ফরিদ সুমন
ফরিদ সুমনের ৬ কবিতা
প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২০
ফায়ার প্লেসের ধারে প্রার্থণাস্নিগ্ধ রাত
আজকাল বড় দ্রুত পূর্ণিমা আসছে
একটার পর একটা, গায়ে গায়ে লেগে যাচ্ছে
জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর মতো শ’য়ে শ’য়ে রাত
মিছিলে মুখর হচ্ছে শোকের সেতার।
তুমি চাইলে বুলবুল পাখিটাকে গলা টিপে হত্যা করতে পারো
অথবা খুলে দিতে পারো স্ফটিক আকাশ। সেই বুলবুল, যে কীনা
তোমাকে; হিম হয়ে যাওয়া জনপদের আঁধারে
অপেক্ষায় থাকা প্রেমিক এবং হত্যাকারী সবাইকে— সমানে
ভালোবেসেছিল।
তোমার ঘরের ছাদে সেঁটে দিতে পারো তারার মজলিস
অথবা যদি মনে করো, আলোতে দম আটকে যাচ্ছে বড়
দুঃখের বুদবুদ উড়িয়ে ঘর কালো করে দাও, তারপর
ফায়ার প্লেসের গভীরে সরসী চোখের তীর ছোঁড়ো
দেখবে, দপ্ করে নিভে যাচ্ছে আগুন, সেই সাথে উত্তাপ।
অজস্র তোতাপাখির মধ্যে দুয়েকটাকে তুমি দেখবে
খুব চঞ্চল। ওরা বাতাসের মধ্য থেকে বাজিয়ে তুলতে পারে
সমুদ্রের গর্জন। ওদের লেবুপাতার মতো নরম সবুজ ডানা
দুপুর ভেদ করে সঞ্চারিত হয় নীল থেকে নীলিমায়।
ওরা অন্যদের থেকে কিছুটা কোমল, প্রার্থণাস্নিগ্ধ।
চাইলে বিছানার চাদরে একঝাঁক ক্যামেলিয়া
ফুটিয়ে তুলতে পারো। অনায়াসে।
ঘুমের মন্ত্রে পাপড়ির অসুখ ভিজিয়ে নেয়া খুব সহজ।
চোখের নৈরাজ্য ঘষে ঘষে হাতের তালুতে পড়তে পারো কীনা
কত মানুষ ফুলের দোকানকে কসাইখানা বানিয়েছে কতবার।
নিজের সাথে দর কষাকষি করে কেউ জিতে আসতে পারেনি।
না তুমি
না তোতাপাখি
দেয়ালে লেপটে থাকা ছোপ ছোপ ব্যাধি
তোমাদের কারো জন্যে নয়।
ঘুমপ্যাসেজে পথভোলা ট্রেন
একটা নিখোঁজ সংবাদ বুকে নিয়ে, তুমি
নিঃসংকোচ ট্রেনে চেপে বসলে, ক্রমাগত ছায়া
আলো কিংবা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া ম্রিয়মান লোকালয়ে
তখনো আড়মোড়া ভাঙছে সবজিক্ষেতের বাতাস।
কত লোক হবে তোমার ট্রেনে?
সমস্ত রঙচঙে মুখের ভিড়ে কী অদ্ভুত ধূসর, হেরে যাচ্ছে
নবীন চোখের ছায়া। পুরো একটা ট্রেনে একা ছুটছো তুমি।
আনকোরা নীল দস্তানার ভেতর
ঝলসানো রাতের সুঁইসুতো। রক্তাক্ত হচ্ছে মেঝে।
পোড়াঘ্রাণ উড়ে যায়
উড়ে উড়ে যায়।
হ্যারিকেন উঁচিয়ে
স্থির হয়ে আছে পৃথিবীর উষ্ণতম প্ল্যাটফর্ম।
অথচ একটা নিখোঁজ সংবাদ বুকে নিয়ে
ঘুমের চেয়েও শীতল কোনো প্যাসেজে
নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে তোমার ট্রেন।
হঠাৎ শীতের রাতে
তোমার শাড়িকে নদী ভেবে
সেতারের নোনাজলে কত যে দিয়েছি সাঁতার
সেইসব মহুয়াবিধুর রাতের কথা, আজ থাক।
আজকের এই পৌষের সন্ধ্যায় চাবুকের মতো
শীতের বাতাস, অনর্গল হিম। আজকে বরং
ঠোঁটের স্বর্ণমুদ্রায় একশো একটা প্রেম বাজি ধরে
মেপে দেখি হৃদয়ের ব্যবধান।
দূরগামী ওম জাগিয়ে তোলো। প্রশ্ন করো না, কেন
এইসব ভুলভাল মুগ্ধতার কলি ফুল হয়ে দুলে ওঠে
আজকে তুমি উস্কে দাও আঙুলের সঙ্গোপন শিল্প
আমাদের বিগত বসন্তের লাল মেখে দাও চোখে।
আজকে তোমার বিছানায় ঝাঁকেঝাঁকে পাখি
দুয়ারে দুর্দান্ত প্রেম নিয়ে, সাড়া দেবে?
