়নমণি সুভাষচন্দ্রের হাতে গড়া বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মেজর যতিন দাস। ভারতদধিচি শহিদ যতিন দাসের মরদেহের ছবি দেখলেই বোঝা যাবে কোনো চমক সৃষ্টি কিংবা ব্রিটিশ মিডিয়ার প্রচারণা পাবার লক্ষ্যে গান্ধিবাদী পথে তার আমরণ অনশন কয়েক বেলার শরীরচর্চার অনুষঙ্গ ছিল না। সুভাষ সুহৃদ শহিদ যতিনের মুখে সেদিন ছিল তীব্র দেশভক্তির আকুতি। ছিল ছলনাহীন বৈপ্লবিক চেতনার ঋষিতুল্য প্রজ্ঞার প্রকাশ। যা কোনো সাবরমতিপন্থী জাতীয় নেতার পক্ষে দর্শনের সাহস ছিল না। রবীন্দ্র-নজরুলের হৃদয়মথিত বেদনা, পাঞ্জাব থেকে বাংলার ঘরে ঘরে যে অগ্নি শপথের শিখা জ্বলে উঠেছিল, তার প্রতি সামান্যতম সৌজন্যের প্রকাশ ঘটেনি সেদিনের অহিংসার নামাবলির আবরণে থাকা ‘সন্ত’ নেতাদের আচরণে।
‘হরিজন’ পত্রিকায় একলাইনের কোনো শোকগাথাও লেখা হয়নি প্রকৃত অহিংস পথে শহিদ হওয়া বাংলার ২৫ বছরের তরুণ যতিন দাসের জন্য। ইতিহাস এর উত্তর দিয়েছে। বৃটিশের ভারত ত্যাগের একমাত্র এবং শুধুমাত্র কারণ ছিল সুভাষচন্দ্র বসু ও তার আজাদ হিন্দের বৈপ্লবিক আন্দোলন। দ্রুত ভারত ভাগের নেপথ্যে কারণ ছিল, অহিংস ভেকধারী পণ্ডিত শিষ্যদের বৃটিশভজনার নৈবেদ্য ও দক্ষিণা দান এবং গ্রহণের তাড়না। সময়ের নিয়মেই ইতিহাসের নানা সত্য নানা দিক থেকে ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে এবং মহাসত্য গোপনের পথে আজও চলছে মহাফেজখানার নথি ধংসের প্রয়াস। আপসহীন সংগ্রামের নজিরবিহীন দৃঢ় আদর্শের প্রশ্নে যে দল থেকে সুভাষচন্দ্র বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন, তাদের স্তাবক বুদ্ধিজীবি, ইতিহাস লেখক নানা পদে আসীন প্রাসাদপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের লেখনি ও কণ্ঠে দিনের পর দিন লিপিবদ্ধ এবং উচ্চারিত হয়েছে ‘অহিংস ম্যাজিকে’ স্বাধীনতা প্রাপ্তির রূপকথার গল্প। ফাঁসির মঞ্চ থেকে কারাগারের কুঠুরিতে বৃটিশের নির্মম অত্যাচার ও আত্মত্যাগের কাহিনি গুরুত্ব পায়নি বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে।
বৃটিশ কমনওয়েলথ ক্লাবের সদস্যভুক্তির কৃতজ্ঞতায় মুছে দেয়ার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলেছে আজাদি সেনা-শহিদকুলের স্মৃতিধন্য সমস্ত কিছুই। প্রায় ৭০ বছর ধরে পরিবারতন্ত্রের এবং প্রচারপ্রিয় দলতন্ত্রবাদীদের দাপাদাপিতে শহিদকুলের স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন সাধনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। শেকড়ে পচন ধরলে বিশাল বৃক্ষও দুর্বল হয়ে যায়। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়কে শক্তিশালী করতে মিথ্যাময় স্বাধীনতা প্রাপ্তির অহিংস অসহযোগের মিথ ভেঙে ফেলা প্রয়োজন। প্রয়োজন সেদিনের অহিংসার মুখোশে ঢাকা গোপন সহযোগিদের প্রকৃত স্বরূপ সত্যের আলোকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা। সরকারি স্তরে নেতাজি নির্বাসনের কৌশলী প্রয়াস বন্ধ হওয়া জরুরি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো পণ্ডিতপ্রবর বসন্ত দূত, লৌহ মানব, মহাত্মাদের প্রতি আস্থা রাখেননি। জীবন সায়াহ্নে তিনি স্বাধীনতার অগ্রদূত, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং গীতাবর্ণিত ত্রাতার ভূমিকায় দেশবাসীকে বরণ করে নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন তার সুভাষকে ‘দেশনায়ক’ নিবন্ধের মাধ্যমে।
শান্তিনিকেতনে সুভাষচন্দ্রের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন কবিগুরু। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বিশ্বকবি তার শেষ জন্মদিনের অভিভাষণে সভ্যতার সঙ্কট প্রসঙ্গে উপসংহারে বলেছিলেন, ‘আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের এবং প্রবাসী ভারতীয়দের সক্রিয় সহযোগিতায় মণিপুর, নাগাল্যান্ড দিয়ে আজাদ হিন্দদের মাতৃমুক্তির সংগ্রাম সবদিক দিয়েই অনন্য।