পেন্ডুলাম

শেষ পর্ব

শাহরুখ পিকলু

প্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০১৮

আব্বাস-২
 
 
আব্বাস ঢাকায় এসে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে বিএ ক্লাশে ভর্তি হলো। কিন্তু পড়াশোনায় তার মন বসে না, মনে তার শ্রেণিযুদ্ধ ঘেঁথে গেছে। মামামামী একটু আহ্লাদই করে তাকে, তাদের কোন ছেলে নেই। বেশ হাতখরচও দেয় তার স্বচ্ছল মামা, বাড়ি থেকেও যৎসামান্য কিছু আসে মাসে মাসে।
 
 
সে ঢাকায় খুঁজে পেলো এক নতুন দল, তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে। সে সমাজতন্ত্র, শ্রেণিসংগ্রাম, পুঁজিবাদ, লাম্পেন প্রলেতারিয়েত, কমিউনিজম ইত্যাদি শব্দ শুনেছে কিন্তু নিজের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে সে সন্দিগ্ধ হয়ে প’ড়লো। সে নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটে গিয়ে মার্ক্স, এঙ্গেলস ও আরো অনেকের কিছু বই সংগ্রহ করলো, প্রায় সবই বাংলায় অনূদি্ত, কিছু কিছু মৌলিক লেখা। তার কলেজের পড়া, পড়ার বই সব শিকেয় উঠেছিলো আগেই, এখন সেগুলোতে ধুলো জমতে লাগলো।
 
 
সে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেই দলে জুটে গেলো, সেখানে তার ব্রজমোহন কলেজের কয়েকজনের সন্ধানও মিললো। বাড়ি থেকে আব্বাসের বাবা নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে চিঠি লিখলো, তাকে বরিশাল ফেরত যেতে অনুনয় করলো, ব্রজমোহন কলেজে পড়া চালিয়ে যেতে অনুরোধ করলো। কিন্তু ততোদিনে আব্বাস আন্ডারগ্রাউন্ডে চ’লে গেছে, কারণ সরকারের বিশেষ বাহিনি তাদের পিছু নিয়েছে, সাক্ষাতেই মৃত্যু অবধারিত। ব্রজমোহন, হাবীবুল্লাহ বাহার বা তার বাবা-মা কেউই আর কোনদিন তার টিকিটিও দেখলো না।
 
 
 
আজ প্রায় দশ বছর ধরে এক্সট্রা-ইমাম সাহেব বিভিন্ন সময়ে ছুটি নিয়ে এদিক-ওদিক যায়। ভ্রমণ- কিছু সমমনা লোকেদের সাথে ধর্মের কাজে বের হয় সে। এক্সট্রা হলেও সে গত বেশ ক’বছর ধরেই নিয়মিত ইমামদের থেকে বয়সে বড়, বেশি শিক্ষিত, কথায় একটা বনেদি ভাব আছে, বাচন তার শুদ্ধ। কেউ তাকে ঘাঁটায় না।
 
সকালে কিছু ছেলেমেয়েকে কোরআন পাঠ শিক্ষা দিয়ে কিছু রোজগার হয়, তা ছাড়া সে বাড়ি বাড়ি গিয়েও মাস্টারি করে, ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান থাকায় তাকে দিয়ে কিছুটা প্রাইভেট টিউটরের কাজও চলে, সে বেতন ভালোই পায়। তার উপরেও হুজুরের কিছু বাড়তি ইনকাম আছে, তা কেউই যেন ঠিকমত বোঝে না, বুঝলেও চুপ থাকে, ওটা নিয়েও কেউ ঘাঁটায় না। মসজিদে মাঝে মাঝে বিদেশে থাকা কিছু বাঙালি আসে, এক্সট্রা-ইমামের সাথে তাদের নিরিবিলিতে ঘন্টা-ঘন্টা আলাপ চলে, তাও কেউ একটা গা করে না।
 
শৈশবে তাকে মক্তবে দিয়েছিলো তার বাবা, সেখানে হাফেজি পড়া শুরু করেও শেষ করেনি, স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়। তবুও কিন্তু দোয়া-দরুদ, সুরা-কেরাতে তার দখল কম নয়। বাড়তি ইমাম হিসেবে তাই নয়াপল্টন মসজিদে তার অবস্থান নিয়ে কেউ কোনদিন দ্বিতীয় মত বা উষ্মা প্রকাশ করার সাহস পায়নি, এখন তো তা ভাবাই যায় না।
 
আব্বাস-৩
 
আব্বাস ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন অস্ত্র চালনায় পারঙ্গম হয়ে উঠলো। সে কোথায় থাকে, কী করে তা তার বাবা-মা বা মামা-মামী দূরে থাক, নিজেও সে ঠিকমত জানে না। দেশের আনাচে-কানাচে তাকে অপারেশানে যেতে হয়, গ্রামের অবস্থাপন্নকে বন্দুক ঠেকিয়ে বা আটকে রেখে টাকা আদায়, বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধ, কোন এক নিরাপদ আখড়ায় ব’সে নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনা, এই সব নিয়ে তার দিন কেটে যায়।
 
 
আদায়কৃত টাকা নিয়ে কী হয় তা নিয়েও সে ভাবতে থাকে এবং ভেবে ও দেখে তার ব্যাপারটা নিয়ে মনে একটা খুঁত খুঁত ভাব সৃষ্টি হয়। এদিকে তার সেই পুরোনো সর্বাহারা পার্টি এখন তাদের চরম শত্রু, তাদের বিচরণ ও ‘আহরণ’ ক্ষেত্র যে একই। ব্যাপক সংঘর্ষ হয় কখনো কোনো অজপাড়াগাঁয়ে।
 
মানুষ হত্যা তার কাছে এখন ছেলেখেলা হ’য়ে গেছে। কিন্তু মনের মাঝে পুরো বামধারার আন্দোলন নিয়ে তার খুঁত খুঁত ভাবটা রয়েই যায়। দিন যেতে থাকে, বনে-বাদাড়ে, গ্রামে-মফস্বলে, কখনো ঢাকায় কিন্তু চোখ দু’টো যেন সামনের থেকে পিছনেই বেশি থাকে।
 
শ্রেণি সংগ্রামের অগ্রগতি, গরিবের দুঃখমোচন তার চোখে অধরাই রয়ে যায়, অথচ তার কিছু নেতাদের আমোদ-আয়েশ তার বুকে যেন শেলের মত বেধে। সে কিছুটা ভগ্নমনোরথ হ’য়ে প’ড়তে থাকে।
 
 
 
আজ থেকে কয়েক দশক আগে যুবক এক্সট্রা-ইমাম, যখন সে তার খেতাবটা পায়নি, তখন নয়াপল্টনের তখনকার ইমাম, ফজলুর রহমান বিক্রমপুরী, তাকে পেয়ে খুব পছন্দ করেন। তার মুখস্ত সুরা-কেরাত ও চমৎকার তেলাওয়াত এবং তার সার্বিক জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে তাকে তিনি শিষ্য করে নেন, তাকে দিয়ে টুকটাক ইমামতির কাজ করান, কখনও মোয়াজ্জিন সাহেব অসুস্থ হলে আজান দেওয়ান। সে সকলের মন জয় ক’রে ফেলে।
 
তবে শুরুর দিকে সে বেশ উদাসীন হ’য়ে ব’সে থাকতো। যেন দুনায়াদারি বড়ই নিরর্থক। তবে মসজিদে অভাবী মানুষ দেখলে সে তাদের সংগে কথা বলতো, তাদের ইতি-বৃত্তান্ত জিগ্যেস করতো, সমব্যথী হ’তো। মসজিদের দান-বাক্স থেকে তাদের কিছু খয়রাতি সাহায্য দিতেও তার বাধতো না। সে টের পেলো যে, এদের সাহায্য ক’রতে তার আরো টাকার দরকার, সে যেমনেই হোক।
 
ধীরে ধীরে সেই বিক্রমপুরী হুজুরের সঙ্গে সে কিছু ইসলামি জলসায় যাওয়া-আসা শুরু করে। সেখানে সে ইসলামি শাসনব্যবস্থা, খেলাফত, শরীয়ত ও ওহাবি মতামত সম্বন্ধ্যে শোনে ও অনেক কিছু জানতে পারে, কতটা সে সব হৃদয়ঙ্গম হয় তা কেউ বোঝে না যদিও। ক্রমে ক্রমে সে তার মেধা দিয়ে সেই মহলে উচ্চে উঠতে থাকে, ইসলামি শাসনেই মুক্তি সে তা মেনে নিলেই লাভ তা বোঝে, সে ইসলাম টিকিয়ে রাখতে যা প্রয়োজন তা করবে ব’লে নেমে পড়ে। ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস করাকেও অতিব জরুরী মনে করতে থাকে, তা নাহলে ‘উপর’-এর মানুষেরা খুশি হবে না, টাকার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
 
