বেণীমাধব বড়ুয়া রচিত ‘মধুপিণ্ডিক সূত্র’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০২০

বৌদ্ধশাস্ত্রে পণ্ডিত ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার আজ জন্মদিন। ১৮৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান থানার মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামে তার জন্ম। পিতা রাজচন্দ্র তালুকদার ছিলেন কবিরাজ এবং মাতা ধনেশ্বরী দেবী। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার রচিত ‘মধুপিণ্ডিক সূত্র’ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

১. একসময় ভগবান শাক্যরাজ্যে অবস্থান করিতেছিলেন, কপিলবাস্তু-সন্নিধানে, ন্যগ্রোধারামে। ভগবান পূর্বাহ্ণে বহির্গমন-বাস পরিধান করিয়া, পাত্রচীবর লইয়া কপিলবাস্তুতে ভিক্ষান্নের জন্য প্রবেশ করিলেন। কপিলবাস্তুতে ভিক্ষার্থ বিচরণ করিয়া ভোজন সমাপনান্তে ভিক্ষাসংগ্রহ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া যেখানে মহাবন সেখানে দিবাবিহারের জন্য উপস্থিত হইলেন। মহাবনে প্রবিষ্ট হইয়া তিনি তরুণ বেণুযষ্টিমূলে দিবাবিহার-ব্যপদেশে উপবেশন করিলেন। দণ্ডপাণি শাক্য পাদচারণ করিতে করিতে যেখানে মহাবন সেখানে উপস্থিত হইলেন। মহাবনে প্রবেশ করিয়া তিনি যেখানে তরুণ বেণুযষ্টি, যেখানে ভগবান সমাসীন ছিলেন, সেখানে উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানের সহিত প্রীত্যালাপচ্ছলে কুশলপ্রশ্নাদি বিনিময় করিয়া যষ্টিতে ভর দিয়া একান্তে দাঁড়াইলেন। একান্তে দাঁড়াইয়া দণ্ডপাণি শাক্য ভগবানকে কহিলেন, ‘শ্রমণ কী মতবাদী, কী আখ্যায়ী?’ ‘দণ্ডপাণি, যথাবাদী (যথার্থবাদী পুরুষ) কি দেবলোকে, কি মারভুবনে, কি শ্রমণ-ব্রাহ্মণমণ্ডলে, কি দেবমনুষ্য-মধ্যে, কোনো লোকেই বাদবিসংবাদ করিয়া অবস্থান করেন না এবং যেভাবে কাম হইতে বিসংযুক্ত হইয়া অবস্থান করিলে অকথংকথী (অসন্দিগ্ধ), কৌকৃত্য (মনস্তাপ) হইতে বিচ্ছিন্ন ও ভবাভবে বীততৃষ্ণ ব্রাহ্মণের মধ্যে ক্লেশসংজ্ঞা (ক্লেশচেতনা, পাপচেতনা) অনুশয় উৎপাদন করে না-আমি এই মতবাদী, এই আখ্যায়ী।’ ইহা বিবৃত হইলে দণ্ডপাণি শাক্য শির কম্পিত করিয়া, জিহ্বা বাহির করিয়া, ললাটে ত্রি-ভ্রূভঙ্গ করিয়া যষ্টিতে ভর দিয়া প্রস্থান করিলেন।

