নেতাজীর রাষ্ট্রভাবনা ও বর্তমান ভারত

পর্ব ৪

ড. জয়ন্ত চৌধুরি

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৮

সম্প্রতি বিমান দুর্ঘটনা পরবর্তী কালের দুটি আলোকচিত্র ভিয়েতনাম মহাফেজখানা থেকে প্রাপ্ত, যেখানে ১৯৬৯ সালে প্যারিস পিস কনফারেন্সে ও ১৯৬৯ সালে বেজিং কনফারেন্সে বড় আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের মঞ্চে নেতাজীর চেহারায় মিল থাকা ব্যক্তিকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মুখার্জী কমিশন অগ্রাহ্য হওয়ার পর একটি তথ্যচিত্রে একদল সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহকের সামনে মনোজ মুখার্জী আপন বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে বলে গেলেন, সুভাষচন্দ্র রাশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন এবং উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসীর বেশে আত্মগোপন করেছিলেন। পরিচালক অম্লান কুসুম ঘোষের তথ্যচিত্র ‘দ্য ব্ল্যাকবক্স অব হিস্ট্রি’তে মনোজ মুখার্জী সাক্ষ্য দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি একশো শতাংশ নিশ্চিত যে, উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদের গুমনামী বাবা (ভগবানজি) নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন। ইন্টারনেটের সুবাদে সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার এখন সর্বত্রই ছড়িয়ে গেছে।

সত্য চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, তাই ভিন্ন ভিন্ন মৃত্যু তথ্য পরিবেশন করতে হচ্ছে বারবার। এলাবাদ হাইকোর্ট ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে নির্দেশ দেন গুমনামী বাবা (নাম না জানা সন্ন্যাসী) কে ছিলেন, তা জানিয়ে তিন মাসের মধ্যে কমিটি করে জমা রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এবং তার ঘর থেকে পাওয়া যাবতীয় সামগ্রী মিউজিয়াম গড়ে আধুনিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ফৈজাবাদের রামভবন থেকে অন্তর্হিত হন গুমনামী বাবা ওরফে ভগবানজী। সে সময় নেতাজীর ভ্রাতুপুত্রী সুরেশচন্দ্র বসুর কন্যা ললিতা বসু কোর্টে বলেছিলেন যে, তার রাঙাকাকাবাবুর বইপত্রসহ যাবতীয় সামগ্রী সরকার সংরক্ষণ করুন। মুখার্জী কমিশন পরবর্তীকালে নানা সত্য ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। দশ হাজার নেতাজী সংক্রান্ত গোপন নথি এখন মাত্র ২০টিতে এসে ঠেকেছে। বহু নথি হারিয়ে গেছে অথবা ধ্বংস করা হয়েছে বলে কেন্দ্র কমিশনকে জানিয়েছিল। তাইহোকু পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশে নেতাজি সক্রিয় থাকার নানা সংবাদ, মনোজ মুখার্জীর মুখে নেতাজির ভারত প্রত্যাবর্তনের স্বীকারোক্তিসহ প্রভৃতি বিষয়ের আলোকে আন্তর্জাতিক বিচারকদের নিয়ে ভারত সরকার নেতাজীর অন্তর্ধ্যান বিষয়ে তদন্ত করুক, এমর্মে একটি পিটিশন প্রতিভাদেবী প্যাটিলকে প্রতিবেদক পাঠিয়েছিলেন। প্রাপ্তি স্বীকার এবং কিছু দিনের মধ্যেই দপ্তরে সেই আর্জি গঠন হয়েছে বলে জানানো হয়।

সেখানে ভারত সরকার নেতাজী সম্পর্কে কখন কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা জানানো হলেও আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন তদন্তের ব্যাপারে হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাইি উচ্চারিত হয়নি।  আদেশ ছিল দিল্লি চলো। খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি সেদিন স্বীকার করেছিলেন, গান্ধীজির অহিংস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ১৯৪২ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাদের ভারত ত্যাগের অন্যতম কারণ সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ‘আজাদ হিন্দ’র ভারত অভিযান এবং পরবর্তীকালে ভারতের আজাদ হিন্দ সেনানীদের বিচারের জেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের আগুন তাদের আগ্নেয়গিরির চুড়ায় বসিয়ে দিয়েছিল। বিদেশি বহু গবেষক, ঐতিহাসিক ও রাজনীতিক দেশের স্বাধীনতার মূলে নেতাজীর নেতৃত্বে সর্বাত্মক ভারত অভিযানকে কৃতিত্ব ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবুও ভারতের শাসক সম্প্রদায় বরাবর বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন যে, অহিংস ম্যাজিকেই ভারত স্বাধীন হয়েছে। এ বার্তাটি শিশুপাঠ্য থেকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা তারা চালিয়েছিলেন এবং প্রায় সফলও হন।

