
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ১৪
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ১০, ২০১৮
ভোরে ঢাকায় ফিরলাম। আমি থাকি মৌচাক, মালিবাগে। আরটিভিতে চাকরিরত অবিবাহিত ব্যাচেলার আমি। আমি ও আমার এক কাজিন তামিমুল ইসলাম বর্তমানে সময় টিভিতে সিনিয়র ভিজ্যুয়াল এডিটর হিসেবে কর্মরত আছে, আমরা দুজন থাকতাম একটি দু’রুমের বাসা নিয়ে। তামীম তখন ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ছে। আমার আরটিভিতে চাকরি করবার সুবাদে সে সব সময়ই চাইত মিডিয়াতে কাজ করতে। তাই সে আমার কাছে এডিটিং এবং আমার এক সহকর্মীর কাছে এনিমেশন শেখার জন্য বাসায় একটা পিসি কিনল। এতে আমার অনেক সুবিধা হলো। কারণ আমার প্রায় ত্রিশ ঘণ্টার রাশ ফুটেজ ছিল, যা নিয়ে বাইরের কোনও হাউজে কাজ করতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। যাই হোক, সেই পিসিতেই আমি আমার ডকুমেন্টরির এডিটিংয়ের কাজ শুরু করলাম। আমার স্ক্রিপ্ট আগেই লেখা ছিল। আমার এখন ভয়েজ-ওভার দরকার। আমি কথা বললাম মঞ্জু ভাইয়ের সাথে। অধ্যাপক মনজুরুল হক হচ্ছেন একজন লেখক, গবেষক, স্ক্রিপ্ট রাইটার, কবি, জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। ওনার সাথে রয়েছে আমার দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক। উনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষি। ওনার কণ্ঠে মুগ্ধতা রয়েছে। আমি ওনাকে আমার স্ক্রিপ্ট দিলাম। উনি পড়লেন। বুঝলেন এবং ধ্বনি রেকর্ডিং স্টুডিওতে ভয়েজ দিলেন। সাউন্ড এডিটর সেলিম ভাই অতি যত্নে ভয়েজ টেক করলেন। আমার কাজ এখন প্রায় অনেকটাই গুছিয়ে ফেলেছি। সাব-টাইটেলের কাজও শেষ। গ্রাফিক্স ও বাকগ্রাউন্ড মিডজিক বসিয়ে এখন এটি ২০ মিনিটের পরিপূর্ণ ডকুমেন্টরিতে রূপ নিয়েছে। টাঙ্গাইল ফেরার প্রায় এক মাস পর এসএসএস থেকে মওলা ভাই ফোনে জানান, সামনের সপ্তাহে তাদের অফিসে, এসএসএস এর সকল থানা ও জেলা অফিসারদের সাধারণ সভা আছে। সেই সভাতে ওনারা এই ডকুমেন্টরিটি সবাই মিলে দেখতে চান। সেখানে তাদের অফিসের দুশো জনের পাশাপাশি আমি ও মেরি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকব। আমি রাজি হলাম এবং যথাসময়ে ডকুমেন্টরি নিয়ে সেখানে হাজির হলাম।
সবাই বিশাল এক হলরুমে বসলেন। অন্ধকার ঘর। প্রজেক্টরে আমার নির্মিত ডকুমেন্টরি ‘অন্ধকারের আলো’ প্রদর্শিত হচ্ছে। সবাই নীরব। মনোযোগ সহকারে দেখছে। মেরি অন্ধকারে আলোকিত একটি নাম। একটি মেয়ে। যে তার নিজের শিক্ষার আলো দিয়েই নিজের জীবনকে আলোকিত করতে চায়। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আসা বলেই কি থেমে থাকবে তার পথ চলা? না, কিছুতেই না। ‘আমি মেরি। আমি আমার মা-বাবার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাই না। আমি আমার শ্রম ও মেধার মাধ্যমে সমাজে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাই। আমি পড়ালেখা করে অনেক বড় চাকরি করতে চাই, যাতে অন্যের ওপর নির্ভর করে আমাকে বেঁচে থাকতে না হয়।’
মেরি মাকে হারিয়েছে অনেক আগেই। মা হারানোর যন্ত্রণা যত না কষ্ট দেয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট দেয় এই সভ্য সমাজ। মা, হোক না কোনও নিষিদ্ধ পল্লীতে বসবাসকারী নারী, কিন্তু সেও তো মা। তার পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেস্ত। সে তো মমতাময়ী মা। মা হারানোর বেদনাকে সঙ্গী করেই মেরি দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। সে জানে, তার এই পথ চলাতে সম্মুখিন হতে হবে কিছু বাধার। কিন্তু সেই বাধাকে একদিন পিছনে ফেলে মেরি এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। এগিয়ে যাবে অনাগত প্রত্যাশার দিগন্তের দিকে। আমার ও ও আমাদের প্রত্যাশাও তাই।
ডকুমেন্টরি দেখা শেষ। হলরুমে আলো জ্বলে উঠল। প্রতিটি দর্শকের চোখ ছলছল করছে। একসাথে দুশো মানুষের হাততালি বেজে উঠল। অসাধারণ অনুভূতি। আমার পাশে বসা মেরিও তখন কাঁদছিল। আমার অনুভূতি আকাশে ধোঁয়ার মতো উড়ছে। আমি অনেকটা খুশি মনে ঢাকাতে ফিরলাম। পরদিন থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশ হতে শুরু করেছে। দু’এক দিন পর এসএসএস এর সহ-সভাপতি মওলা ভাই ফোন করলেন, মেহেদী ভাই, আপনার ডকুমেন্টরিটি আমরা নিতে চাই। আপনি যদি আমাদেরকে একটা বাজেট দিতেন।
আমি ওনাদেরকে সেই ডকুমেন্টরিটির দুটি মাস্টার কপি দিলাম। একটা ওনারা রাখলেন অন্যটি জাপানে একটি ডকুমেন্টরিটি প্রতিযোগিতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
কয়েক দিনে ঘটনাটি পত্রিকায় প্রকাশের কারণে বেশ জানাজানি হয়ে গেল। আমার আরটিভির সহকর্মী, বন্ধুবর রিপোর্টার পুলক মাহমুদ আমার ডকুমেন্টরিটি দেখে খুব খুশি। তিনি একদিন বললেন, আপনার ডকুমেন্টরিটি ইন্ডিয়ান জী নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার অধীর রয় দেখতে চান। উনি ওনার কাজে বাংলাদেশে আসলে আমার সাথে দেখা করে ডকুমেন্টরিটি দেখলেন এবং একটি কপি জী নিউজে প্রচারের জন্য সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ধন্যবাদ পুলক ভাই ও অধীরদাকে। এরপর ডকুমেন্টরিটির ঢাকাতে একটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেই খবর পেলাম। মেরির পারিবারিকভাবে তার পছন্দের একটি ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে। আমরা সবাই খুশি। আমরা তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সেই ডকুমেন্টরিটির প্রদর্শন থেকে বিরত থাকলাম। এরপরই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দৌলৎদিয়া ঘাট পতিতাপল্লীর শিশুদের নিয়ে কাজ করব।
চলবে...