
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ২৫
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮
কবি মাত্রই ছায়াময়। তিনি সন্ন্যাসী না ভোগী, সৎ না দ্বিচারী, সরল নাকি ছিদ্রান্বেষী, সচ্চরিত্র না লম্পট, টিটোটলার না মাতাল চুল্লুখোড়, আদর্শবান নাকি দালাল, স্বাভিমানী না তাঁবেদার— এসব অহেতুক প্রশ্নগুচ্ছের নিরসনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তিনি আদৌ কবি কিনা! কিংবা কবি আসলে কে? কবি সে মানুষ যিনি এক অভূতপূর্ব শক্তির অধিকারী। সে শক্তি কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার দায় নিয়ে ভরা বাজারে `আমি কবি আমি কবি` হাঁক পেড়ে হাটে ঘাটে মাঠে খুইয়ে আসার জিনিস নয়। অনন্ত শূন্যতার মাঝে ইথারে জমে থাকা তরঙ্গ কোনো অতীন্দ্রিয় মুহূর্তে যে মানুষের মগজে একটি নিখুঁত বুদবুদের জন্ম দেয়, যে বুদবুদকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে জন্ম নেয় আরো অনেক অনেক তরঙ্গ, সেই তরঙ্গ নিজের অন্তর্জগৎ থেকে বহির্জগতে নিঁখুত শব্দ আর ছন্দের ঐশ্বরিক বাজনায় বেঁধে যিনি ছড়িয়ে দিতে পারেন, তিনিই কবি। আর তার ঐ নিভৃত বাজনা হলো কবিতা। এক একটি মগজীয় বুদবুদ থেকে এভাবেই জন্ম হয় এক একটি সার্থক কবিতার। সেই অতীন্দ্রিয় যোগাযোগের সময়টুকু যে সময় এই ব্রহ্মাণ্ড এবং কবির মধ্যে সেতু বন্ধনের কাজ হয় সেই সময়টুকুর জন্য তিনি সাধক, সিদ্ধ পীর! সেই সময়টুকুর জন্য তিনি মনের ভেতর নিভৃততম কোণে শুদ্ধতম আসন পেতে বসেন। সেই সময়টুকু তিনি এ পৃথিবীর কারো নন। এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডের সাথে তার বিনিময়ের ঐশ্বর্যে তিনি অনেক কবিতার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকেন।
একবার সুদীপ্তর বাড়িতে এলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। আমারও সেখানে আমন্ত্রণ তার পাঠক হিসেবে। দুপুরে লাঞ্চের পর ওদের বৈঠকখানায় বসলেন কবি। আমরা তার স্বকণ্ঠে কিছু কবিতা শুনবো এমনই অভিপ্রায়। কবি তার আসন্ন কাব্য গ্রন্হের পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু কবিতা পড়ে শোনালেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি যখন মুগ্ধতর করে দিয়ে কবি বললেন, ‘এই বইটি সম্পূর্ণ হতে আরো দুটি কবিতা লেখা বাকি। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। কবে সে ধরা দেয়।’ কবি যেন তার নির্জন কক্ষে একাকী অপেক্ষারত, কখন কিছু শব্দ স্বয়ং কবিতায় নিজেদের ভেঙে গড়ে পূর্ণরূপে কবির কাছে এসে আত্মসমর্পণ করবে, কোন অনির্বচনীয় ধ্যানের মধ্যে সেই কবিতার সাথে তার সঙ্গম হবে ভেবে রোমাঞ্চিত হই। যেন কবিতা একটি জার্নি, একটি খোঁজ, মহা সমুদ্রের দিকে এগোতে এগোতে পথে দু`হাত ভরে নুড়ি কুড়িয়ে নেয়ার মতো।
এমন নানা মুগ্ধতা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলেছে যখন জীবন, কিছু অনৈতিক সুবিধে পাওয়ার লোভে সুদীপ্তর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যে অভিযোগ নথিবদ্ধ করে তারই কোনো সময়ের এক অনুগত ভৃত্য। সে সময় ও বাইরে থাকায় এবিষয়ে কথা বলার জন্য এসপির অফিসে যাই। প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই উনি বলেন, ‘আপনি কে হন?’ নিজেকে `বন্ধু` হিসেবে পরিচয় করানো মাত্রই উনি আমার পা থেকে মাথা অবধি মাপতে শুরু করেন, যেন `বন্ধু` কোনো অবৈধ সম্পর্কের নাম। তারপর একজন কুখ্যাত লোকের নাম করে উনি বলেন,‘আপনি এনাকে চেনেন?’ আমি বলি, ‘না। এর সাথে বিষয়ের কি সম্পর্ক! আপনি এই অভিযোগ উইথড্র করুন, আর না করলেও আমি প্রমাণ করে দেব যে, এই অভিযোগ মিথ্যা।’ উনি আমার কথা প্রায় অগ্রাহ্য করে আবার ঐ কুখ্যাত লোকের নাম নিয়ে বলেন, ‘আপনি যার বন্ধু বলে পরিচয় দিলেন তাকে জিজ্ঞেস করবেন তো একে চেনে কিনা?’ আমার সাথে এসপির অফিসে গিয়েছিলেন যিনি কথোপকথনের উত্তেজনায় ততক্ষণে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তিনি রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘চলো আমরা চলে যাই।’
