বিআরটিসিতে বুবন

রাহিমা আফরোজ মুন্নি

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০১৫

অনেকক্ষণ ধরেই সুযোগ খুঁজছি, অন্তত জোড়া পায়ের উপর তো শরীরের ভার দেয়া উচিত। এক পা আর এক হাত দিয়ে ব্যালেন্স ধরে রাখবার চেষ্টায় ওদের জোড়ার অন্যটিকে প্রায় হারিয়েই ফেলছি, কেউ হাত টানছে নিজের মালসামান ভেবে, কেউ পা পিষে দিচ্ছে এমন যেন নাই করে দিলেই নিজের জায়গা হবে। অন্ধকারে ডান বাম নীচ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না, অল্প আলো উপর থেকে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু ফাঁক না পাওয়ায় নীচ পর্যন্ত আসছে না। আজব! মানুষের অসমান শরীর কেমন করে ফাঁকগুলো খেয়ে ফেলছে বুঝলাম না। অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁশ দশা, কোনখান থেকে তো মিলবেই, খুঁজতে গিয়ে খানিকটা হুস হুস করে কি জানি কেমন টেনে নিলাম। ফরমালিন ফরমালিন গন্ধ। ইদানীং যে কোনো ভীড়ে এই গন্ধটা আমাকে বিরক্ত করবেই করবে। সুপার শপে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ফরমালিন ছাড়া এবং সহ এই দুই জিনিসেরই তারতম্য ধরতে শিখেছি। তবুও নিজেদের জন্য কেনাকাটা করবার সময় আমি কখনই বুবনকে অন্য শপে যেতে দিতাম না। ধুশশ! কাউকে বিশ্বাস করতে নাই।
উদাস ভাব নিয়ে তালে তালে বিশ্বাস অবিশ্বাসে দুলছি, আচমকা মিষ্টি একটা বোঁটকা গন্ধ ঠিক নাক ঘেঁষে দৌড়। গন্ধের বেলায় আমার রিফ্লেক্স খুব দ্রুত কাজ করে। বলে দিতে পারি কিসের, কোথায় এবং কেন। এই গন্ধটা বেশ ঝাঁঝালো, তবে গাড় করে টানলে এর ভেতরের মিষ্টি ভাব টের পাওয়া যায়। গন্ধ মিষ্টিও আবার বোঁটকাও একই সাথে কেমন করে হয় বুবনের অস্থির জিজ্ঞাশা চলতই। আমি ওর শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশের স্বাদ, গন্ধ নিতে নিতে ওকে বোঝাতে চাইতাম প্রত্যেক অংশের  ভিন্নতা, কিন্তু ওর অস্থিরতা বাড়তই, আমার ভালোলাগা ওর কাছে একরকমের বিকৃতরুচি। এসব সময়ে কান্না দিয়ে শেষ হতো ওর অস্থিরতা, আর সেই পানিতে মিষ্টি গন্ধ, বোঁটকা গন্ধ সব ধুয়ে মুছে হারিয়ে যেত। ওর স্বেচ্ছাচারিতা আমাকে প্রায় জড় করে দিয়েছিল। সে যে কি কষ্ট!
শুধু বুবনেরই ছিল এমন গন্ধ, হয়ত আছে এখনও। পরপর শাওয়ার নিলে সেটা অবশ্য চলে যেত। আমার ভাললাগা তাই ওর শাওয়ারহীন দিনগুলোয়। গাধাটা  বোঝে না অবশ্য।  কটকটে চিৎকারে গন্ধ জানান দেয়, এমন সুগন্ধি গায়ে মেখে  ওর আহলাদে আমার বিমর্ষ লাগত প্রায়ই। বুবনের তাতে থোড়াই পরোয়া, আমার অনুভূতিগুলাকে প্রথমে সে ন্যাংটা করত, পরে নিজেই তাদের ঢাকত, আমাকে  মানতেই হতো এসব কাণ্ডের নামই ভালবাসা। এমন জমাট অন্ধকার মাঝে মাঝে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। চারদিকে ছুটাছুটি করা গন্ধগুলার থেকে আমার প্রিয় গন্ধ খুঁজতে থাকি। নাক দিয়ে দূরের কোনো শরীরের মাঝে ডুবে থাকা গন্ধটা টেনে আনতে চাইলাম। চিৎকার চেঁচামেচিতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিলাম না। অনেকদিন পর হাহাকার ভেতরে। মিস ইউ বুবন। সব রাগ গেল আরামে দাঁড়িয়ে থাকা পায়ের উপর। এতক্ষণেও একটা সীট ম্যানেজ করতে পারলি না! কেউ একজন ভীড় গলে আমারই সামনে। নড়াচড়া তেমন টের পাই নাই, তবে গন্ধের জায়গা বদলালেই আমার খবর হয়ে যায়। বেশ কড়া লাগছে গন্ধটা, একদম যেন বুকের কাছেপিঠেই, এমনই কপাল, আচমকা আলোও  আমার পায়ের উপর। দ্রুত গন্ধের দিকে তাকালাম। বসে আছে হাত জড়ো করে। ড্যাবড্যাবে চোখ জোড়া ঘিরে একঝাঁক চুল। ভোজভাজি যেন, আমিও কি করে ঠিক তার পাশেই, অথচ নড়িও নাই, সে সামান্য দুলছে বসে বসে, অনেকক্ষণ ধরেই সীট দখলে রাখবার শান্তিতে মুখটা হাসিহাসি। আমার একটু রাগ আসল। সেই কখন থেকে আমি দাঁড়ানো, আর সে হাসছে!     
আমার হাতদুটো বিদ্রোহ করছে, আর কত ধরে রাখবে রড। ধুর!  রিল্যাক্স হয়ে হাতদুটো ছেড়ে দিলাম ওর কাঁধে। প্রিয় গন্ধের চেনা ডাক অস্বীকার করি কি করে! আচমকা ড্যাবড্যাব চোখে অস্থিরতা, অবলীলায় আমার পেটে নাকের ঘাম ঘঁষছে। সত্যি কি! ভেজা ভাব আমার টি-শার্ট ছেঁদা করে একদম চামড়ায়। আঠালো আর মিষ্টি। তীব্র ইচ্ছা  হলো স্বাদ নেবার। একটু জোরেই হেসে ফেললাম। বুবনের সব আছে, কিন্তু নিতে দেয় না কিছুই, না স্বাদ না গন্ধ। ভেজা নাক সামান্য ফুলে উঠল। অভিমানে কি!? আমার মায়া হয়। পাশে চেপে আসি আরেকটু। ঝুটি বাঁধা মাথাটা লেগে আছে আমার তলপেটের কাছে। ইচ্ছা করছে মাথাটা চেপে ধরি বরাবর। ভেজা নাক নড়ে উঠল, কাঁপছে। ডুবিয়ে দিল আমার দুই পায়ের ফাঁকে। আলতো করে ঝুঁটিতে হাত রাখলাম আমি। ভাল লাগছিল আমাদের। ধীরে ঠোঁট নড়ছে আমার। বুবন বুবন! আধো আলোতে বুবন চোখ তুলল। বলুন!