বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ১৭

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৭, ২০১৯

১২.
‘শব্দের শিশির’ গ্রন্থপ্রণেতা কবি ও প্রাবন্ধিক জয়িতা চক্রবর্তী বলেছেন, প্রত্যেক সৃষ্টিশীল কাজেই প্রাথমিক উত্থান কবিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়; তার সেরা সৃষ্টিগুলি একে-একে শেষ হতে থাকে। অধোগতি হয়েছে একথা শুনতে হয় তাকে। ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ, যার সেরা সৃষ্টিগুলি পরিণত ও শেষ পর্বে পাওয়া যায়। শিল্পী কখনও নিঃশেষিত হন না। পঞ্চাশের দশকের কবি বিনয় মজুমদার যত জনপ্রিয় ততটাই নিন্দিত। আমি মনে করি, ‘ভালো কবিতা’ বা ‘মন্দ কবিতা’ বলে কিছু হয় না। বিনয় মজুমদারের প্রথম পর্বের কবিতাগুলিতে রোমান্টিসিজম ছিল, যা বাঙালি পাঠকের চির পছন্দের। শেষ পর্বের লেখাগুলো সময়ের চেয়ে এগিয়ে। কবিতা যেখানে জীবনের অপ্রিয় সত্য, জৈব সত্য ও জীবনের বাহ্যিক অর্থহীনতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে। অনেক কবির মতে, বিনয় মজুমদারের সেসব কবিতা অপাঠ্য ও বিকৃতরুচির পরিচায়ক। আমি জোর দিয়ে বলছি, তারা বদ্ধ জলাশয়। এমনকি ভুট্টা সিরিজের কবিতার বই পুলিশ অব্দি গড়ায়। স্টল থেকে তুলে নেয়া হয় তাঁর বই। বাঙালির যৌনতা সম্পর্কে ছুঁৎমার্গ কাটবে না। তারা ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচ পছন্দ করে। বিনয় মজুমদারের কবিতায় আছে কাব্যগুণ, আছে জীবনবোধ। তাই শেষজীবনে অসুস্থ শরীরে লেখা কবিতাগুলি অত্যন্ত উপভোগ্য ও উত্তরআধুনিক কবিতাধারায় সৃষ্ট; একজন সাহসী লেখকের মননশীলতার পরিচয়।

এ প্রসঙ্গে পুনরাধুনিক কবিতার প্রবক্তা ও কবি অনুপম মুখোপাধ্যায় বলেছেন, এই ভুট্টাপর্বের কবিতাগুলোর জন্য তাঁকে কম গালমন্দ খেতে হয়নি। অনেকেই তাঁকে সিরিয়াসলি নিতে চাইলেন না আর এই কবিতাগুলো লেখার পরে। কিন্তু বিনয় ভুট্টা পর্বের কবিতাগুলোয় সম্ভবত সেটাই করলেন, যেটা পিকাসো তাঁর অন্তিমপর্বের এচিংগুলোয় করেছিলেন। নিজের জৈবিক এবং প্রায় হাস্যকর ও অসহায় কামপ্রবৃত্তিকে তুলে আনলেন চোখের সামনে। তিনি ‘লিঙ্গ’ লিখলেন না, এমনকি তার দেশজ প্রতিশব্দটিও লিখলেন না, তিনি লিখছেন ভুট্টা। এটা শব্দের প্রতিস্থাপন। এই খেলাই আমি আজকাল নিজের কবিতায় খেলি। আমি তার স্থানে থাকলে ‘লিঙ্গ’ কেটে ‘ভুট্টা’ লিখতাম, কিন্তু কাটা শব্দটিও পাশে রেখে দিতাম। বিনয় ‘রমণী’ লিখলেন না, তার বদলে ‘চাঁদ’ লিখলেন। ‘যোনি’ লিখলেন না, তার বদলে ‘গুহা’ লিখলেন। ‘সঙ্গম’ লিখলেন না, তার বদলে ‘নাচ’ লিখলেন। বললেন, মেয়েদের নিয়মিত নাচা উচিত। বেশ্যাগৃহে গিয়ে সঙ্গমকে ‘বসা’ লিখলেন। কোনো মেয়ের নাম দিলেন ‘ঔদার্য’, এবং মনে মনে তার সঙ্গে রমণ করে কবিতা লিখলেন। যোনিপ্রদেশকে বললেন মায়াসভ্যতা। বীর্যের ফোঁটাকে বললেন, চন্দন। কিন্তু যখন তাঁর কবিতার নাম হলো ‘আমার ভুট্টায় তেল’, স্পষ্টই বোঝা গেল তিনি কী লিখছেন— একজন দেহপসারিণী নিজের যোনিতে নেয়ার আগে একজন পুরুষের লিঙ্গে তেল মাখাচ্ছে। যেমন গাছের তলায় রাখা লম্বাটে পাথর দেখলে মানুষ প্রণাম করে, কারণ তার মাধায় শিবলিঙ্গ উদ্ভাসিত হয়, যেমন আলুর শুঁড় দেখেই তাকে বস্তা থেকে সরিয়ে কুলুঙ্গিতে রাখা হয়, গণেশ হিসাবে। কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত কবি এভাবে সরাসরি কামবিষয়ক কবিতা লিখবেন এটা অনেকেই মানতে পারেনি, আজও পারে না। তাঁরা আজও ‘ফিরে এসো, চাকা’, অথবা খুব বেশি হলে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’কেই বিনয় মজুমদার মনে করে এবং স্বস্তিতে থাকে মধ্য ও শেষ পর্বের বিনয়কে উন্মাদ আখ্যা দিয়ে। (২০১৬)

