
নেতাজির রাষ্ট্রভাবনা ও বর্তমান ভারত
শেষ পর্ব
ড. জয়ন্ত চৌধুরিপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৮
কই সত্যের প্রতিধ্বনি হয়েছে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মাইকেল অ্যাডওয়ার্ডের লেখা ‘দ্য লাস্ট ইয়ারস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ বইতে। তিনি লিখেছেন, ‘হিংসা দানকারী গান্ধীকে ব্রিটিশ ভয় পায় না। এমনকি নেহেরুর রাজনীতিকেও ব্রিটিশ ভয় পায়নি। ব্রিটিশ ভয় পেয়েছে সুভাষ বোসের হিংসাত্মক কর্মসূচিকে, যা ব্রিটিশ শাসনের মেরুদণ্ড দুর্বল করেছে। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতিও তারা আস্থা হারিয়েছিল। সুভাষ বোসের ভূত, হ্যামলেটের বাবার মতোই লালকেল্লার প্রাকারে বৃহৎ ছায়ামূর্তি হয়ে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। নেতাজি বোসের কাছে ভারত যতটা ঋণী আর কারো কাছে নয়। যদিও তিনি আপাত ব্যর্থ হয়েছিলেন।’
ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো, নেতাজির প্রকৃত মূল্যায়ন করতে সেদিনের মতোই আজকের কিছু বামপন্থী ও কংগ্রেস নেতৃত্ব ব্যর্থ। নেতাজি বিরোধিতায় তারা ব্রিটিশকেও টেক্কা দিয়েছে। আজও বহু বামপন্থী দাবিদার সংগঠনের নেতাকর্মীদের মনে সেদিনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতি নিষ্করুণ অবজ্ঞার ছায়া প্রলম্বিত হয়েছে। হিটলারের সঙ্গে করমর্দনের ছবিটিকেই জিইয়ে রাখা হয়েছে কৌশলে। শুধু তাত্ত্বিক নয়, জীবনবাজি রেখে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে গেরিলা লড়াইয়ের নজির বিশ্বের বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহানে নেই। চে, কাস্ত্রো ও লেলিনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, বাংলার দামাল ছেলে বিপ্লবী সুভাসচন্দ্রের চেতনার মধ্যে ছিল এক বিরল মেধা-মনীষার সমন্বয়, মানবিক হৃদয়ের সঙ্গে যুক্তি, বিজ্ঞানের যোগ। স্বাধীনতার জন্য, আপোসহীন সংগ্রামের জন্য কোনোদিন কোনো ভণ্ডামি, শঠতাকে প্রশ্রয় দেননি। তার দেশপ্রেমে কোনো খাদ ছিল না। ছিল না ক্ষমতা দখলের একনায়কসুলভ মানসিকতা।
অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ সরকার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে গঠিত ও স্বীকৃত। অস্থায়ী সরকার ভারতের পূর্ণ মুক্তির পর নেতাজি চেয়েছিলেন গান্ধীজী, নেহেরু কিংবা মৌলানা আজাদের মতো জাতীয় নেতৃত্বকে বেছে নেবার গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে ব্রিটিশ মুক্ত ভারতবাসীর। তাই আজাদ হিন্দ সরকারের বাঘ্র চিহ্নিত ত্রিবর্ণ পতাকা সত্ত্বেও ভারতের অধিকৃত জমিতে প্রশাসনের ক্ষেত্রেও আজাদি নেতারা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের চরকাশোভিত ত্রিবর্ণ পতাকা তুলেছিলেন। আজাদ হিন্দের দখলে আসা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ দুটির নামরকণ করেন শহিদ দ্বীপ ও স্বরাজ দ্বীপ। সেখানেও উঠেছিল চরকাশোভিত ত্রিবর্ণ পতাকা।
ইউরোপ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে, বেতারের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ভাষায় কবিগুরুর ‘জনগণমন’ হিন্দুস্থানি তর্জমায় বেজেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে তাকে আগামী দিনের স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান বলে সম্মোধন করা হলে দাঁড়িয়ে উঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ব্রিটিশমুক্ত ভারতের জনগণ। তাদের যোগ্য নেতা ও সরকার নির্বাচন করবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজাদ হিন্দের রাষ্ট্রপ্রধান অজ্ঞাত যাত্রার প্রাক্কালে প্রবাসী ভারতীয়দের দেয়া কোটি কোটি টাকার ধনরত্ন রেখে গিয়েছিলেন আগামী দিনে আজাদ জওয়ানদের স্বাধীন ভারতে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে। তার আগে জাপান সরকারের অর্থিক ঋণশোধ করেছিলেন আজাদ হিন্দদের রাষ্ট্রপ্রধান। খণ্ডিত ভারতের ক্ষমতাপ্রিয় কিছু জাতীয় নেতৃত্বের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি আজাদ হিন্দের বন্দিশিবিরে রাতের অন্ধকারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার আজাদি জোয়ানদের হত্যা করল। ফাঁসি দিলো গোপনে। তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা মৌন থাকলেন।
দেশবাসীকে সত্য জানতে দেয়া হলো না। নীলগঞ্জ ও ঝিকরগাছা বন্দি শিবিরে হাজার হাজার নিরস্ত্র সেনা হত্যার প্রামাণ্য ফাইলপত্র চাপা আছে আজও। কিন্তু কেন ব্রিটিশ বর্বরতার কাহিনি প্রকাশ হলো না, তা বিস্ময়কর। ব্রিটিশ কমনওয়েলথকে মান্যতা দেবার কারণেই কি আমাদের বীর শহিদদের মুছে দেয়া হলো? জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়ের ভয়ঙ্কর আজদি সেনা হত্যার ঘটনায় সেদিন বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া দিয়ে কয়েকজনের মৃত্যুর কথা তুলে বর্হিবিশ্বে ব্রিটিশের মুখরক্ষা করেছিলেন।
খণ্ডিত স্বাধীন ভারতে আজাদ হিন্দের কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেল গোপনে। ভারতের ‘ঘোটালা’ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হলে এই আইএনএ কাণ্ড লুট তালিকায় শীর্ষে থাকত। খণ্ডিত ভারতের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশেই বোম্বাইয়ের প্রতিরক্ষা দপ্তর গোপন বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো প্রকাশ্য স্থানে, ক্যান্টিনে, ব্যারাকে নেতাজির ছবি টানানো যাবে না। স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনীতে কোনো আজাদি তরুণের চাকরি হয়নি সেদিন। দেশপ্রেমিক তারুণ্যের প্রতি এমন অপমান করেছিলেন ‘সংগ্রা ক্লান্ত’ ক্ষমতালিপ্সু বয়স্ক নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। গান্ধীজিও সেদিন তাদের কাছে ছিলেন ‘ব্রাত্য’।
আজাদ হিন্দ ঈপ্সিত পথে বিজয়ীর বেশে দিল্লিতে প্রবেশ করতে পারেনি। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি। এটাও আজ ঐতিহাসিক সত্য। ১৯৪৫ সালে মণিপুর ইস্ফল দখলের পরেও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে পিছু সরে যেতে হয়। আজাদ হিন্দ সরকারের দায়িত্ব জে এম কিয়ানির হাতে অপর্ণ করে নেতাজি যে বিশেষ বার্তা রেখে যান, প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতি ও সহযোদ্ধাদের জন্য, সেই দুটি নির্দেশনামায় সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘দুনিয়ার এমন কোনো শক্তি নেই যা ভারতবর্ষকে পদানত করে রাখতে পারে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই হবে। সেদিন দূরে নয়। জয়হিন্দ...।’ লেখার নিচে স্বাক্ষর করেছেন ১৫ আগস্ট ১৯৪৫। নেতাজির ভবিষ্যৎবাণী সফল হলো ঠিক দু’বছরের মাথায়, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে। নেতাজির সঠিক মূল্যায়ন সততার সঙ্গে রাষ্ট্র এবং স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলি অন্তত স্বীকার করুক তাদের সরকারি নথিতে। বিলম্বে হলেও সত্য প্রতিষ্ঠা হোক। তাহলে আগামী প্রজন্মের ভারতবাসীরা অন্তত এ প্রজন্মকে ক্ষমা করবে।
লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর ডক্টরেট, নেতাজি সম্পর্কিত অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক, আলিপুর বার্তা, কলকাতা