বেশ্যাকন্যা

পর্ব ৮

সরদার মেহেদি হাসান

প্রকাশিত : মার্চ ০৩, ২০১৮

এ পর্যন্ত কত টাকা খরচ করেছি তার হিসেব পরে করি, আপাতত টাঙ্গাইল যাবার হিসাব করি। আমি ডিভি ক্যাসেট কিনলাম তিন ঘণ্টা সময়ের ১০টি, অর্থাৎ ৩০ ঘণ্টার সময় ধারণের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছি কান্দাপট্টিতে। ২০০৭ সাল। খুব সকালে আমরা আমাদের শুটিং ইউনিট নিয়ে রওনা দিই। প্রতিটি সদস্যের মনেই এক অজানাকে জয় করবার প্রত্যাশা। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি... হঠাৎ! ফোনে রিং বেজে উঠলো, টাঙ্গাইল থেকে মওলা ভাই ফোন দিয়েছেন।

হ্যালো, মেহেহি ভাই?
আসসালামু ওয়ালাইকুম, ভাই, কেমন আছেন, কি খবর?
আপনারা কি রওনা দিয়েছেন?
হ্যাঁ আমরা... তো মাইক্রোতে।
একটু সমস্যা হয়ে গেছে!
কি সমস্যা?
না, তেমন কিছু না, ডিসি ও এসপি মহোদয় আপনার শুটিংয়ের ব্যাপারে না করেছেন।
কারণ কি?
ব্রথেল থেকে কেউ হয়তো কিছু বলেছে।
তাহলে এখন কি করব?
সমস্যা নেই, চলে আসেন, দেখছি বিষয়টা।
আচ্ছা, ঠিক আছে।

আমরা এখন অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্থ মন নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এর মধ্যে গাড়ির গ্যাস নেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমরা চান্দুরা পার হয়ে একটু সামনের দিকের একটি গ্যাস পাম্পে ঢুকলাম। গ্যাস নেয়া চলছে, এর মধ্যে আবার ফোন, মওলা ভাই।
মেহেহি ভাই, আপনারা কত দূর?
বড়ভাই, আমরা চান্দুরা।
আচ্ছা ঠিক আছে, আপনারা সরাসরি কান্দাপট্টি গিয়ে শুটিং শুরু করে দেন। আমি ডিসি মহোদয়ের কাছ থেকে আপনার নামে লিখিত অনুমতিপত্র নিয়েছি।
ধন্যবাদ বড়ভাই, আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
ওকে, বেস্ট অফ লাক।
ওকে ভাই।
এবার আমরা নীল আকাশের সীমানা ছোঁয়ার প্রত্যাশায় অতিবুভুক্ষু কাজের মন নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে পৌঁছে গেলাম টাঙ্গাইলের কান্দাপট্টি পতিতাপল্লীর সামনে। আমাদের আগমনে পাখিদের কলরবে মনে হয় কিছুটা বিঘ্ন ঘটল। তারপরও পাখিদের কলরব সেই আদিকাল থেকে চলছে... এখনও চলমান।

সহকারী ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা ভিডিও ধারণের জন্য প্রস্তুত করে দিলো। মামুন সেইটি কখনও কাঁধে, কখনও সম্মুখ প্রান্তে দু-হাতের উপর, কখন-বা ক্যামেরা স্টান্ডের ওপর ক্যামেরা রেখে ভিডিও ধারণ শুরু করল। আমার নির্দেশনা ছিল, কোনও অবস্থাতেই ক্যামেরার রেকর্ড যাতে বন্ধ না হয়। ক্যামেরা চলছে... চলছেই...

অজস্র টিনশেডের আধা-পাকা ঘর। মূল রাস্তার কোল-ঘেঁষে ময়লা পানি নিষ্কাশনের ড্রেন। তার উপর সম্মুখভাগের সকল ঘরের সামনে বিছানো রয়েছে ইট-সিমেন্টের পাটাতন। আর তারই উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনবরত কিচিরমিচির করে চলেছে অগণিত কুহু- কোকিলের দল। আমরা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত... আমাদের বিশ্রাম করবার সময় নেই। আমরা সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠী। আমরা দিন আনি... দিন খাই, আমাদের স্বপ্ন দেখার পরিধি সীমিত। আমরা সমাজের উচ্ছিষ্ট খাবারের আশায় দিন করি পার। আমরা পাঁচ-তারকা হোটেলে নিচের ফুটপাতে অনিদ্রায় কাটিয়ে দিতে পারি রাত। আমরা বিমানের পাখার ভিতর গোপনে পাড়ি দিতে পারি বিদেশ, আমাদের ঘামে-ভেজা শরীরের গন্ধে মৌ মৌ করে গোটা দেশ। আমি একজন বাবা, আমি একজন সন্তান, আমি একজন ভাই, আমি একজন আশাহত বেকার যুবক। আমার বিয়ে নামক বস্তুটির প্রতি ব্যাপক ভয়। আমি আজ সত্যিই পরিশ্রান্ত। আমি জীবনের খানিকটা প্রশান্তি লাভের আশায় ছুটে এসেছি পাখিদের এই কলরবে, লোকে আমায় বেশ্যাদের খদ্দের বলে। খদ্দের শব্দটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য হলেও বড়লোকদের জন্য এই ভাষাটি ভিন্ন।

