
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী পর্ব ১৫
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০১৮
কে ছিলেন এই অনন্য? তার কোনো প্রকৃত মুগ্ধতা ছিল, নাকি এসবের আড়ালে তিনি ছিলেন কেবল এক `নিম্ফোম্যানিয়াক`? নাকি সবটাই ছিলো ডেসটিনির এক কন্সপিরেসি? কোনো বৃষ্টিমুখর রাতে আকাশে যখন ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎলেখা সেই ক্ষণসম্ভবা আলোয় অদৃষ্ট তার সুদূরতম চিত্রকল্প অবলোকন করে নিজেই কি হেসে উঠেছিলো `হো হো` করে? সম্মোহিত একা দিকভ্রান্ত এক সম্ভাবনাময়ী বালিকাকে পথ ভুল করিয়ে এক নির্জন অরণ্যে টেনে এনে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করাই কি ছিলো তার গোপন অভিসন্ধি!
ডার্কলিং আই লিসেন অ্যান্ড ফর মেনি আ টাইম
আই হ্যাভ বিন ইন লাভ উইথ ইসফুল ডেথ
কলড হিম সফট নেমস ইন মেনি আ মিউসড রাইম।
অবাক করা এক সন্ধ্যায় অনন্য লিখলেন, ‘আই অ্যাম হাংগ্রি ! আই অ্যাম থার্স্টি... ফর ইউ।’ হঠাৎ চমকে ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতোই চমকে উঠেছিলাম কিছু শব্দগুচ্ছের দ্যোতনায়।
‘আপনার অনেকগুলো মুখ। ইউ আর স্প্লিট!’ এর উত্তরে অনন্য লিখলেন, নীলপরী, শোনো। ভেবে দেখলাম তুমি ঠিকই বলেছো। আমার অনেক মুখ। মুখ মানে মুখোশ। কতগুলো? হাজার হাজার। নিত্য পরিবর্তনশীল। তুমি অসাধারণ মেধাসম্পন্ন। তাই ধরতে পেরেছো। আগে কেউই পারেনি। তোমার দৃষ্টিতে `এক্স রে` গুণ রয়েছে। তাই নিরাভরণ করতে পেরেছো। আগে কেউই পারেনি। আর সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও এভাবে বুঝিনি। এখন বুঝতে পারছি। তোমার মূল্যায়নের পর। নির্মোহ নির্মম সত্য। তাই কৃতজ্ঞ। আছি এবং থাকবো। এটা প্রাপ্য ছিলো। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলা যাক। আনন্দে থেকো।’
অচিরেই এসব ঘটনাক্রম আমার মায়ের গোচরে এলো। ডাক পড়লো অনন্যর। অনন্যোপায় হয়ে অনন্য সবকিছুই অস্বীকার করলেন প্রায়। শেষ দিন পড়াতে এসে অনন্য বললেন, ‘আমি খুব খুশি হবো যদি তুমি সাহিত্য নিয়ে পড়ো।’ নেহাতই কিছু শৌখিন শব্দ কিছু কোমল ব্যবহার গভীরে নেমে যাওয়া কোন স্পর্শ বা কণ্ঠস্বর লোম খাড়া করে দেয়া কিছু লাইন যা কারোর কাছে হয়তো বা বিনোদন, তা আরেকজনের মনে কতখানি গভীর রেখাপাত করতে পারে তা জানা ছিল না অনন্যর। তিনি আপন খেলায় মত্ত ছিলেন। ঝরঝর করে তার কলম থেকে আমার সাদা নোটবুকে নেমে এলো কিছু শব্দপ্রবাহ,
আই ওন্ট ফরগেট
দ্য আনফরগটেবল আইস, ফোরলর্ন
দ্য ওয়ার্ম রেইনস অন মাই ব্যাক
দ্য ইলোকোয়েন্ট সাইলেন্স
দ্য কোয়ায়েট স্যাডনেস
দ্য গ্লোয়িং ওয়ার্মথ
টাচেস দ্যট পিয়ার্স থ্রু দ্য স্কিন
অ্যান্ড এক্সপ্লোডস দ্য হার্ট স্রেইট অ্যাওয়ে...