ভারত কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ সরকারকে ভুলিয়ে দেয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা আছে বা ছিল কীনা, এখনো পর্যন্ত জানা যায় না। তবুও ব্রিটিশ সরকার নেতাজী তদন্তে নিযুক্ত মুখার্জি কমিশনকে সরকারিভাবে জানিয়ে দিয়েছিল, নেতাজী সংক্রান্ত অতি গোপনীয় ‘বোস পেপারস’ আগামী ২০২১ সালের আগে প্রকাশ্যে আনা যাবে না। উল্লেখ্য, নিয়মানুযায়ী সুভাষচন্দ্র সম্পর্কিত যাবতীয় অতি গোপনীয় নথি ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কথা রাখেনি। নেতাজি ও আজাদ হিন্দ সম্পর্কে সত্য প্রকাশে কথা রাখেনি কেউ। কোনও দল বা নেতা-নেত্রী আজ পর্যন্ত নেতাজী সংক্রান্ত গোপনীয় দলিল, নথি দেশের জনগণের জন্য প্রকাশ্যে আনার দাবিতে লোকসভা অচল করেননি কিংবা শাসক সম্প্রদায়কে বিব্রত করতে চাননি। বিস্ময়করভাবে কোনও কোনও দল এবং নেতানেত্রী নেতাজীর তথাকথিত ছাইভস্ম আনতে কিংবা নেতাজীর স্মারকসৌধ নির্মাণ করায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সত্য প্রকাশের দাবিতে তারা সোচ্চার হননি। দিল্লির বুকে আজাদ হিন্দ স্মারকসৌধ নির্মাণেও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি তারা।

জাতীয় মহাফেজখানায় নেতাজীর আজাদ হিন্দ সরকার সংক্রান্ত যে ফাইলগুলি গবেষকদের দেখার অনুমতি দেয়া হয় তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। জানা যায়, নেহেরু ও পরবর্তী কালের শাসকদের শাসনকালের নেতাজী সংক্রান্ত বহু গোপনীয় ফাইল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে। হাজার হাজার ফাইল আজও অপ্রকাশিত। মূলায়ম সিং এর আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্র নয়শো ফাইল ডি ক্লাসিফাই করেছিলেন। বাকি ফাইলগুলির ভবিষ্যত কি হয়েছে, দেশবাসি জানে না। মাঝে মধ্যে জানা যায়, অপ্রকাশিত ফাইলের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। অর্থাৎ অজ্ঞাত অন্ধকারে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে ভারত ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। ২১ অক্টোবর ভারতের কোনও দিবস হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাইনি। যেমনটা হয়নি ২৩ জানুয়ারি। স্বাধীনতার অগ্রপথিকদের আত্মত্যাগে দেশবাসী নিজেদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আত্মবোধনে অগ্নিশুদ্ধ হওয়ার তিথি নক্ষত্রের সুযোগ পেতেন যা স্বচ্ছ ভারত ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ ভারতের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। কারণ শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকের অখণ্ড ভারতের মুক্তি সাধনায় ‘একতা বিশ্বাস বলিদান’ মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। জাগ্রত দেশপ্রেমের আবেগ এবং বিবেক অন্তত দেশবাসীর সঙ্গে একের পর এক প্রতারণার মাধ্যমে নানা ‘স্ক্যাম’ নানা ‘ঘোটালা’র ইতিহাস সৃষ্টি করে চলতো না।

নথিবদ্ধ মানব ইতিহাসের  বীরত্বময় সংগ্রামের নেপোলিয়ান বা অন্য কোনও দেশের কোনও মহাযুদ্ধ নন। নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযানই বিশ্বের শ্রেষ্টতম বীরত্বময় যুদ্ধ। এ মত এদেশের কোনও ডান-বাম ঐতিহাসিক গবেষকদের নয়। সম্প্রতি বৃটেনে সমবেত নানা গবেষক বিদগ্ধজনদের মধ্যে অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফলের নিরিখে তা নির্ধারিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। জল স্থল অন্তরিক্ষে চলছে মিত্র ও অক্ষ শক্তির আসুরিক লড়াই। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র এই আপ্তবাক্য স্মরণে রেখে ৩৮ কোটি পরাধীন ভারতবাসীর মুক্তির সুযোগ খুঁজে নিতে ছদ্মবেশে ছদ্মনামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দুবারের নির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু জীবনবাজি রেখে বৈপ্লবিক ঝুঁকি নিয়ে গৃহবন্ধিদশায় দেশত্যাগ করলেন। তীব্র শীতের কামড় সহ্য করে কাবুল কান্দাহার মস্কো হয়ে বার্লিনে। বিশ্বক্র্যাশ হিটলারের দেশে বসেই হিটলারকে সমালোচনা করতে ভয় পাননি বাংলার সুভাষ। তিনমাস ডুবোজাহাজে ভয়ংকর সমুদ্র যাত্রা শেষে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এলেন প্রবাসী ভারতীয়দের নয়নের মণি সুভাষচন্দ্র।

