
‘ভারতকে ট্রানজিট বানিয়ে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ’
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা বুকিত বিনতাং। সেখানকার বাংলাদেশি খাবার হোটেলগুলোতে প্রায় সারা বছরই মেলে পদ্মার ইলিশ। ইলিশ মাছের টুকরো বিক্রি হয় ২৫-৩০ রিঙ্গিত দরে। বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৭০০-৯০০ টাকা।
যে দেশে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ, সেখানে কিভাবে ইলিশ পাচ্ছে, এই প্রশ্নে পরিচয় না প্রকাশের শর্তে কুয়ালালামপুরের এক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, ইলিশ তো সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আসে না। আমরা পাই ভারত থেকে। ফ্রোজেন হয়ে সেখান থেকে আসে পদ্মার ইলিশ। রপ্তানি হয় ভারতীয় লাইসেন্সে। তবে চুক্তিটা হয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এখানে ইলিশ পাঠায় তারা।
একই তথ্য মিলল সিঙ্গাপুরের মোস্তফা এলাকার একাধিক বাঙালি হোটেল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। তাদের কাছেও বাংলাদেশের ইলিশ যায় ভারত হয়ে। সিঙ্গাপুর প্রবাসী বরিশালের বাসিন্দা ইলিয়াস সরদার বলেন, “এখানে ৫০-৬০ ডলার রেটে বাংলাদেশের কেজি সাইজের ইলিশ কিনি আমরা। বাংলা টাকায় যা ৬-৭ হাজার।”
কলকাতার হাওড়া বাজারের একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানান, এটা তো চলছে বহু বছর। পূজার সময় বছরে একবার এখানে ইলিশ পাঠায় বাংলাদেশ। এর বাইরে সারা বছর চোরাই পথে আসে বাংলাদেশের ইলিশ। যার ৮০ ভাগ আবার এখান থেকে রপ্তানি হয় অন্যান্য দেশে। বিদেশের ক্রেতাও ঠিক করে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা। দর-দাম ভেঙে তারাই পাঠায় ইলিশ। মাঝখানে ব্যবহার হয় ভারতীয় রপ্তানিকারকদের লাইসেন্স। এ কারণেই তো বাংলাদেশ থেকে বেশি দামে কিনে ভারতে আনলেও লোকসান হয় না তাদের।
ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশি ইলিশ পাচারের এই কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটে রয়েছে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে যেসব রপ্তানিকারক ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে তাদের অনেকেরই কলকাতায় রয়েছে নিজস্ব বাড়ি।
হাওড়া-পাতিপুকুরসহ কলকাতার মাছের বাজারগুলোতে আড়ত, গদি রয়েছে অনেকের। ৪টি লাইসেন্সে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করছেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল। ৫ আগস্টের পর ভারতে অবস্থান করেই তিনি চালাচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসা। এবছরও টুটুলের ৪টি লাইসেন্স পেয়েছে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি।
কলকাতার বশিরহাট এলাকায় শ্বশুরবাড়ি টুটুলের। সেখানে তার নিজেরও আছে বাড়িসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কলকাতায় বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবসার অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন টুটুল। আরেক রপ্তানিকারক পাবনার সেভেন স্টার। ভারতের হাওড়ায় এই সেভেন স্টার কোম্পানির মালিকের রয়েছে মাছের গদি। সেখানে ফ্ল্যাটসহ নানা স্থাপনা রয়েছে তার।
একইভাবে কলকাতার বারাসাতে বাড়িসহ মাছ বাজারে আড়ত আছে কেবিসি নামের আরেক রপ্তানিকারকের। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত একাধিক সংবাদকর্মী ও হাওড়া-পাতিপুকুর এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ভারতের ইলিশ বাজারে প্রচণ্ড প্রভাবশালী বাংলাদেশের এসব রপ্তানিকারক। পশ্চিমবঙ্গের মাছ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এদের দারুণ সখ্য।
পুরো বিষয়টি চলে এই দুপক্ষের সমঝোতায়। ওইসব নেতার সাহায্যে ভারতীয় আত্মীয়স্বজনদের নামে করিয়ে নিয়েছে রপ্তানির লাইসেন্স। সেসব লাইসেন্সেই বাংলাদেশের ইলিশ পুনরায় তৃতীয় দেশে পাঠায় তারা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে মুখ খুলতে রাজি হননি রপ্তানিকারকদের কেউ। ভারতের ‘ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’র সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদও স্বীকার করেননি কিছুই।
ভারতকে ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে ইলিশ রপ্তানি প্রসঙ্গে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে আসা ইলিশ তো আমরাই গ্রহণ করি। এরপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। এখানে রি-এক্সপোর্টের কোনো বিষয় নেই।”
বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নিজামউদ্দিন বলেন, “দেশের চেয়ে কম দামে ইলিশ রপ্তানি কি করে সম্ভব?”
এ বিষয়ে কথা বলতে তানিসা এন্টারপ্রাইজের মালিক নীরব হোসেন টুটুলের ফোনে যোগাযোগ করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। কেবিসি ও সেভেন স্টার মালিকদের ফোন দেওয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি।