
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ২৬
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০১৮
এত বিশাল মানুষদের বহর নিয়ে যুগের পর যুগ আবর্তিত এই পল্লীর লোকদের খানাপিনার ধরণ কেমন? ঝুমুর বাড়িঅলীর সাত-আটটি টিনের ছাপড়া ঘর। তার একটিতে ঝুমু বসবাস করে। রান্নাবান্না করে খাবার ব্যবস্থা এখানে খুবই সংকটাপন্ন। ঝুমু এখানে রান্নাবান্না করে না, সে পাশের এক হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে প্রতিদিন খায়। পল্লীর অধিকাংশ নারীই এ পন্থায় খাবাবের ব্যবস্থা করে। ঝুমুদের রুমের ভাড়া প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন বাড়িঅলীকে পরিশোধ করতে হয়। সঙ্গে একটি ফ্যান ও একটি লাইটের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থও দিতে হয়। যে নারীর মাথার উপর প্রতিদিন এমন নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ পরিশোধের দায়, সে তার জীবনের হাজারো অসুস্থতাকে বিসর্জন দিয়ে, বুকের কষ্ট বুকে চেপে রেখেই দাঁড়িয়ে পরে পল্লীর মেইন গলিতে খদ্দেরের আশায়। যে দিন দু’চারজন খদ্দের কেউ ঘরে নিতে পারে, তার কিছুটা প্রাত্যহিক ব্যয়ের অভাব সংকলিত হয়ে যায়। কিন্তু যার কপালে কোনও খদ্দের জোটে না, সে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে যায়। হয়ে যায় বাড়িঅলীর কেনা গোলাম। যতদিন কেউ তার ঋণের বোঝা পরিশোধ করতে পারে না, ততদিনই সে বাড়িঅলী পরিবর্তন করতে পারে না কিংবা পল্লী থেকে বের হয়ে যেতেও পারে না। কোনও বাড়িঅলী ইচ্ছা করলে কোনও ঋণগ্রস্থ মেয়েকে তার ঋণের সমুদয় অর্থ আগের বাড়িঅলীকে পরিশোধ করে নিজ জিম্মায় নিতে পারে। এটাকে এক ধরণের কেনাবেচাও বলা যেতে পারে। প্রতিটি নারী তার জীবনের মূল্যবান সম্পদ নিয়ে গলিতে দাঁড়ানোর পাশাপাশি কিছু পুরুষ দালাল পোষে। দালাল বিভিন্ন ধরণের এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে খদ্দের নিয়ে এসে মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে দ্যায়। বিনিময়ে পায় কমিশন।
ঝুমুর রুম থেকে কেন জানি বের হতে মন টানছে না। তার রুমটা বেশ পরিপাটি। ঘরের মধ্যে প্রসাধনীর তীব্র ঘ্রাণের সুবাস বয়ে যাচ্ছে। তেষ্টা পেয়েছে। ঘরের ছোট্ট টেবিলের উপর রাখা কাচের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঘরের এদিক-সেদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম, কোথাও কোনও খাবার পানি আছে কীনা। পেলাম না। টেবিলের নিচে আধা-পরিষ্কার প্লাস্টিকের জগ দেখলাম। তাতে পানি থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। হঠাৎ নজর পড়ল, ঘরের কোণে মাটির কলসির উপর। কলসটির মুখে একটি টিনের পিরিচ দিয়ে ঢাকনা দেয়া। এগিয়ে গেলাম। সত্যিই বেশ তেষ্টা পেয়েয়েছ। কিছুটা আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে গিয়ে টিনের ঢাকনাটি খুলতেই অবাক! এক ফোঁটাও পানি নেই।
এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছন ফিরে উঠে দাঁড়াতেই ঝুমু বলল, কি? পানি খাবা?
হ্যাঁ, তাই তো খুঁজছি।
নাও, সেভেনআপ খাও।
আমরা সেভেনআপ পান করছি। সময় হয়েছে আজকের মতো ঢাকাতে ফেরার। রশিদ ভাই অফিসের কাজে আমাকে রেখে চলে গেছেন। আর অল্প সময়ের মধ্যেই মনে হচ্ছে রশিদ ভাই চলে আসবেন।
ঝুমু? তোমার অনেক সময় আজকে নিয়ে নিলাম, তুমি অসুস্থ... গেইট ধরবা?