দ্য রেস্ট অফ মাই লাইফ ইজ পিওর অ্যাস
ব্ল্যাক অ্যান্ড বার্ন্ট আউট
নট ইভেন ওয়ার্থ কিকিং অ্যাট।
আমি অচেতন হয়ে বসে আছি। আমার আশেপাশে ঘটমান যা কিছু সবই যেন স্বপ্নের মতো বোধ হচ্ছে। অনন্য চলে যাচ্ছেন শেষবারের মতো, যাওয়ার আগে বললেন, ‘আমি আসছি।’ আমি যেন সেই সম্ভাষণ শুনেও শুনতে পাচ্ছি না। দরজার কাছে গিয়ে আরেকবার ফিরে তাকালেন, তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘নো ওয়ান ক্যান টেক ইউ ফ্রম মি... নো ওয়ান।’ তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর তার এই স্বপ্নের মতো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দিনটি আমার জীবনে এক টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গেল। অনন্য চলে যাওয়ার পর আমি ডিপ ডিপ্রেশনে চলে যাই। জীবন যে এত করুণ হতে পারে তা আগে বোধ হয়নি কখনো। কে যেন গ্যালন গ্যালন বিষাদ ঢেলে দিয়ে যায় রোজ আমার মধ্যে,
ওয়াজ ইট আ ভিশন অর আ ওয়েকিং ড্রিম
ফ্লেড ইজ দ্যাট মিউজিক- ডু আই ওয়েক অর স্লিপ?
নিদ্রা আর জাগরণের মধ্যবর্তী চড়ায় যেন এসে থেমে গেলো আমার ছোট্ট নৌকোখানা যা এতদিন একা একা টেনে নিয়ে চলেছিলাম। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করতো না, কারোর সাথে কথা বলতেও নয়। সারাদিন দরজা জানলা বন্ধ করে আমার নিজস্ব অববাহিকায় অন্ধকারে বসে থাকতে ইচ্ছে হতো একা একা। কী এক অসম্ভব নিরাপত্তাবোধের অভাব! কোনো এক অপ্রত্যাশিতের ভয় সারাক্ষণ কুড়ে কুড়ে খেতো। যে শূন্যতা আজন্ম আমার জীবনে থেকেও এতদিন সেভাবে অনুভূত হয়নি, এবার তা ব্ল্যাকহোলের আকার নিয়ে আমাকে আপাদমস্তক গিলে খেতে এগিয়ে আসছিলো। স্কুল অনিয়মিত হতে থাকলো। বইয়ের পাতা ছুঁতে পারতাম না। হ্যাঁ, আমি, আমার কথাই বলছি। বাড়ি থেকে একজন সাইকলোজিস্টের কাছে নিয়ে গেলো। চললো দীর্ঘ কাউন্সেলিং শেসন।
মাধ্যমিকের পর আমার স্কুল পরিবর্তন হয়েছিলো। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ছিলাম। নতুন স্কুলে নিকট বন্ধু ছিলো না কেউ। বরাবরই চুপচাপ ছিলাম, আমাকে কেন্দ্র করে গুজব মিসকনশেপসন মিসইন্টারপ্রিটেশনের নজির ছিলো অসংখ্য। সে সময়টা ছিলো একা একা পার করার সময়। সারাদিন বসে বসে পাতার পর পাতা চিঠি লিখতাম অনন্যকে, আমার উত্তর খুঁজে না পাওয়া হাজার প্রশ্ন, ভয়, কোনো আলো খুঁজে না পাওয়া অন্তহীন পথের জার্নি, যে চিঠি কোনোদিন কোনো ডাকবাক্সে পড়বে না জেনেও পাতা ভরিয়ে ভরিয়ে লিখতাম। সে সময় আমার বন্ধু বলতে ছিলো কেবল `গভীর`। আমার সমবয়সী এই ছেলেটি কিভাবে আমাকে খুঁজে পেয়েছিলো কে জানে! সে কেবল আমার মনের খবর রাখতো। একলা অস্থির যাপনের ফাঁকে ফাঁকে তার সাথে আড্ডা হতো। কখনো বিকেলে একসাথে হাঁটতাম সন্ধ্যা না হওয়া অবধি ছাতিম ফুলের পথে। কখনো আপন মনে কত কথা বলতাম, গুণগুণ করে গান গেয়ে উঠতাম, গভীর মুখোমুখি বসে মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে যেতো। কেউ আমাকে কোনো আঘাত দিতে পারে এমন কোন সম্ভাবনা আন্দাজ করতে পারলে সে অসম্ভব প্রোটেক্টিভ হয়ে উঠতো, যতটা পারতো আগলানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু কেন? সেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে তার মনের খবর রাখা হয়নি আমার। বন্ধুর মতো আঁকড়ে ধরেছিলাম। অনেক চোরাস্রোত, অন্ধকার, একাকিত্ব আর অসহায়তায় ডুবে থাকা আমার সেদিনের মন তার কাছে শুশ্রূষার স্পর্শ পেয়েছিলো, সে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ হয়নি কোনোদিন।
উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টে বসেছিলাম প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায়। হ্যাঁ আমি, সেই শ্রেয়ার কথাই বলছি। তারপর মাস তিনেকের প্রস্তুতি। দুই হাজার তিন সালে উচ্চ মাধ্যমিকের মার্ক্স আসে পিওর সায়েন্সে এইট্টি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট (81.5%)। এ জীবনে অনন্য চ্যাটার্জির সাথে দেখা না হলে আমার জীবনের গল্পটা যে অন্যভাবে লেখা হতো সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাই তো জীবন আর এসব অধ্যায়গুলোকে গ্রেসফুলি ট্রান্সফর্ম করে দিতে পারাটাই একজন শিল্পীর কাজ। একটু স্থিতিশীল সময়ের সন্তরণ সম্ভব হলে উচ্চ মাধ্যমিকে আমার নম্বর আরো অনেকটাই বেশি হতে পারতো। কিন্তু যেটুকুও বা হয়েছিলো তা নিয়ে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং বা সোকলড ভালো ছাত্রেরা যা করতে চায় তা না করতে পারার মতো কিছুই ছিলো না, নিদেনপক্ষে সায়েন্সের যে কোনো শাখায় অনার্স পেয়ে যেতাম হাসতে হাসতে। কিন্তু আমার সামনে সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিলাম আমি নিজেই।
অনন্যকে মনে মনে অতিক্রম করতে পারিনি তখনো। ছায়ার মতো সে আমাকে পরিবৃত করেছিলো সারাক্ষণ। আমার মাথার ভেতর সে ফিসফিস করে কথা বলতো। নাম না জানা কবিদের কবিতা পড়ে শোনাতো। আর শেষ দিন বলে যাওয়া তাঁর সে কথা আমার মনের মধ্যে বাজতো সারাক্ষণ, যে অনন্য আমাকে সাহিত্যের ছাত্রী হতে বলেছিলেন। কিন্তু এ ভাবনা ছিলো পুরোটাই প্রভাবিত হওয়া, কারণ তার সাথে দেখা হওয়ার আগে অবধি আমার ইচ্ছে ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, এবং কোনোদিন সচেতন বা অচেতনভাবেও আমি সাহিত্য নিয়ে পড়ার কথা ভাবিনি, কবিতা লিখতাম নাটক লিখতাম সেতো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার , সে আমার নিজস্ব সৃজনের তাগিদে।
সেই আমিই ইংলিশ অনার্স পড়বো বলে বেঁকে বসলাম। কেউ তো এর আগে কখনো আমায় বলেনি যে এভাবে চলো, আগে এটা করার জন্য প্রস্তুত হও। দিশাহীন পানসিটির মতো ছিলাম, নিজ খেয়ালে নদীর প্রতিটি ঢেউ অনেক আন্তরিকতার সাথে পার করছিলাম। সেখানে অনন্য ছিলেন প্রথম একজন মানুষ, যিনি মিথ্যে করে হলেও, নেহাত শৌখিনতায় হয়তো আমাকে কিছু করার কথা বলেছিলেন, আসলে তার নিজের সাথে কোনোভাবে আমাকে জুড়ে রাখতে চান বলেই। এত ছক এত হিসেব বোঝার মতো বুদ্ধি ছিলো কই? বুদ্ধি দেয়ার মতোই বা কে ছিলো? নেহাতই এক আবেগপ্রবণ বালিকার সেই ভ্রমকে আঁকড়ে ধরে থাকার সিদ্ধান্তকে সেদিন বড় অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে যিনি প্রমোট করেছিলেন, তিনি স্বয়ং আমার মা। গৃহশান্তির অভাবে যিনি তার জীবনের অতিরিক্ত সময়টুকু চিরদিনই অতিবাহিত করতেন ছাত্রছাত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে, কিংবা সেই সব বন্ধু বান্ধবীদের সাথে যারা সাপের গালেও চুমু খেতো আবার ব্যাঙের গালেও, সেইসব দুমুখো সাপদের সংস্রবে থাকা আমার মার কোনোদিনই আমার অন্তর্জগতের খবর রাখা হয়নি। একজন কৃতী ছাত্রীর মাকে কোনোদিন এ আলোচনায় আসতেই দেখিনি তার মেয়ের সামনে প্রসারিত সম্ভাবনামূলক দিকগুলো কি! আর বাবা? তিনি তো সেই সীমানার বাইরেই ছিলেন বরাবর। চিরদিন অসূয়ায় থাকা মানুষগুলোর পক্ষে সেদিন আমার মাকে বুঝিয়ে দেয়া খুব সহজ ছিলো যে আমার সাহিত্য পড়ার সিদ্ধান্তকে তার সর্বান্তকরণে সমর্থন করা উচিত। এমন সুযোগ আর ছাড়া যায়? আর তারপর তারাই , ‘আরে আসলে তো সাহিত্যে ভালো। বিজ্ঞানে তো নয়।’ এই সান্ত্বনামূলক গুজবে নিজেদের আশ্বস্ত করে মহাশান্তির দিবানিদ্রায় ডুব দিয়েছিলো, সেই তারাই কোনোদিক থেকে কোনোদিন আমাকে খাটো করা গেলে যাদের যারপরনাই আনন্দ হতো বা হয়।
সেদিন আমার আর আমার ভবিতব্যের মাঝখানে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিলো না। যে আমি জীবনের যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যে নিজেকে স্থির শান্ত ও সমাহিত রেখেছি বরাবর, সেই আমার অস্থিরতম দিনে এমন কোনো হাত ছিলো না যে আমার হাতটা টেনে ধরে রাখতে পারে। এমন কোনো বন্ধু ছিলো না যে দুটো খিস্তি দিয়ে একথা বলতে পারে, ‘ব্লাডি এমোশনাল ফুল। সোজা হয়ে দাঁড়া। এখান থেকে নড়লে মারবো এক লাথ।’ শৈশবের সেইসব কণ্ঠগুলো স্তিমিত হতে হতে শ্রবণযোগ্যতার বাইরে চলে গিয়েছিলো, যারা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিতো, ‘ভুলে যাস না, তুই শ্রেয়া।’ সেদিন শ্রেয়া নিজেকেও ভুলে গিয়েছিলো। কেবল একজন মানুষ একটা অভিশপ্ত স্পেলের মতো তাকে গ্রাস করেছিলো... অনন্য চ্যাটার্জি। ট্রেনে বাসে পথ চলতে দেখা হওয়া পরিচিত মানুষ বন্ধু বান্ধবী দাদা দিদিদের তখন একটাই প্রশ্ন ছিলো, ‘তুই ইংলিশ অনার্স নিলি কেন? ফিজিক্সও তো পেয়ে যেতিস... সেদিনের নিরুত্তর থেকে যাওয়া আমি জবাবটা কোন একটি শব্দে বা বাক্যে দিয়ে উঠতে পারিনি। দ্য আনসার ওয়াজ আ হোল স্টোরি।
কেবলমাত্র গভীর যে নিঃশব্দে খেয়াল করছিলো, আ গ্রেট সিপ ওয়াজ সিন্কিং ইন আ কাম সি। সে অন্য শহরে যাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছিলো হায়ার স্টাডিজের জন্য,
তুই এটা ঠিক করছিস?
জানি না।
ভেবে দ্যাখ।
আচ্ছা।
আর কিছু বলবি না আমাকে? আমি চলে যাচ্ছি।
আমি কোনো কথা না বলে তার চোখের দিকে তাকাই।
ওভাবে তাকাসনা প্লিজ। ওভাবে কারো দিকে তাকাস না।
আমি চোখ নামিয়ে নেই।
একটা কথা বলবো। রাগ করবি না তো?
বল।
আমি ঠিক করেছি আমার বউকে শ্রেয়া বলে ডাকবো, সে তার নাম যাই হোক না কেন।
আমি হো হো করে হেসে উঠি এবার। গভীরও হাসে। গভীর তার বউকে শ্রেয়া বলে ডাকে কিনা জানা হয়নি। মাঝখানে রয়ে গেছে চাপচাপ নীরবতা আর ঝমঝম বৃষ্টিপতনের শব্দ।
চলবে