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য লক্ষণীয়। অনুপম বলছেন না যে, বিনয় তাঁর এই কবিতাগুলোয় ‘উপমা’ প্রয়োগ করেছেন। বিনয় মজুমদার শব্দের ‘প্রতিস্থাপন’ ঘটালেন। এখানেই জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয়ের পার্থক্য। জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় ‘মতো’ ‘যেন’ ইত্যাদি প্রয়োগ করে গেছেন, যা বিনয় ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ থেকে তাঁর পরের কবিতায় আর করেননি, ‘বাল্মীকির কবিতা’য় তো করেনইনি। উপমা বাদ দেবার দরুণ বিনয় প্রকৃতির সঙ্গে পরমাপ্রকৃতির অভেদকে সনাক্ত করছেন। কিন্তু জীবনানন্দ যে ক্রমে উপমা থেকে সরে গিয়ে প্রতীকে এবং প্রতীক থেকে বস্তু-সম্পর্কে চলে যেতে লাগলেন, তা বিনয় ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্থে। বিনয়ের এই পর্বের কবিতায় শব্দের প্রতিস্থপনের কথা অর্ঘ্য দত্ত বকসীও বলেছেন তাঁর “প্ল্যানচেটে যৌনসমীক্ষায় বিনয় মজুমদার” আলোচনা পুস্তিকায়। তিনি এদের বলেছেন প্রতীক: চাঁদ, নদী, ফুল, গুহা, হ্রদ (যোনি), ঘাস (যোনিরোম), লেবু, বেল (স্তন), ভুট্টা, কলা, চন্দনকাঠ (লিঙ্গ)। এই প্রতিস্থাপন বাংলা কবিতায় নতুন নয়। চণ্ডিদাসের ৮৭৯ পদ পাঠ করা যাক:

সহজ সহজ সবাই কহয়ে
         সহজে জানিবে কে।
তিমির অন্ধকার যে হইয়াছে পার
         সহজে জেনেছে সে।।

চান্দের কাছে অবলা আছে
        সেই সে পিরীতি সার।
বিষে অমৃততে মিলন একত্রে
        কে বুঝিবে মরম তার।

বাহিরে তাহার একটি দুয়ার
        ভিতরে তিনটি আছে।
চতুর হইয়া দুইকে ছাড়িয়া
        থাকিব একের কাছে।।

যেন আম্রফল অতি সে রসালো
        বাহিরে কুশী ছাল কষা।
ইহার আস্বাদন বুঝে যেই জন
       করহ তাহার আশা।।