না। আজকে গেট ধরব না। আজকে আমার ভালোবাসার দিন।
মানে?
কোনও মানে নাই। আজকে শুধু তোমাকে ভালোবাসার দিন।
আমাকে? কেন? আমি কি অপরাধ করলাম?
তোমার অপরাধ তুমি ভালো মানুষ। ভালো মানুষরে আমরা সহজে পাই না। যেহেতু আজকে তোমাকে পেয়েছি সেহেতু আজকে আমার ভালোবাসার দিন।
ভালোবাসার জন্য তো ভালো একটা হৃদয় থাকা চাই, সেইটি কি আমার আছে?
আছে বলেই আমাদেরকে নিয়ে কাজ করার সাহস পাও। তোমাদের মতো যারা আসে তারা বুকে সাহস ও ভালোবাসা নিয়ে আসে। তোমাদের সাথে আমাদের থাকে না কোনও দৈহিক সম্পর্কের বন্ধন। থাকে বন্ধুত্বের বন্ধন। অন্যরা আসে গালি দিতে, গালি খেতে। বেশ্যাদের কাছে আসে পুরুষ বেশ্যা হয়ে।
তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারো। কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ালেখা করেছো?
ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। তারপর শুধুই ইতিহাস।
তোমাকে বাইরের কোনও প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে তুমি যাবে?
এখান থেকে বের হওয়া কি সম্ভব?
যদি আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি?
তাহলে যাব, কিন্তু যাব কোথায়?
ঢাকাতে।
ঢাকাতে গিয়ে থাকতে পারব না।
কেন? সমস্যা কি?
ওরা থাকতে দিবে না।
ওরা কারা?
দালাল। তুমি আমাকে যেখানেই নিয়ে যাবে তারা আমার পিছু নিবে। এবং পুনরায় এ পেশায় আসতে বাধ্য করবে।
তাহলে সমাধান কি?
জানি না। তবে এতটুকু বুঝি, এখানে অনেকটা শান্তি তোমাদের সভ্য সমাজ থেকে।
কিভাবে?
শোনও, এখানে কোনও খদ্দের আমাদের অতটা অত্যাচার করতে সাহস পায় না। আমাদের সাথে বসার পর টাকা না দিয়ে চলে যেতে পারে না। এখানে পুলিশি হয়রানি নাই। এখানে আমাদের স্বার্থ দেখার জন্য আমাদের সংগঠন আছে। আর পল্লীর বাইরে আমরা যদি ভালো হয়ে চলতে চেষ্টা করি সেক্ষেত্রে কেউ যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে আমরা যৌনকর্মী ছিলাম, তাহলে আমাদেরকে অন্যায়ভাবে অত্যাচার করে। আমাদেরকে বখাটে লোকজন ধরে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। আমাদের কোনও কিছু করার থাকে না। পুলিশের কাছে গিয়েও কোনও লাভ হয় না। উল্টা নির্যাতিত হবার ভয় থাকে। কারণ আমরা বেশ্যা। সমাজে কোনও বেশ্যাদের আইন নেই। বেশ্যা বলেই আমরা সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বাইর থেকে কেউ এসে আমাদের ভাড়া করে নিয়ে যেতে চাইলে আমরা সাধারণত যাই না। কারণ বেশিরভাগ সময় খদ্দের একজনের কথা বলে অনেকজন আমাদের সাথে জোর করে বসে এবং টাকাও দিতে চায় না। সবাই বলে, পল্লী উচ্ছেদ করো। উচ্ছেদ করো। পল্লী উচ্ছেদ করবা ভালো কথা, আমরাও সেটা চাই। কিন্তু এর আগে আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করো। আমরা যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গিয়ে অত্যাচারিত না হই, তার ব্যবস্থা করো। সবচেয়ে বড় কথা, তোমাদের সমাজের মানুষদের উচিৎ আমাদের বেঁচে থাকার সঠিক পথ দেখানোর। তোমরা দেখাবা? নাকি শুধুই মুখ দেখানো ঘৃণা করবা আমাদের?
চলবে...