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দদের মরণপণ লড়াই বিশ্বের যুদ্ধ ইতিহাসের তালিকায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটিশ কলোনি গুটিয়ে নেবার দ্রুত ঘটনাও ঘটে ভারতের পূর্ব সীমান্তে আজাদ হিন্দের রক্তাক্ত সংগ্রাম ও সাফল্যের পরে। নেতাজির আজাদি লড়াইয়ের তথ্য ভারতবাসীর কাছে যথাসাধ্য গোপন রাখার চেষ্টা করে তৎকালীন বৃটিশ ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল কমিউনিস্ট-কংগ্রেস কিছু নেতা। যদিও সেই সময় স্তালিনের কমিউনিস্ট শাসিক সোভিয়েত রাশিয়া আজাদ হিন্দ সরকারের দূতাবাস সে দেশে খোলার ব্যবস্থা করেছিল। কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দলের কিছু নেতা বিক্ষিপ্তভাবে নেতাজি ও আজাদ হিন্দের প্রতি তাদের অন্যায় ও অন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য ভুল ও দুঃখ প্রকাশ করলেও দলগুলি সরকারিভাবে তাদের দলীয় নথিতে সে তথ্য লিপিবদ্ধ করেনি আজও।
ভারতে যুদ্ধোত্তর অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি মূল কারণই ছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ সেনা নায়কদের বিচারপর্ব। সত্য ক্রমশ প্রকাশ হয়ে যায় লালকেল্লায় ঐতিহাসিক বিচার চলাকালে। চারদিকে বিক্ষোভ-বিদ্রোহের পরিস্থিতি দেখে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তারা আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে আছেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৯৪৩ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবু কেন বৃটিশের ভারত ত্যাগের ঘটনা ঘটল? এপ্রসঙ্গে তথাকথিত অহিংসার ফেরিদার তামাম বুদ্ধিজীবীকুল নীরব থাকেন। ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার আত্মজীবনী ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ বইতে লিখেছেন, ‘এ সম্পর্কে বৃটিশ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন অস্থায়ী রাজ্যপাল ও কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ফনীভূষণ চক্রবর্তীর আলোচনা ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পশ্চাৎপট সম্পর্কে আলোকপাত করবে। ১৯৫৬ সালে ফনীভূষণ চক্রবর্তী যখন পশ্চিম বাংলার অস্থায়ী রাজ্যপাল, তখন লর্ড অ্যাটলি ভারতে আসেন এবং কলকাতার রাজভবনে দুদিন অবস্থান করেন। তখন শ্রীচক্রবর্তীও সঙ্গে ইংরেজ ভারতে থেকে চলে যাবার প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে লর্ড অ্যাটলির দীর্ঘ আলোচনা হয়।
শ্রীচক্রবর্তী অ্যাটলিকে প্রশ্ন করেন, গান্ধীর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন তো ১৯৪৭ সালের বহু পূর্বেই মিলাইয়া গিয়াছিল, ১৯৪৭ সালে এমন কোনো পরিস্থিতি বর্তমান ছিল না যাহার জন্য ইংরেজদের তাড়াহুড়া করিয়া এদেশ ছাড়িয়া যাইবার প্রয়োজন ঘটিয়াছিল। তবে তাহারা গেল কেন? উত্তরে অ্যাটলি কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে প্রধান ছিল, নেতাজি সুভাস বসু কর্তৃক ভারতের স্থলবাহিনী এবং নৌবাহিনীযুক্ত দেশীয় সেনানীদের ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তি শিথিল করে দেয়া। ফনিভূষণ চক্রবর্তীকে উদ্ধৃত করে রমেশ চন্দ্র লিখেছেন, আলোচনার শেষের দিকে আমি ফনিভূষণবাবু অ্যাটলিতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইংরেজদের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্তে গান্ধীর কার্যকলাপের প্রভাব কতটা ছিল? এ প্রশ্ন শুনিবার পর অ্যাটলির ওষ্ঠদ্বয় একটা অবজ্ঞাসূচক হাস্যে বিস্তৃত হইল এবং তিনি চিবাইয়া চিবাইয়া বলিলেন, ‘মিনি-ম্যাল’। লর্ড অ্যাটিল সঙ্গে আমার ওই আলাপের কথা আমি নেতাজিভবনে এক বক্তৃতায় সবিস্তারে বলেছিলাম। অল ইন্ডিয়া রেডিও সেই বক্তৃতার বিবরণ সম্প্রচার করেছিল। কিন্তু অ্যাটলির নেতাজি সম্পর্কিত কথাগুলো বাদ দিয়ে। স্বাধীন ভারত সরকার প্রকৃত সত্য সম্প্রচারে ভৃত্যসুলভ মানসিকতা প্রকাশ করলেও খোদ ব্রিটিশ কর্নেল ইউটয় তার ‘স্প্রিংগিং টাইগার’ বইতে অকপটে লিখেছেন, ‘সামান্যতম সন্দেহ নেই যে, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ভারতে ব্রিটিশ শাসন দ্রুত শেষ করিয়ে দিয়েছে।’
চলবে...
লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর ডক্টরেট, নেতাজি সম্পর্কিত অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক, আলিপুর বার্তা, কলকাতা