নিজের কবিতার কৃৎকৌশলের সঙ্গে বিনয় মজুমদার প্রথম থেকে শেষপর্ব পর্যন্ত সচেতন ছিলেন। কবিতার সৃজন এবং বর্জনীয় উপাদান সম্পর্কে অতিসতর্ক থাকতেন। সেকারণে দেখা যায়, আলোচনাকালে তিনি আধুনিক পেইনটিঙ থেকে ব্রাশ স্ট্রোকের বিলয় এবং মেটাফর থেকে কবিতার মুক্তির কথা বলেছেন। যাতে জীবনের রহস্যময়তাকে সম্পূর্ণ উদ্ঘাটন করা না হয়, এবং সেই সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার ও পারলৌকিকতার ফাঁদে না পড়তে হয়। প্রণব সরকার বলেছেন, “বিনয় একালের কামসূত্র বা ভুট্টা সিরিজের কবিতা বা ‘বাল্মীকির কবিতা’র ভিতরে রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে, যা আমাদের কাছে সরাসরি অশ্লীল কোনো ভাব প্রকাশ করে না। বরঞ্চ প্রাপ্তবয়স্কদের মনস্ক করে।”

উপরোক্ত বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে প্রবীর ভৌমিক বলেছেন, “যে সৌন্দর্যময় নারীচেতনার তান্ত্রিক পূজারী বিনয়, তিনিও অপরিচ্ছন্ন, বিকৃত, বমন উদ্রেককারী এই লাইনগুলো লেখেন, ‘গুহায় বোজানো মুখ চেপে ধরে ঠেলা দিই/সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি/ভুট্টাটি সহজভাবে ঢুকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা শুরু করি।’ এ বিনয়কে মানায় না। বিনয়ের এই কবিতাগুলোকে মহিমান্বিত করে ছোট করবার একটা অপচেষ্টা চলছে। আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।” রণজিৎ দাশ একটি যুক্তি দেবার প্রয়াস করেছেন। তিনি বলেছেন, “আর দশজন আধুনিকের মতো বিনয়ও হেঁটেছেন বদল্যার নির্দেশিত এই স্বপ্নসম্ভব পথেই, কিন্তু পৌঁছেছেন এক ভিন্ন গন্তব্যে।”

প্রশ্ন হলো, ‘ফিরে এসো, চাকা’ লিখে বিনয় তো বাংলা কবিতার ইতিহাসে জীবনানন্দের পর নিজস্ব স্থান করেই নিয়েছিলেন। তাহলে তিনি ‘অঘ্রাণের অনূভূতিমালা’ আর ‘বাল্মীকির কবিতা’ এবং তার পরবর্তী সাব-জনারের কবিতাগুলো লেখার উদ্যোগ নিলেন কেন! এগুলো লেখার জন্য তো তিনি টাকা পাননি, বরং পুরস্কারের লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে ছিটকে গিয়েছিলেন। বদল্যারের জীবনকাহিনির প্রভাবে পঞ্চাশের কবিরা কলকাতার যৌনপল্লি যাওয়া আরম্ভ করেন ঠিকই, বিনয়ও, আমার অনুমান,  তাঁদের কিছু পর থেকে তাঁর নারীহীন যৌনজীবনের প্রয়োজন মেটাতে যাওয়া আরম্ভ করেছিলেন বটে, কিন্তু কবিতা লিখে তার প্রমাণ দিতে যাবেন কেন? আমার মনে হয় যে, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে-তুলে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা, একই খোঁচা বারবার দিয়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিলেন। তা থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছিল, এবং তার প্রথম ধাপ হিসাবে তিনি লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। যেটিকে তিনি বললেন “নারীভূমিকা বর্জিত আদিরসাত্মক কবিতা”– ঈশ্বরী অথবা গায়ত্রীর ভূমিকা আড়াল করার এটি প্রথম পদক্ষেপ। বিনয় লিখলেন:

এইখানে পাহাড়ের ভাঁজ বলা যেতে পারে, বাঁক বলা যেতে পারে, অথবা
দু-দুটি পাহাড় এসে মিলে গেছে যদি বলা হয় তবে একেবারে
হুবহু বর্ণনা হয়; মিশেছে প্রায় সরলকোণের খুব কাছাকাছি এক স্থলকোণে।

‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ থেকে প্রাসঙ্গিক লাইন তুলে তুলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বকসী তাঁর ‘বিনয় মজুমদার ও অঘ্রাণের অনুভূতি– বিশাল দুপুরবেলার যৌনসমীক্ষা’ বিশ্লেষণে (২০১৪)। অর্ঘ্য বলেছেন, “অনেকটা উল্টোনো বিস্ময়বোধক চিহ্ণের মতো লাগে এই যোনি। বিস্ময়বোধক, তাই হয়তো উল্টোনো, ডিসপ্লেসড। দেহের সর্বাপেক্ষা গোপন স্থানে যোনির অবস্থান। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী গোপনতায়। চাঁদের গুহার দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকেন কবি। কবি বলছেন, প্রাণলোকে (অনুভূতিমণ্ডলে) প্রবেশাধিকার দিয়ে তৎলোকে বিক্ষোভ সৃষ্টি করে তৃপ্তিদান করানোর বাসনা এবং গোপনতার অনুভূতির সঙ্গে যোনির সরাসরি সম্পর্ক। যোনি varies directly as প্রাণলোকে প্রবেশাধিকার দেয়ার বাসনা— গোপনতা। তাই পাহাড়ের জীবনেও গোপনভাবে প্রবেশ করে কবি বর্ণনা করেছেন এই জোড় ও মধ্যবর্তী গোপন গোপন ক্রীড়ার স্থান— বানিয়েছেন প্রাকৃতিক যোনি— প্রকৃত কবিতার মতো! প্রকৃত সারসের মতো!”

এক কোণে, পাহাড়ের কোণের ফাঁকেই হলো আমার বাড়িটি, ঠিক কোণে
পাহাড়ের ঢালু গায়ে চূড়ার কিছুটা নীচে ঢালু কোণে বাড়িটি ঢোকানো
লম্বালম্বিভাবে পাহাড়ের ভিতরে অনেক দূর খুব বেশি সুন্দর উপায়ে।

অর্ঘ্য বলেছেন, “স্তন বা চূড়ার নীচে যৌনস্থান যা ঢালু অংশে স্থাপিত সেখানে যোনিমুখ থেকে ভিতরে ‘ঢোকানো’ দীর্ঘ যোনিগহ্বর ও তাতে নিত্য অবস্থানরত অনুপ্রবেশিত শিবলিঙ্গ, সদারমণরত নিত্য পূজা।”

বারান্দাটি শুধু এই পাহাড়ের পাথরের গা থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে
সামান্যই বেরিয়েছে, পাতলা লতার গাছে বারান্দাটি চারপাশে ঘেরা।

অর্ঘ্য মনে করেন, “বাড়ি যদি লিঙ্গ হয়, বারান্দা তবে স্বভাবতই বাইরে ‘ঝুলে’ থাকা চারপাশের যৌনরোমসহ অণ্ডকোষ। বিনয় অন্যত্র ঘাসের কথা বলেছেন যা প্রকৃতপক্ষে যোনিরোম।” দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো ‘বাল্মিকীর কবিতা’— যা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ও গুণমুগ্ধ স্তাবকদের থেকে গায়ত্রীকে সম্পূর্ণ আড়াল করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ‘বাল্মীকির কবিতা’ নিয়ে বিনয়ের মনে দোনামনা ছিল বলে মনে হয়। ‘গ্রন্থি’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে  ১৪১২ বৈশাখে চন্দন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিনয়ের এরকম কথাবার্তা হয়েছিল:

প্রশ্ন: এখনকার বাংলা কবিতায় মেয়েরা যৌন আকাঙ্ক্ষামূলক লেখাগুলো বেশ খোলামেলা ভাবেই লিখছেন। প্রতিষ্ঠিত কবিরা স্বাগতও জানাচ্ছেন এই পরিবর্তনকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রন্থির বর্তমান সংখ্যাতেই তসলিমা লিখেছেন একটি গদ্য, নাম ‘নারী শরীর’। আপনিও যৌন অভিজ্ঞতার কথা সরাসরি দু’একটি প্রতীকের আড়ালে লিখেছিলেন ভুট্টা সিরিজের কবিতায়। একটা ছোট কবিতার বইও সম্ভবত হয়েছে কবিতাগুলি জড়ো করে। পরে আপনি তাদের disown করেন। আজ এই মুহূর্তে কি পাল্টাবেন মতামত? এ ধরনের কবিতার স্থায়ীমূল্য কি আছে?
বিনয়: (মৃদুস্বরে বলে যান) না, কোনও বই নেই তো। আমার জানা নেই এমন কোনও বইয়ের কথা। এগুলো উল্লেখযোগ্য লেখা নয় (অস্বীকারের ভঙ্গিতে হাত নাড়েন)। তবে মহিলা কবিরাই চিরকাল ভালো কবিতা লিখে এসেছেন। যেমন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে।’ কিংবা ওই লেখাটা, ‘ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়…।’ আর স্থায়ী মূল্যের কথা বলছ? দ্যাখো, প্রথমে যখন লিখতে শুরু করি তখন লক্ষ্য ছিল পাঠককে জ্ঞান দান, তার বুদ্ধি বাড়ানো, কবিতাগুলিকে তার মনে রাখানোর চেষ্টা, তার সঙ্গে যেন আমার কথাও মনে পড়ে, সেদিকে নজর রাখা ইত্যাদি। কবিতা কীভাবে হয়, কীভাবে সার্থক, আমিও জানি না। হয়ে যায়, এই পর্যন্ত।

‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সমর তালুকদারের ঠাকুরনগর স্টেশানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময়ে কথাবার্তার মাঝে বিনয় মজুমদার সমরবাবুকে জিগ্যেস করেছিলেন, “১৯৭৭ সালে বিশ্ববাণী থেকে প্রকাশিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ বইটি তিনি পড়েছেন কিনা।” ১৯৯৩ সালে কথাপ্রসঙ্গে ‘যোগসূত্র’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে অজয় নাগকে বিনয় বলেছিলেন, “আদিরসাত্মক কবিতাগুলি নিয়ে একটা বই বেরোয় তার নাম দিই ‘বাল্মীকির কবিতা’; কেন যে লিখেছিলাম মনে নেই এখন।” বিনয়ের কবিতাকে প্রতি-রোমান্টিসিজমের প্রসারণ থেকে, যা কিনা পুনরুদ্ধারের অতীত এক নিগূঢ় পন্থা, এবং যা কিনা অবিরাম রোমান্টিক-নিউরোটিককে, আর আমাদের জীবনযাপনের আধুনিকতাবাদী ব্যাজস্তুতিকে, পর্যদুস্ত করে, তা থেকে বের করে আনা দরকার। বিনয়ের কবিতা আক্রান্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে, বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে, যার পাল্লায় এক সময়ে জীবনানন্দকে পড়তে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকেও পড়তে হয়েছিল। এখানে বিনয়ের এই কবিতাটি প্রাসঙ্গিক:

হাসপাতালে

এজরা হাসপাতালে যখন ছিলাম
তখন পাগল বলে ডাকত আমাকে
রাত্রিবেলা অন্ধকারে দেখতাম আমাকে খাওয়ার
নিমিত্ত রামদা হাতে আসত পরমেশ ও
                     উমা দাশগুপ্ত, দেখে আমি
বলতাম দরজায় লেখা আছে আমি আছি পাগলা গারদে
আমি তো পাগল আর পাগলের মাংস খেলে
তোরাও পাগল হয়ে যাবি
           প্রতিদিন রাত্রিবেলা এ কাণ্ড ঘটতো।
তখন আমাকে আর কেটে কেটে খেতে আসত না।