আমি যদি ডাকি।
প্রাচীন ছোবল
কিছু কথা জমেছিল, কথার ছলে
কিছু বিষাদের টুকিটাকি
হলুদিয়া পাখিটার চোখ থেকে বিকেলের সোনারঙ
খুব ধীরে মুছে গেলে— প্রাচীন গাছেরা
করে সিনানের আয়োজন। নিশীথের নির্জনে নদীর তরঙ্গ নাচে
খিলখিল হেসে ওঠে ঘুমচোখ ফুলেদের দল।
অত রাতে কে যায় কাহার কাছে, যে ক্ষণে
জল হয়েছে আয়না, আয়নাই জল।
বাকল খোলার পরে পরম্পরায় পাওয়া পাপ-শাপ
ধুয়ে যায়।
যায় নাকি?
পাপ ধুয়ে যায় কি না-যায়
কথাগুলো ভেসে যায়, শুধু শেকড়ের ঋণ বাড়ে
গাছেদের সংসারে রয়ে যায়
সেই পুরনো সাপ; বিষের ছোবল আর
বেহুলা-লখিন্দর।
ক্লান্তি
কোনো কোনো রাতে
সিঁদ কেটে ঢুকতে ইচ্ছে করে
নিজেরই খাজাঞ্চিখানায়। অফুরান বাদশাহি
অমেয় ঐশ্বর্যের প্রাসাদ থাকুক পিছে পড়ে।
শিরস্ত্রাণ ছুঁড়ে দিই নিথর নদীর জলে।
ইচ্ছে হয় ত্রয়োদশী চাঁদের নিচে
কালো ছাতা খুলে বসে থাকি।
কোনো কোনো রাতে
ইচ্ছে হয় আনাজপাতির ঘরে তালা দিয়ে
নিঃসীম শূন্যতার দিকে চেয়ে চেয়ে অনিমেষ
প্রার্থণা করি—
‘দীর্ঘ হোক ক্ষুধা-তৃষ্ণা-মহামারি
নির্বাণের পথ হয়ে যাক
অধরা-অশেষ।’
দি ডিলাইটফুল পেইন
তোমার পোশাক থেকে একটি সুতো টান দিয়ে
খুলে, দূর গোলার্ধের দিকে
আচমকা উড়ে গেল আজনবি বাবুই।
আমাকে ঘিরে এঁকে রেখেছিলে
যে সঙ্গোপন পরিখা; সেখানে হৈ হৈ করে উঠল
একশো একটি আগ্নেয়গিরি।
আর ওদিকে, কী আশ্চর্য!
মুহূর্তেই তানপুরার মতো নগ্ন হয়ে গেলে তুমি
নগ্ন হতে হতে, প্রকৃতির চেয়ে অশ্লীল।
সত্য হতে হতে—
জন্মের ঠিক মধ্যিখানে লেপটে থাকা
এক তিল মৃত্যুর চেয়ে অনিবার্য হয়ে গেল
তোমার সন্তাপক্লান্ত পায়ের ছাপ।
আমি তোমাকে আড়াল সরাতে বলেছিলাম
কে জানতো, একটিমাত্র সুতোর টানে
পুরো ব্রহ্মাণ্ডকেই এমন বে-আব্রু করে তুলবে তুমি।
