২. অতঃপর ভগবান সায়াহ্নে সমাধি হইতে উঠিয়া ন্যগ্রোধারামে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন, উপবিষ্ট হইয়া ভগবান সমবেত ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন, আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে ভিক্ষুগণ, আমি পূর্বাহ্ণে বহির্গমন-বাস পরিধান করিয়া পাত্রচীবর লইয়া ভিক্ষান্নসংগ্রহের জন্য কপিলবাস্তুতে প্রবেশ করিলাম। কপিলবাস্তুতে ভিক্ষার্থ বিচরণ করিয়া ভোজন সমাপনান্তে ভিক্ষান্নসংগ্রহ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া যেখানে মহাবন সেখানে দিবাবিহারের জন্য উপস্থিত হইলাম। মহাবনে প্রবিষ্ট হইয়া আমি তরুণ বেণুযষ্টিমূলে দিবাবিহার-ব্যপদেশে উপবেশন করিলাম। দণ্ডপাণি শাক্য পাদচারণ করিতে করিতে যেখানে মহাবন সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মহাবনে প্রবেশ করিয়া যেখানে তরুণ বেণুযষ্টি, যেখানে আমি সমাসীন, সেখানে উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া আমার সহিত প্রীত্যালাপচ্ছলে কুশলপ্রশ্নাদি বিনিময় করিয়া যষ্টিতে ভর দিয়া একান্তে দাঁড়াইলেন। একান্তে দাঁড়াইয়া দণ্ডপাণি শাক্য আমাকে কহিলেন, ‘শ্রমণ কী মতবাদী, কী আখ্যায়ী?’ ‘যথাবাদী (পুরুষ) কি দেবলোকে, কি মারভুবনে, কি ব্রহ্মলোকে, কি শ্রমণ-ব্রাহ্মণমণ্ডলে, কি দেবমনুষ্য-মধ্যে কোনো লোকেই বাদবিসংবাদ করিয়া অবস্থান করেন না, এবং যেভাবে কাম হইতে বিসংযুক্ত হইয়া অবস্থান করিলে অকথংকথী, কৌকৃত্য হইতে বিচ্ছিন্ন ও ভবাভবে বীততৃষ্ণ ব্রাহ্মণের মধ্যে ক্লেশসংজ্ঞা (ক্লেশচেতনা, পাপচেতনা) অনুশয় উৎপাদন করে না-আমি এই মতবাদী, এই আখ্যায়ী।’ ইহা বিবৃত হইলে দণ্ডপাণি শাক্য শির কম্পিত করিয়া, জিহ্বা বাহির করিয়া, ললাটে ত্রি-ভ্রূভঙ্গ করিয়া যষ্টিতে ভর করিয়া প্রস্থান করিলেন।

৩. ইহা বিবৃত হইলে জনৈক ভিক্ষু ভগবানকে কহিলেন, ‘প্রভো, কী মতবাদী বলিয়া ভগবান দেবলোকে, মারভুবনে, ব্রহ্মলোকে, শ্রমণ-ব্রাহ্মণমণ্ডলে দেবমনুষ্য কোনো লোকেই বাদবিসংবাদ করিয়া অবস্থান করেন না? প্রভো, কিরূপেই বা কাম হইতে বিসংযুক্ত হইয়া অবস্থান করিলে অকথংকথী, কৌকৃত্য হইতে বিচ্ছিন্ন ও ভবাভবে বীততৃষ্ণ সেই ভাগ্যবান ব্রাহ্মণের মধ্যে ক্লেশসংজ্ঞা (ক্লেশচেতনা, পাপচেতনা) অনুশয় উৎপাদন করে না?’ যে কারণে ভিক্ষুগণ ব্যক্তিবিশেষে প্রপঞ্চসংজ্ঞা নির্দেশ করেন তাহাতে ‘আমার’ বলিয়া আনন্দিত হইবার কিছু না থাকিলে, ‘আমি’ বলিয়া প্রকাশ করিবার কিছু না থাকিলে, আমিত্ব-গ্রহণের কিছু না থাকিলে, তাহাই রাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, প্রতিঘানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, দৃষ্টি-অনুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, বিচিকিৎসানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, মানানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, ভবরাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, অবিদ্যানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়; দণ্ডোত্থোলন, শস্ত্রোত্থোলন, কলহ, বিগ্রহ, বিবাদবিসংবাদ, ‘তুই তুই’ বাক্যবিনিময়, পিশুন এবং মৃষাবাদের অন্তসাধনের উপায় হয়—এ স্থলে এই সকল পাপ ও অকুশল ধর্ম নিরবশেষে নিরুদ্ধ হয়। ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন। ইহা বিবৃত করিয়া সুগত আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বিহারে প্রবেশ করিলেন।