বাংলার আরেক বিস্মৃতপ্রায় মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। যোগ্য নেতাকে যোগ্য আসনে বসানোর ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। বিশ্বের ১১টি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধানের স্বীকৃতি নিয়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে প্রবাসে গড়ে উঠল অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার। ভারত স্বাধীন হলে ভারতবাসী নতুন করে তাদের স্থায়ী সরকার নির্বাচন করার সুযোগ যাতে পান তাই গণতন্ত্রে আস্থাশীল সুভাষচন্দ্র স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাকে গোড়া থেকে প্রশ্রয় দেননি। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর হাজার হাজার জনতার সামনে ঈশ্বরের নামে শপথ নেন যে, তিনি চিরকাল ভারতের সেবক থেকে ৩৮ কোটি ভাইবোনের কল্যাণ সাধনে জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবেন। সেদিন সিঙ্গাপুরের স্থায়ী সময় ছিল বেলা সাড়ে দশটা। তার দেড় ঘণ্টাব্যাপী প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের যাবতীয় প্রতিনিধি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনে যান। নেতাজীর হিন্দুস্থানি ভাষণ তামিল ভাষায় তর্জমা করা হয়। স্বাধীনতা ও স্বপ্ন চোখে নিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন তিনি। এরপর ইতিহাস রক্তাক্ত সংগ্রামের। আজাদ হিন্দ এবং স্বাধীন ভূখণ্ড আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ দুটির নামকরণ করেছিলেন নেতাজী শহিদ ও স্বরাজ দ্বীপ। স্বাধীন ভারত মনে রাখেনি সে কথা। মনে রাখেনি ১৯৪৪ এর ১৮ মার্চ ইম্ফল কোহিমায় ব্রিটিশ ঘাঁটি ধ্বংস করে ত্রিবর্ণ পতাকা তুলেছিল প্রায় আটাশ হাজার আজাদি সেনার রক্তস্নান ও প্রাণের বিনিময়ে।

হিন্দু মুসলিম শিখ ইশাহির সমস্ত ভেদাভেদ মুছে দিয়েছিল নেতাজীর ‘দিল্লি চলো’ ডাক আর স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু। এই অঙ্গীকারের আহ্বানে ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বারাকপুরের নীলগঞ্জে আজাদি বন্দি শিবিরে ব্রিটিশ সিপাহীরা মধ্যরাতে বর্বরভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল দেড় হাজারের উপর নিরস্ত্র বন্দি আজাদ হিন্দ’র জোয়ানদের। সভ্য দুনিয়ায় এই সংবাদ ব্রিটিশ সেদিন গোপন করলেও ফাইলে মিলেছে বন্দি শহিদদের সেদিনের দীর্ঘ তালিকা। স্বাধীন ভারত স্বীকৃতি দেয়নি বাংলার মাটিতে নিহত দেশপ্রেমিক তরুণদের। নতুন ভারতের নতুন সেনাবাহিনীতে নেতাজীর কোনও দেশপ্রেমিক আজাদি সেনা যাতে নিয়োগ না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক ছিল। গোপন সার্কুলারে জানানো হয়েছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্লাবে ক্যান্টিনে বা প্রকাশ্য স্থানে যেন নেতাজীর ছবি টাঙানো না হয়। মাতৃভূমির মুক্তির জন্য প্রবাসী ভারতীয়রা ধন সম্পদ সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন নেতাজির হাতে। আজাদ হিন্দ ফান্ডের বহু কোটি টাকা, রত্ন অলংকার প্রভৃতি স্বাধীন ভারত সরকারের কাছেই জমা পড়েছিল। কিন্তু তার হদিস পাওয়া গেল না। আর্থিক কেলেংকারির সূচনা সেদিন থেকেই। সে কালে একটি জনপ্রিয় গান ছিল, ‘আদেশ ছিল দিল্লি চলো, দিল্লি মোরা জয় করেছি, আজ তুমি কোথায় নেতাজি?’ বছর বছর লালকেল্লায় স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে কিন্তু নেতাজী ও আজাদ হিন্দ’র সমস্ত তথ্য আজও প্রকাশ্যে এলো না।

চলবে...

লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর ডক্টরেট, নেতাজি সম্পর্কিত অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক, আলিপুর বার্তা, কলকাতা