
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ২২
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : আগস্ট ২৫, ২০১৮
তরুণীবেলায় সর্বাধিক যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম সেটি হলো, ‘তুমি নাচো?’ কলেজে, রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে, যেকোনো অপেক্ষমাণ টার্মিনালে কতবার যে হেসে এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছি, বিস্ময়বোধ লাগা, ‘না।’ এই একই প্রশ্নকে সামান্য টুইস্ট করে দিলে যা দাঁড়ায়, অর্থাৎ ‘তুমি নাচাও?’, এমন প্রশ্ন সৌভাগ্যবশত কেউ করেনি যদিও। করলেও উত্তরটি একই হতো, সামান্য বিরক্তি লাগা কেবল এক,‘না।’
একমাথা চুলসমেত নিজেকে আমার প্রাচীন অশ্বত্থের মতো লাগতো, যার অজস্র পাতার বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে অহরহ ভাবনার ঝিলিক সূর্যের আলোর মতো খেলা করতো। ওই আলোটুকুই বাঁচিয়ে রাখতো আমায় নিশিদিন। কেন প্রত্যহ এই বেঁচে থাকা তা অনুভব করার তাগিদে মনের অন্তর্বর্তী টানেলে ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম, আর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসতো জীবনের সার্চলাইট, চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে আনতো অনিত্য এই জগতের মধ্যখানে, আর বলতো, ‘নাচবি না মানে? নাচ, নাচতেই হবে।’ শুনতে পেতাম চেতনার মাঝে বেজে উঠছে ব্রহ্মাণ্ডের সুর:
তাই দুলিছে দিনকর চন্দ্রতারা,
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা,
আকুল চঞ্চল নাচে সংসার কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ।
বিপুল তরঙ্গ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত জীবনের নির্জনতম উপকূলে। মাঝে মাঝে আমি আর শুভ গিয়ে বসতাম গঙ্গাপাড়ে। সে জীবনের কথা বলতো। আমি দূরের আকাশ দেখতাম। সে জলের কাছে নামতো। আমি পাখি হতে চাইতাম। সেখান থেকে কোনো রেস্তরাঁয় কফি খেতে যেতাম। কফির ধোঁয়ায় আমি উবে যেতাম উদ্বৃত্ত জীবনের মতো। শুভ চেয়ে থাকতো। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে আমি ইংলিশ লিটরেচারে মাস্টার্স করার জন্য ভর্তি হলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুভর বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা। তার আর আমার নিয়মিত দেখা হতো না তখন আর।
কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ফারাক অনেক। কলেজে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের শ্রেণিকক্ষ। ছাত্র সংখ্যা হাতেগোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষ সুবিশাল। বিরাট বড় বড় জানলা দরজা দিয়ে একটা গোটা সমুদ্র ঢুকে পড়তে পারে যেন। ছাত্রছাত্রীও প্রচুর। এত বিশালতার মাঝে এত সহপাঠীর ভিড়ে নিজেকে কেমন একা মনে হতে থাকে। প্রফেসর চিন্ময় গুহ কোলরিজ পড়াতে আসেন। কবি আর কবিতার পরিধি বৃহত্তর হতে থাকে। নিমজ্জিত হই। কবিতা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। কারো হতে দেয় না সে আমাকে। হঠাৎ চমক ভাঙ্গে যখন পাশে এসে বসে ফিরদৌস। বড় বড় চোখ। ওড়না তার মাটিতে লুটায়।
ফিরদৌস তার প্রেমিকের কথা বলে। আমি আমার। ফিরদৌস আর আমি একসাথে কলেজ স্ট্রিট ঘুরে বেড়াই। কফি হাউস নয়, ভিড় আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে, দুজন মিলে খুঁজে বের করি অন্য এক হ্যাঙ্গ আউট। ক্লাসের যে ছেলেটি গিটার বাজিয়ে গান গায় সকলে তাকে ঘিরে থাকে। সকলেই একটি দূরগত স্বপ্নকে ছুঁয়ে থাকতে চায়, যা কোনোদিন সত্য হবে না। এক সহপাঠিনী আমার নাম দেয় `রাপুনজেল`। এক কাল্পনিক দূর্গের ভেতর জীবন কাটে স্বপ্নের মতো, কোনো মধ্যরাতের অশ্বারোহীর পথ চেয়ে।