৪. ভগবান প্রস্থান করিতে না করিতে অচিরে সমবেত ভিক্ষুগণের মধ্যে এই চিন্তা উদিত হইল : বন্ধুগণ, ভগবান বিষয়টি সংক্ষেপে উদ্দেশ করিয়া বিশদভাবে উহার অর্থবিভাগ না করিয়া আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বিহারে প্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহার উক্তি হইল : যে কারণে ভিক্ষুগণ ব্যক্তিবিশেষকে প্রপঞ্চসংজ্ঞায় নির্দেশ করেন তাহাতে ‘আমার’ বলিয়া আনন্দিত হইবার কিছু না থাকিলে, ‘আমি’ বলিয়া প্রকাশ করিবার কিছু না থাকিলে, আমিত্ব-গ্রহণের কিছু না থাকিলে, তাহাই রাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, প্রতিঘানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, দৃষ্টি-অনুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, বিচিকিৎসানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, মানানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, ভবরাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, অবিদ্যানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়; দণ্ডোত্থোলন, শস্ত্রোত্থোলন, কলহ, বিগ্রহ, বিবাদবিসংবাদ, ‘তুই তুই’ বাক্যবিনিময়, পিশুন এবং মৃষাবাদের অন্তসাধনের উপায় হয়-এ স্থলে এই সকল পাপ ও অকুশল ধর্ম নিরবশেষে নিরুদ্ধ হয়। ভগবানের এই সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট এবং বিশদভাবে অব্যাখ্যাত উক্তির বিশদ অর্থবিভাগ কী? অতঃপর তাঁহাদের মনে এই চিন্তা উদিত হইল : কেন আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ন তো স্বয়ং শাস্তা কর্তৃক এবং বিজ্ঞ সতীর্থগণ কর্তৃক সংবর্ণিত ও সুপ্রশংসিত। তিনিই সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট এবং বিস্তারিতভাবে অব্যাখ্যাত ভগবানের এই উক্তির বিশদ অর্থ করিতে সমর্থ। অতএব আমরা আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়নের নিকট উপস্থিত হইব এবং উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে ইহার অর্থ জিজ্ঞাসা করিব।

অনন্তর ভিক্ষুগণ আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়নের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত প্রীত্যালাপচ্ছলে কুশলপ্রশ্নাদি বিনিময় করিয়া সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহারা আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়নকে কহিলেন, বন্ধু কাত্যায়ন, ভগবান সংক্ষেপে উদ্দেশ করিয়া এবং বিস্তারিতভাবে অর্থবিভাগ না করিয়া এই উক্তি করিয়া আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বিহারে প্রবেশ করিয়াছেন। তাঁহার উক্তি এই : যে কারণে ভিক্ষুগণ ব্যক্তিবিশেষকে প্রপঞ্চসংজ্ঞায় (ব্যবহারিক সংজ্ঞায়) নির্দেশ করেন তাহাতে ‘আমার’ বলিয়া আনন্দিত হইবার কিছু না থাকিলে, ‘আমি’ বলিয়া প্রকাশ করিবার কিছু না থাকিলে, আমিত্ব-গ্রহণের কিছু না থাকিলে, তাহাই রাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, প্রতিঘানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, দৃষ্টি-অনুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, বিচিকিৎসানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, মানানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, ভবরাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, অবিদ্যানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়; দণ্ডোত্থোলন, শস্ত্রোত্থোলন, কলহ, বিগ্রহ, বিবাদ-বিসংবাদ, ‘তুই তুই’ বাক্যবিনিময়, পিশুন এবং মৃষাবাদের অন্তসাধনের উপায় হয়—এ স্থলে এই সকল পাপ ও অকুশল ধর্ম নিরবশেষে নিরুদ্ধ হয়। আমাদের মনে চিন্তা হইল, আমাদের মধ্যে কে সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট এবং বিস্তারিতভাবে অব্যাখ্যাত ভগবানের এই উক্তির বিশদ অর্থ করিতে পারিবেন? তখন আমাদের মনে এই চিন্তা উদিত হইল : কেন আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ন তো স্বয়ং শাস্তা কর্তৃক এবং বিজ্ঞ সতীর্থগণ কর্তৃক সংবর্ণিত ও সুপ্রশংসিত; তিনি সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট এবং বিস্তারিতভাবে অব্যাখ্যাত ভগবানের এই উক্তির বিশদভাবে অর্থ করিতে সমর্থ। অতএব আমরা তাঁহার নিকট উপস্থিত হইব, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে ইহার অর্থ জিজ্ঞাসা করিব, ইহার অর্থ ব্যাখ্যা করিতে বলিব।

