
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ২৪
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৮
ঘুম থেকে উঠে দেখি, ফোনের ইনবক্স ভরে আছে গুচ্ছ কবিতায়—
আবার তবে বৃষ্টি আসুক মনের ভেতর
বুক থেকে মেঘ চুঁইয়ে পড়ুক গভীর জলে
তোমায় আমি ছুঁয়েই আছি সমস্ত দিন
যেমন করে ছুঁই তোমাকে সৃজনকালে!
নিরুত্তর থাকি। অনেক মৌনতার আড়ালে জলরাশির মতো শব্দগুচ্ছ আড়াল করে রাখি। কেন এই নিবেদন কেন এই একান্ত হতে চাওয়া তা বুঝেও নিজেকে প্রতিরোধ করি। কিন্তু সে প্রতিরোধ পলকা, বড় ওজনহীন মনে হয়। যে কোনো দ্বন্দ্বে আমি নিজেকে আক্রমণ করি সবথেকে বেশি। কারো থেকে আমার তত চাওয়া নেই, যত নিজের কাছে আছে। নিজেকে টেনে নিয়ে যাই নির্জনতম অরণ্যের মাঝে, তারপর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করি, ‘তোর মরণ হয় না কেন?’ চোখ জলে ভরে ওঠে। দু`হাত দিয়ে নিজেকে টেনে নেই নিজেরই বুকে। অরণ্যের ঝরাপাতায় মর্মর ধ্বনি ওঠে।
সুদীপ্ত দার সাথে লং ড্রাইভে যাই। স্বপ্নের মতো পথ পার করি হাজার হাজার মাইল। কেন কিভাবে যাবতীয় বিচারগত নৈপুণ্য লোপ পেয়ে কেবল এক অচেতন সীমার ভেতর অনুভবের গাঢ়ত্বে ডুবে যেতে থাকি, জানা হয় না। সুদীপ্তদা ড্রাইভ করতে করতেই একের পর এক কবিতা পাঠ করে। যত কবিতা আক্ষরিকভাবে পাঠ করেছি তার বহুগুণ সেই পাঠের মধ্য দিয়ে শ্রুত হয়। রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর ঈশ্বর দর্শনকে জানা হয় উপনিষদের আলোয়র—
আমি এলেম, ভাঙল তোমার ঘুম,
শূন্যে শূন্যে ফুটল আলোর আনন্দ কুসুম।
আমায় তুমি ফুলে ফুলে
ফুটিয়ে তুলে
দুলিয়ে দিলে নানা রূপের দোলে।
দিশাহীন মোটরগাড়ির চলমানতায় কাব্য আর দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যায় চেতনার অববাহিকায়—
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্ দূরে তদ্বন্তিকে
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যত:
এই ব্রহ্মাণ্ড সেই অনন্তের ছায়া বলে মনে হয়। তবু সে ছায়ার প্রেমে পড়ি। তবু হড়কে যাই। তবু শিকল পরি হৃদয়ে সেই অনন্তের ছলনায়। সুদীপ্তদা তখন সুদীপ্ত হয়ে ওঠে। তার অতীত কোনো জলছবির মতো ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে, আমার বর্তমান প্রগাঢ় দ্যুতির মতো মোহময়।
শুভর ফোন আসে বারবার। ফোন ধরি না। সে দেখা করার জন্য কাতর প্রার্থনা জানায়। আমি নিষ্ঠুর হয়ে প্রত্যাখ্যান করি। একদিন ফোন করে সে বলে, ‘কি হয়েছে তোমার? কোথায় পালাচ্ছো? কোথায় লুকাবে তুমি? যদি পাতালেও যাও সেখান থেকেও ঠিক খুঁজে বের করে আনবো...’ তার কণ্ঠে জল টলটল করে। সে বলে, ‘এই যে এতদিন ছিলে আমার সাথে সেসব তাহলে মিথ্যে ছিল? বলো?’ হুড়মুড় করে পাড়ভাঙার শব্দ শুনি। অনেক অভিসম্পাত মাথা পেতে নেই তবু নীরব থাকি। বলতে পারি না তাকে, ‘আমি এক পথ হারিয়ে ফেলা মানুষ শুভ। আমার কোনো ঠিক-ভুল নেই। নেই কোনো আলো-অন্ধকার। আমি নদীর মতো দিগ্ভ্রান্ত। আমি অরণ্যের পথে ছুটে বেড়ানো শশকের মতো ভীত। হ্যাঁ আমি ভীত। তবু তুমি আমাকে ঘৃণা কোরো না।