প্রত্যেকেই অস্তিত্বের পাগলাগারদে জীবন কাটান। সেটা হলো অক্ষমতার অস্তিত্ব। তা এই জন্য নয় যে, আমরা মানসিকভাবে যুক্তিহীন প্রাণী, বরং মানুষকে মেরে ফেলে তার মাংস খাওয়াকে অসম্ভব মনে করা যায় না। আমরা সবাই কিনারায় দাঁড়িয়ে কাঁপছি। মানুষ মেরে তার মাংস খাবার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যাবে না। সেই দিন আগত। প্রতিটি বাঁকে আমরা আমাদের সহযাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর, এবং তা মেরে ফেলে মাংস খাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। পাগলাগারদের পাহারাদার অভিভাবকদের ভূমিকা সেটাই। সুযোগ পেলেই মানুষ তার সহযাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর হবার যারপরনাই প্রয়াস করে। পাগলাগারদের বিশেষ অভিভাবক হবার সংজ্ঞা সেইটাই। আমরা নিজেদের কেটে টুকরো করছি, আমাদের অস্থিরতা আমাদের তা করতে প্ররোচিত করছে, যাতে আমরা সমাজে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারি।

কলকাতা শহরের হাসপাতালগুলোয় রোগীদের ক্রুদ্ধ আত্মীয়দের আক্রমণাত্মক আচরণ দেখলেই তা টের পাওয়া যাবে। স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসক আমাদের দেশে বিরল; যে চিকিৎসকরা আছেন তাঁরা ম্যাডনেস ও ইনস্যানিটির ডাক্তার, যে কারণে সোভিয়েত দেশ ভেঙে পড়লে নিমু ভৌমিক তা সহ্য করতে না পেরে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং উন্মাদ হয়ে যান, তাঁকে বাঁচানো যায়নি, তিনি জার্মান কবি ফ্রেডরিক হ্বেল্ডারলিনের মতন ‘হাইপোকনডিয়াইসিস’ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সোভিয়েত দেশে নিমু ভৌমিক সারা জীবন সুস্থ ছিলেন। বাংলা ভাষায় ‘হাইপোকনডিয়াইসিস’-এর বাংলাও পাগল হয়ে যাওয়া, কেননা হাইপোকনডিয়াইসিসের বাংলা প্রতিশব্দ নেই। মালটিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, প্যারানয়া, সাইকোসিস, ডিপ্রেশনজনিত অসংলগ্নতা, উদ্বেগের অসংলগ্নতা, ট্রমাজনিত আচরণ, ফোবিয়া, হ্যালুসিনেশনবোধ, ডেলিউজান, অ্যানেরোক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়া নার্ভোসা সোমাটোফর্ম, স্মৃতিবিলোপ, সবই বঙ্গসমাজে পাগলামির নাম দিয়ে চালানো হয়। স্কিৎসোফ্রেনয়াও তিন রকমের হয়: অ্যাক্টিভ, ক্যাটাটনিক এবং ডিসঅর্গানিজড— শরীরে রাসায়নিক ও হরমোনের ভারসাম্যের তারতম্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। সবগুলোকেই বলা হয় মস্তিষ্কবিকৃতি বা পাগল হয়ে যাওয়া! লুম্বিনী পার্কের চিকিৎসকরাও শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করেননি।

বাংলা ভাষায় শব্দসংখ্যা এতোই কম যে এই বিষয়ে ১৪১৩ বঙ্গাব্দে ‘অউম’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদার জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, “শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন যে, একটি কবিতায় একস্থানে একটিমাত্র শব্দ বসার কথা। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে ১,২০,০০০ শব্দ আছে। সেই শব্দের ভিতর থেকে একটিমাত্র শব্দ এনে বসাতে হবে। এই খুঁজে বের করা কবির বিষয়। এটা শিবরামের হলেও সমান চিন্ত্যনীয়। কারণ আগেই বলেছি যে ধেনুর সঙ্গে বেণু, গেনু, পেনু এইসব শব্দ অভিধান থেকে বেছে বের করার সময় সৃষ্টিকর্তার মাতব্বরির খপ্পরে পড়তে হয়। ‘বস্তুত সৃষ্টিকর্তার মাতব্বরির খপ্পর থেকে বেরোবার জন্যই কবিরা একটি শব্দের জায়গায় আরেকটি শব্দ প্রতিস্থাপন করেন, যা বিনয় মজুমদার করলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে। উল্লেখ্য যে, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি শব্দের ডিজিটাইজেশনের পর জানিয়েছে যে তাতে শব্দসংখ্যা ১০,২২,০০০; অর্থাৎ আমাদের ভাষার দশগুণ। ইংরেজির চেয়ে তুর্কি ও জার্মান ভাষায় শব্দের সংখ্যা বেশি। শেক্সপিয়ার বহু শব্দ তৈরি করে দিয়ে গেছেন। জীবনানন্দের মতন বিনয় মজুমদারও বেশ কয়েকটি শব্দ তৈরি করেছেন। আটের দশক থেকে কবিরা শব্দ তৈরি করছেন, কলকাতার সাধারণ মানুষও সমবেত শব্দ তৈরি করেন। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি কমিটি না থাকায় শব্দ সংগ্রহ করে অভিধানে ঢোকানো হয় না।