৫. বন্ধুগণ, যেমন সারার্থী, সারান্বেষী কোনো ব্যক্তি সারান্বেষণে বিচরণ করিতে গিয়া বৃহৎ সারবান বৃক্ষ থাকিতে তাহা ত্যাগ করিয়া বৃক্ষের মূল ছাড়িয়া বৃক্ষের কাণ্ডে ও শাখাপল্লবে সারান্বেষণ করা উচিত মনে করে, আয়ুষ্মানগণের ব্যাপারেও ঠিক তেমনই মনে হইতেছে। শাস্তার সম্মুখে থাকিতে তাঁহাকে অতিক্রম করিয়া নগণ্য আমাকে তাঁহার উক্তির অর্থ জিজ্ঞাসা করা আপনারা উচিত মনে করিয়াছেন। বন্ধুগণ, সেই ভগবান জানিবার যাহা জানেন, দেখিবার যাহা দেখেন, তিনি চক্ষুস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, ধর্মস্বরূপ, ব্রহ্মস্বরূপ, তিনি বক্তা, প্রবক্তা, অর্থনিয়ন্তা, অমৃতের দাতা, ধর্মস্বামী, তথাগত, তখনোই তো ঠিক সময় ছিল যখন আপনারা ভগবানকে তাঁহার উক্তির অর্থ জিজ্ঞাসা করিয়া এ কথা বলিতে পারিতেন : ‘ভগবান, আমাদের নিকট যেভাবে উক্তির ব্যাখ্যা করিবেন, আমরা তাহা সেইভাবে অবধারণ করিব।’ বন্ধু কাত্যায়ন, ভগবান সত্যই জানিবার যাহা জানেন, দেখিবার যাহা দেখেন, তিনি চক্ষুস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, ধর্মস্বরূপ, ব্রহ্মস্বরূপ, তিনি বক্তা, প্রবক্তা, অর্থনিয়ন্তা, অমৃতের দাতা, ধর্মস্বামী, তথাগত। বাস্তবিক তখনোই সময় ছিল যখন আমরা তাঁহাকে তাঁহার উক্তির অর্থ জিজ্ঞাসা করিয়া এ কথা বলিতে পারিতাম : ‘ভগবন, আমাদের নিকট যেভাবে অর্থ ব্যাখ্যা করিবেন আমরা সেভাবে তাহা অবধারণ করিব।’ তথাপি আমরা জানি যে, আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ন স্বয়ং শাস্তা কর্তৃক ও সতীর্থগণ কর্তৃক সংবর্ণিত ও সুপ্রশংসিত; তিনিই তো সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট এবং বিস্তারিতভাবে অব্যাখ্যাত ভগবানের এই উক্তির বিশদভাবে অর্থ করিতে সমর্থ। অতএব, মহাকাত্যায়ন আমাদিগকে অবহেলা না করিয়া ভগবানের উক্তির ব্যাখ্যা করুন।