সুদীপ্তর জীবনের কথা শুনি। তার আলোছায়াময় শৈশবের কথা শুনি। তার ভয় আশঙ্কা প্রত্যয়ের কথা শুনি। অনেক অন্ধকার পথ চলার মাঝে একদিন তোরঙ্গ খুলে প্রগাঢ় আলোর মতো রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করার কথা বলতে বলতে সে রোমাঞ্চিত হয়। তার কবিতা যাপন ঐহিক লড়াইয়ের কথা জানতে পারি। জনমানবহীন দিকশূন্যপুরে বজ্র বিদ্যুৎ মাথায় করে অথৈ জীবন কাটানোর রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনে অভিভূত হই। তার সাথে আমিও পাড়ি দেই স্মৃতি রোমন্থনে। বলগনায় ওদের পুরনো রাইসমিলে পৌঁছে গিয়ে দেখি, সময় কেমন মরচে ধরে আছে শ্যাওলা ধরা স্থবির কলের কাঠামোয়। তবু যেন বালক সুদীপ্ত লোহার গেটে কড়া নেড়ে নেড়ে জানায়, অভ্রের মতো গলে যাওয়া সময়ের স্রোত থেকে বিপরীত সন্তরণে পাড়ি দেওয়া সেও এক দুর্জয় নাবিক। পুরনো ভগ্ন মিলটিকে টাইটানিক জাহাজের মতো মনে হয়, আসমুদ্র সময়ের স্তূপ ঠেলে দেখি মাস্তূল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একা মিল মালিকের নাতি! বুঝতে পারি সাজানো রোম্যান্টিসিজমে কবি যশের মোহে ঘুরে বেড়ানো জীবন নয় তার। অনেক চ্যালেঞ্জ পার করে আসা তার কবিতা তাই কখনো কখনো তার মতোই বেপরোয়া। এও দেখলাম কবিতা লেখার জন্য আলাদা কোনো সমারোহ বা কোনো বিচ্ছিন্নতা কিছুই লাগে না তার। দিব্য যেখানে সেখানে ঘরে বাইরে গাড়িতে বা ভরা কোর্টরুমে অবলীলায় শব্দ নিয়ে জাগলারি করতে অভ্যস্ত এই মানুষ!
কবিতা সম্পৃক্ত ড্রাইভিং করতে করতে কখন সে হাইওয়ে ছেড়ে বহুদূরে চলে আসে, জানতেও পারি না। পথ ভুল হয়ে যায়। সন্ধ্যার পথ গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রহস্যময়ী হয়ে ওঠে। যেন সেই কোন জন্ম থেকে এই পথ পার করছি আমরা। কত রাত ফুরিয়ে ভোর হয়েছে। যেন কত আগল ভেসে গেছে উপচে আসা ঢেউয়ে। এমন কত
কল্পনা কত ভ্রম তখন সত্য বলে মনে হতে থাকে। আগন্তুকের মতো দুকূলপ্লাবী প্রেম দুচোখ অন্ধ করে দেয় প্রগলভ আলোয়। অন্ধতা না থাকলে সে তো প্রেম নয়, অন্য কিছু।
দুটো মানুষ যারা চিরটাকাল আলাদা ছিল, আলাদাই থাকবে, কারণ প্রত্যেকেই তার খোলসের মধ্যে অনিবার্য একা, এ নিয়তি জেনেও তারা প্রণয়ে আবদ্ধ হয়, হবেই, কারণ এই ছলনাই শাশ্বত, কারণ প্রকৃতি এমনটাই চায়, অনেক কবিতার জন্ম দেবে বলে আলো হাওয়া বাতাসেরও সেই ইচ্ছে হয় বোধহয়। দুটো পথ যে সময় টুকুর জন্য এসে মেলে সেই সময়টুকুই সৃজনের। প্রকৃতি মানুষের থেকে এর চেয়ে বেশি কি চায়?
সুদীপ্ত বলে ওই গানটা গাও। আমি গেয়ে উঠি—
না উম্র কি সীমা হো না জন্মোকা হো বন্ধন
যব পেয়ার করে কোই তো দেখে কেবল মন
নই রীত চালাকর তুম ইয়ে রীত অমর কর দো
হোঠো সে ছুঁলো তুম মেরা গীত অমর করদো
বন যায়ো মীত মেরে মেরী প্রীত অমর কর দো
অথচ প্রেমের সময়টুকো বাঁধা। অথচ মৃত্যুই শাশ্বত।
বাড়ি ফিরে ঘুমানোর আগে ফোন খুলে দেখি ইথারে জমে আছে তার কিছু শব্দ—
তুমি যদি রাজি হও
সমুদ্র আবার রাজি হবে
ক্লান্ত টিলার ওপারে
ভালোবাসা অফুরন্ত গুল্মবাসে থুম মেরে আছে!
তুমি রাজি হলে
আছড়ে ফেলতে পারি বসন্তকে
যে কোনো সন্ধ্যার নাভিচরে,
গ্রীষ্মীয় উপবাস ছিঁড়ে
নিরন্ন প্রেম পেখম মেলেছে,
ফিরিয়ে নাও
আজন্মের জরুল গাথা ভেঙে—
দুর্ভেদ্য শিকড়ের আকড় রহস্য মেখে
তৃতীয় দরজা খুলে
মেহগিনি সময়ের স্তূপ উড়ে যায়—
আমাকে ফিরিয়ে নাও বিনষ্ট অঙ্কুর থেকে
অনিবার্য প্রেমে।
আমি রাজি হই, হয়তো তাই, এভাবেই একটা গোটা বই লেখা হয় তার।
চলবে