আমার বাড়িতে কম্পিউটার আসে দেরিতে, নেট কানেকশন আরো পরে। সোস্যাল নেটওয়ার্কিং বিষয়টি আমার বোধগম্যতার মধ্যে আসতে সময় লাগে। দূরগত বিষয়টি আমার কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ততদিন। `অর্কূট` বলে একটি সোস্যাল সাইটে প্রথম প্রোফাইল খুলি। সেখানে আমার কিছু বন্ধু হয়। ভার্চুয়াল জগৎকে আমার রিয়্যালিটির মতোই ইলুইসিভ বা প্রতিচ্ছবিময় মনে হয়। রিয়্যালিটি কি? শুধু যেটুকুকে ইন্দ্রিয়গত বোধগম্যতার পরিসীমার মধ্যে ধরা যায় তাই কি রিয়্যাল? মানে যাকে নেড়ে চেড়ে ছুঁয়ে দেখা যায়? শুধু সেটুকু হলেই সত্যতার ছাড়পত্র মেলে? যেমন ওই গাছটি সত্য, ওই নদীটি, কিংবা ওই আকাশ, পথের ধারে সেই অরণ্য, নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া নুড়িটি সত্য, সেভাবে একটি মানবিক সম্পর্ক সেও কি সত্য হয়? একটি মানুষ তাকে ছুঁয়ে দেখলে না হয় শরীর দিয়ে, কিন্তু তার মনকে ছুঁয়ে দেখবে কি করে? সেই মনের অস্তিত্ব কোথায় কিংবা কোথায় নয়? আমার তো মনে হয়, প্রতিটি মানুষই আসলে ছায়ামানব। আলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে তার শরীরের ছায়াটুকু পড়ে কেবল। শরীর তো সীমাবদ্ধ। কিন্তু অসীম যে তার মন মেঘের মতো ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র। তার ছায়া কোথাও পড়ে না, গোটাটাই ভার্চুয়াল, চোখ বন্ধ করেই দেখতে হয়। ভার্চুয়াল জগৎও তাই ততটাই রিয়্যাল কিংবা ততটাই ফেইক যতটা মানুষটা তুমি বাস্তবে। অর্কূটে আমার প্রোফাইলের নাম হয়, `গোল্ডেন ফিনিক্স`, নিজের অস্থিভস্মের মধ্যে থেকে বারবার পুনর্জন্ম লাভ করে যে পাখি, সে কি আমি? এই এক জীবনেই বহু বার জন্ম হয় এক মানুষের, বারবার নিজেকে চার্নিং করে এক অস্তিত্ব থেকে সে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্যে, তাই এক জীবনের মধ্যে বহু মৃত্যু অনাবশ্যক, এই মৃত্যু রূপক, যেভাবে গাছের পাতা ঝরে নতুন পাতার জন্ম হয়, তেমনি অনেক ঝরে মরার মধ্যে দিয়ে একদিন মৃত্যু তার শীতলতম স্পর্শ রাখে কবোষ্ণ জীবনের সাম্পানে।
শুভ আমার জন্য ব্যাকুল হয়। দেখা হয় কম। যোগাযোগ বেশি ফোনে। সে তার গন্তব্যের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, আমি আমার ডেসটিনির হাতে বাঁধা। পার্ট ওয়ান পরীক্ষা শেষ হয়। সে সময় কাগজে একটি বিজ্ঞাপন আসে। `প্রতিভাস` প্রকাশনার পক্ষ থেকে একটি কবিতা কর্মশালা আয়োজন করতে চলেছে আকাদেমি সভাঘরে। প্রধান অতিথি কবি জয় গোস্বামী, যার কবিতার অসংখ্য অনুরাগীর মধ্যে ছিলাম আমিও। আমি ওই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করবো বলে স্থির করি। কবিতা ছাড়া কবিতার জগৎ সম্পর্কে সে সময় অবধি আমার ধারণা ছিল সামান্যই। মানুষও চিনতাম না তেমন করে। ছিল কেবল এক বিরল সারল্য ও গভীরতা, আর এক আলো অন্ধকারময় জীবনবোধ যা নিয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থাকতাম। সেই পৃথিবীর কবিদের স্বর্গ থেকে টপকে পড়া দেবদূত বলে মনে হতো, মনে হতো তারা কলম তুললেই ঘড়ির কাঁটা স্থির হয়ে যায়, নদীর জল সমুদ্রের দিকে বয়ে চলে আত্মনাশা গতিতে। তিন দিনব্যাপী ওই কর্মশালার প্রথমদিন আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসে শুভ। বাসে উঠে সে হাত নাড়ে। আমিও হাত নাড়ি যতক্ষণ না বাসটি ভিড় ঠেলে মিলিয়ে যায় নন্দনসীমার ওপারে।
গল্পের নায়িকা তখনো জানতে পারে না ভবিতব্য তার গল্পের পরবর্তী অধ্যায় কোথায় কোন বাঁকে কতখানি নৈপুণ্যের সাথে মিলিয়ে দিয়েছে কাব্যিক সমাপতনে। সেই অববাহিকায় অদ্ভুত অচৈতন্যের মধ্যে বন্যার সাথে দেখা হয় আরেক কবির। তাতে এই আপামর পৃথিবীর কিছুই যায় আসে না, এই নদী সমুদ্র আকাশ আলো বাতাস এদের যেমনটি চলছিলো তেমনটিই চলে, শুধু দুটো মানুষের জীবনরেখা ঝড়ে একে অপরের ওপর লুটিয়ে পড়া দুটি বৃক্ষের কাণ্ডবৎ একে অপরের সাথে জুড়ে যায় অনেক কবিতার দামে।
চলবে