৬. বন্ধুগণ, তাহা হইলে তোমরা শ্রবণ করো, সুন্দরভাবে মনোনিবেশ করো, আমি তাহা বিবৃত করিতেছি। ‘তথাস্তু বলিয়া অপর ভিক্ষুগণ সম্মতি জানাইলেন। আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ন কহিলেন, ভগবান সংক্ষেপে উদ্দেশ করিয়া এবং বিস্তারিতভাবে অর্থ না করিয়া যে উক্তি-মাত্র করিয়া আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বিহারে প্রবেশ করিয়াছেন, সেই উক্তি হইতেছে এই : যে কারণে ভিক্ষুগণ ব্যক্তিবিশেষকে প্রপঞ্চসংজ্ঞায় নির্দেশ করেন, তাহাতে ‘আমার’ বলিয়া আনন্দিত হইবার কিছু না থাকিলে, ‘আমি’ বলিয়া প্রকাশ করিবার কিছু না থাকিলে, আমিত্ব-গ্রহণের কিছু না থাকিলে, তাহাই রাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, প্রতিঘানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, দৃষ্টি-অনুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, বিচিকিৎসানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, মানানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, ভবরাগানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়, অবিদ্যানুশয়ের অন্তসাধনের উপায় হয়; দণ্ডোত্থোলন, শস্ত্রোত্থোলন, কলহ, বিগ্রহ, বিবাদবিসংবাদ, ‘তুই তুই’ বাক্যবিনিময়, পিশুন এবং মৃষাবাদের অন্তসাধনের উপায় হয়।—এ স্থলে এই সকল পাপ ও অকুশল ধর্ম নিরবশেষে নিরুদ্ধ হয়।

সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট এবং বিস্তারিতভাবে অব্যাখ্যাত ভগবদুক্তির বিস্তারিত অর্থ আমি এইরূপে জানাইতেছি : বন্ধুগণ, চক্ষুর কারণ রূপে চক্ষুবিজ্ঞান উৎপন্ন হয়, এ তিনের সঙ্গতিতে (সংযোগে) স্পর্শ, স্পর্শ-প্রত্যয় হইতে বেদনা উৎপন্ন হয়, বেদনায় যাহা বেদিতসংজ্ঞায় তাহা সংজানিত, সংজ্ঞায় যাহা সংজানিত বিতর্কে তাহা বিতর্কিত, বিতর্কে যাহা বিতর্কিত প্রপঞ্চে তাহা প্রপঞ্চিত, প্রপঞ্চে যাহা প্রপঞ্চিত তাহার কারণেই লোকে অতীত, অনাগত ও প্রত্যুৎপন্ন (বর্তমান) চক্ষু-বিজ্ঞেয়রূপে প্রপঞ্চ-সংজ্ঞা প্রবর্তিত হয়। শ্রোত্র, শব্দ এবং শ্রোত্রবিজ্ঞান, কায়, স্পর্শ এবং কায়বিজ্ঞান, মন, ধর্ম এবং মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধেও এইরূপ।

যদি চক্ষু, রূপ এবং চক্ষুবিজ্ঞান থাকে, সে ক্ষেত্রে স্পর্শ বলিয়া কোনো প্রজ্ঞপ্তি কেহ নির্দেশ করিবে, এহেন সম্ভাবনা আছে। স্পর্শ-প্রজ্ঞপ্তি থাকিলে বেদনা-প্রজ্ঞপ্তি, বেদনা-প্রজ্ঞপ্তি থাকিলে সংজ্ঞা-প্রজ্ঞপ্তি, সংজ্ঞা-প্রজ্ঞপ্তি থাকিলে বিতর্ক-প্রজ্ঞপ্তি, বিতর্ক-প্রজ্ঞপ্তি থাকিলে প্রপঞ্চ-সংজ্ঞা-সংখ্যা-নির্দেশক-প্রজ্ঞপ্তি কেহ নির্দেশ করিবে, এহেন সম্ভাবনা আছে। শ্রোত্র, শব্দ ও শ্রোত্রবিজ্ঞান, ঘ্রাণ, গন্ধ ও ঘ্রাণবিজ্ঞান, জিহ্বা, রস ও জিহ্বাবিজ্ঞান, কায়, স্পর্শ ও কায়বিজ্ঞান, মন ধর্ম ও মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধেও এইরূপ।