বিনয় মজুমদারের কোন ধরণের স্কিৎসোফ্রেনিয়া হয়েছিল তা তাঁর হাসপাতালের কাগজ দেখে গবেষকরা বের করবেন কখনও, আশা করি। তাঁর অসংলগ্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসফল আশপাশের মানুষেরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিতেন মানসিক চিকিৎসালয়ে। এই প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের পাগলাগারদ সমূহের পরিদর্শক আমি। আমার সরকারি চাকরিই তাই। যা বেতন পাই তাতে মোটামুটি সংসার চলে যায় — একার সংসার।” ১৯৯৩ সালে সঞ্জয় চক্রবর্তীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে যখন ছিলেন, “তখন কেউই বড়ি-ফড়ি কিছু খাওয়াতেও এলো না। ইনজেকশানও দিতে এলো না। তোফা ছিলাম। আর ভারতবর্ষে আমাকে সাতবার পাগলাগারদে পোরা হয়েছে। অনেকেই তো পাগলাগারদে ছিলেন। তাঁদের জীবনীতে তা লেখা হয় না। আর আমার জীবনী লিখতে গেলে প্রথম বাক্যই লেখে— গোবরা মানসিক হাসপাতালে ছিলেন। পাগলাগারদে আর কে কে ছিলেন শুনবে? লুম্বিনী পার্কে ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক। এঁদের জীবনী যখন লেখে তখন তো একথা এভাবে লেখে না যে এঁরা পাগলা গারদে ছিলেন। অথচ আমার ক্ষেত্রে প্রথমেই ওই কথা— মানসিক হাসপাতালে ছিলেন।”

আমাদের মানসিক অবস্থা দিয়ে আমাদের প্রকৃতিস্থতা সংজ্ঞায়িত হয় না। হয় আমাদের বেঁচে থাকার উপরিতল দিয়ে– বিনয়ের উপরোক্ত কবিতার ক্ষেত্রে ‘মাংসভক্ষণ’ নিষ্ঠুরতাকে গোপন করে রেখেছে, মানুষের নিষ্ঠুরতা, প্রতিপদে সামনের শত্রুকে খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র। এই নিষ্ঠুরতা যেন সহ্য হয়ে-যাওয়া নৈতিকতা। প্রতি রাতেই যে তা ঘটে তা বিনয়’ বাল্মীকির কবিতা’য় আমাদের দেখিয়েছেন। মানুষের মাংসভক্ষণ হয়ে ওঠে মানুষের অন্তরাত্মার ভক্ষণ। এই কবিতাটি পড়ে দেখা যাক:

মাংস খাওয়া

আমি যদি মুরগির মাংস খাই
তাতে মুরগির উপকার হয়।
জীবিত অবস্থায় ছিল তুচ্ছ মুরগি
তার মাংসে খুব উন্নত স্তরের কিছু ছিল।
প্রবাদ বাক্য হচ্ছে মাংসে মাংস বৃদ্ধি।
তার মানে যখন মুরগির মাংস খেলাম
তখন সে মুরগির মাংস আমার শরীরের
মাংস হয়ে গেল।
তার মানে সবই বুঝতে পারি
আমার শরীরের মাংস মুরগির
মাংসের চেয়ে উন্নত স্তরের কিছু।
এতে দেখা যাচ্ছে মুরগির উপকার হয়ে গেল। চলবে