ক্রমে ক্রমে সে সেই নিমিত্তে একটা দল গঠন করে, নতুন নতুন ছেলে জোগাড় করতে লোক লাগায়। এই কাজে সে অনেক অর্থসাহায্য পায়, তার সূত্র সে জেনেও কোন প্রশ্ন করে না।
 
আব্বাস-৪
 
আব্বাসে বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেছে। বিগত পাঁচটা বছর তার কোথাও থিতু হওয়া সম্ভব হয়নি। সে এখন একজন অত্যন্ত জঙ্গী বামপন্থী কর্মী। ঢাকার ওয়ারিতে এক ধনাঢ্য গৃহে তাদের অপারেশান- তাকে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। সেই ধনাঢ্য এক বিশিষ্ট পুঁজিপতি, কয়েকটা শিল্প-কারখানার মালিক, অতএব শ্রমিকশোষণ যে সে করে তা অবধারিত। সেই অপারেশানে যেয়ে আব্বাস আকাশ থেকে পড়ে। তাদের দলনেতা সেই শিল্পপতিকে খুন ক’রেই তার বাড়ির সব টাকা হাতিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। আব্বাসের সঙ্গের একজন ও বাড়ির এক যুবতী মেয়েকে ধর্ষণ করতে লেগে গেলো। সে বাধা দিলো, বললো, ‘ধর্ষণ কীভাবে শ্রেণি সংগ্রাম হয়!’ তাতে তাকে শুনতে হ’লো, ‘সর, ব্যাটা। জিনিস খাইয়া লই’’। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে পিস্তল উঁচালো কিন্তু গুলি করতে পারলো না।
 
এমন সময়ে পুলিশ হাজির, বাড়ি ঘিরে ফেলেছে প্রায়। আব্বাস কোনক্রমে পাশের বাড়িতে লাফিয়ে প’ড়ে নিজের পিস্তলটা ফেলে দিয়ে সেই বাড়ির গেইট দিয়ে ধীরে বেরিয়ে প’ড়ে হাঁটতে থাকলো। ওয়ারি পোস্ট অফিসের সামনে এসে দিলো দৌড়।
 
তখন অনেক রাত, চারিদিক জনপ্রাণী নেই, গুলির শব্দে আর নেই। পিছে কেউ ধাওয়া করছে তা সে বুঝলো। সে ছুটে মতিঝিলে এসে পৌঁছালো। ধাবিত পশুর মত বুকটা তার ধুক ধুক করতে থাকলো। নটরডেম কলেজ পেরিয়ে আরামবাগের মুখে একটা গাঁজার আড্ডা তার চোখে পড়লো, সে সেখানে ব’সে প’ড়লো। কিছুক্ষণ পর উইসেল দিতে দিতে কিছু পুলিশ পায়দল আর তারও পরে পুলিশের একটা গাড়ি তাকে অতিক্রম ক’রে চলে গেলো। আড্ডার লোকেদের তাকে নিয়ে কোন আগ্রহই নেই, তারা তখন সব ‘দার্শনিক’ হ’য়ে গেছে। সঙ্গীরা কে কোথায় গেছে তার কোন সন্ধান তার নেই, তবে দলনেতার টাকা নিয়ে সরে পড়ার ব্যাপারটা তার মনে দাগ কাটলো আবারও। তার মানসপটে ভেসে উঠলো ধর্ষণের শিকার সেই তরুণীর দুই চোখের বিপন্ন ভাব, তার আর্তচিৎকার।
 
 
রাত আরো গভীর হয়ে আসলে, ভোরের কাছাকাছিতে সে উঠে পড়লো, ধীরে ধীরে সে এগিয়ে চললো, এখন তার সঙ্গী হ’লো রাস্তার কয়েকটা নেড়ি কুকুর। ঠিক নয়াপল্টনের ওখানে পৌঁছতেই সে ফজরের আজান শুনলো, মসজিদটা ঠাওর ক’রে তাতে ঢুকে সে সেই একাত্তর সনের পর প্রায় দশ বছর পরে অজু করে মসজিদের এক কোণে রাখা ভাসানী টুপির স্তর থেকে একটা টুপি নিয়ে নামাজের কাতারে দাঁড়ালো।