যদি চক্ষু না থাকে, রূপ না থাকে চক্ষুবিজ্ঞান না থাকে, সে ক্ষেত্রে স্পর্শ নামে কোনো প্রজ্ঞপ্তি নির্দেশ করিবে, এহেন সম্ভাবনা নাই। স্পর্শ-প্রজ্ঞপ্তি না থাকিলে বেদনা-প্রজ্ঞপ্তি, বেদনা-প্রজ্ঞপ্তি না থাকিলে সংজ্ঞা-প্রজ্ঞপ্তি, সংজ্ঞা-প্রজ্ঞপ্তি না থাকিলে প্রপঞ্চ-সংজ্ঞা-সংখ্যা-নির্দেশক-প্রজ্ঞপ্তি কেহ নির্দেশ করিবে, এহেন সম্ভাবনা নাই। শ্রোত্র, শব্দ ও শ্রোত্রবিজ্ঞান, ঘ্রাণ, গন্ধ ও ঘ্রাণবিজ্ঞান, জিহ্বা, রস ও জিহ্বাবিজ্ঞান, কায়, স্পর্শ ও কায়বিজ্ঞান, মন, ধর্ম ও মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধেও এইরূপ।

বন্ধুগণ, সংক্ষেপে উদ্দেশ করিয়া এবং বিস্তারিতভাবে অর্থ ব্যাখ্যা না করিয়া যে উক্তি করিয়া ভগবান আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বিহারে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, আমি এই উক্তির অর্থ বিস্তারিতভাবে এইরূপে জানাইতেছি; যদি তোমরা ইচ্ছা করো, তাহা হইলে ভগবানের নিকট যাইয়া এ বিষয় জিজ্ঞাসা করিতে পার এবং তিনি এ বিষয়ে তোমাদিগকে যাহা যেইরূপে বলেন, তাহা তোমরা সেইরূপেই অবধারণ করিবে।

৭. অতঃপর ওই ভিক্ষুগণ আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়নের বাক্যে আনন্দ প্রকাশ করিয়া এবং তাহা অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উঠিয়া ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে যথাবিধি অভিবাদন করিয়া সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহারা ভগবানকে আনুপূর্বিক সকল বিষয় নিবেদন করিলেন : প্রভো, আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ন দ্বারা এই আকারে ও এই পদব্যঞ্জনে ভগদ্বাক্যের অর্থ বিভাজিত হইয়াছে। ‘হে ভিক্ষুগণ, মহাকাত্যায়ন মহাপ্রাজ্ঞ, সুপণ্ডিত। যদি তোমরা আমাকে আমার উক্তির অর্থ জিজ্ঞাসা করিতে, তাহা হইলে মহাকাত্যায়ন দ্বারা তাহা যেভাবে ব্যাখ্যাত হইয়াছে, আমিও ঠিক সেইভাবেই ব্যাখ্যা করিতাম। ইহাই বস্তুত আমার উক্তির অর্থ এবং এইভাবেই তোমরা তাহা অবধারণ করো।’

৮. ইহা বিবৃত হইলে আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে কহিলেন, প্রভো, যদি কোনো ক্ষুধাতৃষ্ণাতুর ব্যক্তি মধুপিণ্ড লাভ করে, সে যেমন যখনই তাহা আস্বাদন করে তাহাতে যথাপরিমিত স্বাদুরস লাভ করে, প্রভো, তেমনভাবেই যখন কোনো চিন্তাশীল এবং পণ্ডিতজাতীয় ভিক্ষু প্রজ্ঞার দ্বারা এই ধর্ম-পর্যায়ের (সূত্রের) অর্থ উপর্যুপরি পরীক্ষা করিবেন, তাহাতে তিনি মনের প্রফুল্লতা লাভ করিবেন, চিত্তপ্রসাদ লাভ করিবেন।

‘প্রভো, এই ধর্ম-পর্যায়ের নাম কী হইবে?’ আনন্দ, যেহেতু তুমি মধুপিণ্ডের সহিত ইহার তুলনা করিয়াছ, তুমি এই ধর্ম-পর্যায়কে মধুপিণ্ডিক ধর্ম-পর্যায় নামে অবধারণ করো।

ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন। আয়ুষ্মান আনন্দ তাহা প্রসন্নমনে শ্রবণ করিয়া আনন্দ প্রকাশ করিলেন।