আমাদের ক্যামেরা চলমান... ঘরের দরজায় উড়ছে পাখি... হাতে শাঁখা... কপালে সিদুঁর... ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপিস্টিক... সঙ্গে কালো লিপ-লাইনার... বাম নাসিকায় স্বর্ণের নাকফুল... কাঁচা হাতের ভ্রু-প্লাক... সুবিস্তার কপালের নিচে অতি যত্নে স্থাপিত ছোট্ট লাল টিপ পরিহিতা মেয়েটি খদ্দেরের আশায় চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। ক্যামেরার নড়াচড়াতে ঘরের দরজার পর্দার আড়ালে গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন নারী। একজনের মুখে চিরুনি, অন্যজনের মুখে নিজের কাঁধের ওড়নার চিকন পাড়। তাদের দু’চোখে প্রশ্নের বিশালতা।। ঘরের সামনের সরু গলির সম্মুখভাগে। ময়লা রাখার সামান্য দূরে বসে থেকে খাবার গ্রহণে ব্যস্ত এক বয়স্ক মহিলা। হাতে তার সিলভারের থালা। তাতে কিছু তরকারি, সাদা ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে, সারা জীবনের অব্যক্ত ক্ষুধাকে বিতাড়নের চেষ্টা করছে। তার এই নিঃসঙ্গ জীবনটাকে কিছুটা হলেও ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রেখেছে তার পোষা বিড়ালটি। যে কিনা অতি আহ্লাদে মহিলাটির পায়ে লুটোপুটি খাবার চেষ্টা করছে। বেশ্যার বিড়াল এবং ধনীর বিড়াল, পার্থক্যটা কেমন জানি বিড়াল নির্ভর। গলির পথ ধরে এগুতে থাকি। একজন নারী ডান হাতে ভাতের প্লেট নিয়ে অন্য হাতে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুখ লুকিয়ে দ্রুত গতিতে পালিয়ে যাচ্ছে ক্যামেরা তথা এদেশের অগণিত উৎসুক জনতার চোখ এড়িয়ে।। কোনও একজন অতি যত্নে হাসিমুখে খদ্দের নিয়ে ঘরে ঢুকছে। ছোট্ট শিশুগুলো যেন ভবিষ্যতের বেশ্যাপল্লীর কাণ্ডারি হিসেবে বেড়ে উঠছে বলে মনে হয়। পৃথিবীর এই সভ্য জগতের এই প্রান্তে এসে একজন নারী পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হতে পারে, তা এই জগতের নারী বা শিশুরা জানে না। তারা (পতিতাপল্লীর শিশু) জানে, এই পল্লীই তাদের পৃথিবী। এই পল্লীর সীমানা প্রাচীর তাদের ভবিষ্যত জীবন ধারণের স্থান। তাদের জন্মই হয়েছে শুধুই বেশ্যাবৃত্তি করবার জন্য। জীবনে বেশ্যাপনার তাগিদে দেশের অন্য সকল বেশ্যাপল্লী কিংবা ভাগ্যক্রমে সোনাগাছী যেতে পারে। অবাক পৃথিবীর অবাক রীতি। ছোট্ট ছেলে শিশুটি আগ্রহবশত কোনও ঘরের পর্দা উচিয়ে উঁকি মারে, ঘর থেকে মেয়ের ধমক, ওই, এখানে দাঁড়ায়ে রইছস ক্যা? ভাগ...

ছেলেটি ধ্যাত বলে দৌড় দেয়।। নববধূ বছর যেতেই বমি করবে... সে তো আনন্দের খবর, যাও যাও মিষ্টি বিলাও। এখানে বমি করলে... বেশ্যার বেটি... বড়ি খাস নাই ক্যা? কনডম ছাড়া খদ্দের নিস ক্যা? কত কি? তাই তো চোখে পড়ে, গাঢ় সবুজ সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়েটি সযত্নে ধরে রেখেছে গোলাপি রঙের কাপড় পরিহিতা বমিরত দ্বিধাগ্রস্থ মেয়েটিকে। ধ্যাততেরি... আবার পেট ফেলতে হবে...

ক্যামেরা চলছে তো চলছেই...

চলবে...