কিন্তু চলে যাই কি করে? আমার বন্ধু যেমনই হোক, যদি সে তার বন্ধুতার জায়গায় অকৃত্রিম হয়, যদি সে আমায় ভালোবাসে আর আমি তাকে, তাহলে আগুনের মাঝখানে তাকে একা ছেড়ে আসি কি করে? তখন সেই আগুনে পুড়তে হয় দুজনকেই, অথবা নেভানোর চেষ্টা করতে হয় একসাথে। তখনো এমনটাই জানতাম। যদিও জীবনের আরো অনেক পথ ট্রাভেল করার পর একসময় বুঝেছি, অন্যের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তুমি যখন, দেখবে সেই পুড়ে যাওয়া বাসার ভেতর তুমি হয়তো রয়ে গেছো একা আগুন নেভানোর দায়ে, চারদিকে দাউদাউ আগুন, অথচ যার আগুন নেভাতে গেছো সেই তোমায় ছেড়ে গেছে কখন জানতেও পারোনি। তবু বন্ধু শব্দের একটি পৃথক সৌরভ আছে, যা হৃদয়ে লেগে থাকে। বন্ধু উত্তীর্ণ নাও হতে পারে, তবু বন্ধুতায় তার কোন কলঙ্ক লাগে না। ভালোবাসা কোনোদিন ব্যর্থ হয় না, সম্পর্ক অসফল হলেও।
এসপিকে বলি, ‘আমি যার বন্ধু আপনি সম্ভবত তাকে চেনেন না। চিনবেন, আমি চিনিয়ে দেব।’ চারদিন বাদে এসপির অফিসে একটি মাস পিটিশন জমা করি। তার কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি নিরসন হয়। অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণিত হয় ঠিক সময়ে। সেসময় থেকেই আইন এবং আদালতের বিষয় সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়। সুদীপ্তই বলে, ‘আইন পড়ো।’ যদিও সেসময়ের মধ্যে আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে, এবং আমি একটি ভোকেশনাল কোর্সেও অ্যাডমিশন নিয়ে নিয়েছি, কারণ শিক্ষকতায় আমার আগ্রহ ছিল এবং সেইসব তরুণ মনগুলোকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিলো যাদের অনুপ্রাণিত করা যায়। একটি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলেও কনট্র্যাকচুয়াল টিচার হিসেবে পড়ানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে তার মধ্যে। নিজেরও অনেক ছাত্রছাত্রী, সব মিলিয়ে বেশ উড়ে বেড়ানো জীবন। কলেজের বন্ধু বিভু, আমু, ডিপস আর পারো তাদের নিয়েও অনেক আনন্দের সময় কাটে। ওরা আমার নাম দেয় `মহাজাগতিক`, কারণ আমার অন্যমনস্কতা! কেমন যেন আনমনা থাকি সারাক্ষণ। এই `অন্যমন`টাকে সারাক্ষণ বয়ে নিয়ে চলি অশরীরির মতো সবার আড়ালে। এই `অন্যমন`টাই আমাকে ভুল ট্রেনে তুলে দেয় বারবার। সম্পূর্ণ উল্টো পথে পাড়ি দিতে দিতে হঠাৎ জানলা দিয়ে চোখ যায় বাইরের দিকে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। চমকে উঠে খেয়াল করি, স্টেশনের নাম `নিশ্চিন্দিপুর`!
বিজ্ঞান ছেড়ে দেয়ার একটা আফসোস ছিল আমার। বেশ কিছু ল এর বই ঘেঁটে দেখি বিষয়টা আমার জানতে ইচ্ছে করছে বেশ। খুব সমৃদ্ধ হওয়ার মতো একটি সাবজেক্ট, এবং জীবনের সাথে যার সংযোগ খুব দৃঢ়। পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে লজিক আর ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে, পারসেপশন, প্রুফ আর প্রেসেন্টেশনের ওপর। জীবনকে আরো গভীরভাবে পারসিভ করারও এক অন্যতম মাধ্যম বলে মনে হয় এই বিষয়টিকে। অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে চান্স পেয়ে যাই হুগলী মহসীন কলেজের ল ডিপার্টমেন্টে।
তারপর আলোর মতো দিন কাটে। হাওয়ায় মতো দিন কাটে। কোন এক সন্ধিক্ষণের অপেক্ষায় থাকি, যে সময়কে স্পর্শ করে জীবন তার গন্তব্য স্টেশনে উপনীত হয়, যেখান থেকে শুরু হয় নতুন এক উপলব্ধির গল্প। সেই উপলব্ধির প্রত্যাশায় থাকি। দিন কাটে। রাত নামে। বৃষ্টি হয়। তবু কিসের এক খোঁজ সারাক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তার উত্তর জানবো বলে জীবনের সব পাতা উল্টে দেখি বারবার। কবিতা যাপন চলে, কবিতা পড়তে যাই নানা অনুষ্ঠানে। সুদীপ্ত যাপন সেও চলে। প্রেম কোন আগুনরাঙা সন্ধ্যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তমাখা আকাশ দেখে।
সে প্রেম ছিলো আগুনের মতোই। যেন নিজেই নিজেকে গিলে খাবে এমন তার তেজ। এতই উদ্ধত আর দুর্বিনীত সেই প্রেম, যেন গোটা পৃথিবীকে সে অস্বীকার করতে পারে এক লহমায়। যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে সমাজের সব নিয়ম। এই ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্যে সুদীপ্ত লেখে,
আরেকটা অন্ধকার পেরোবার আগে
পরাগ মন্ত্রে বলো প্রেম বলো প্রেম
বলো ভালোবাসি ঋজু নাম নিয়ে!
অলীক শৃঙ্গ ছুঁয়ে কে তুমি
আগুনের আপেল লুফেছ?
আকরিক দাঁতে ছিঁড়ে ফ্যালো শীতবস্ত্র তার!
এত প্রেম এত প্রেম দাহ্য লোহা হাতে
তবুও ফুরোবেনা তারা মহুল প্রদেশে—
ফিরে এসো অতিক্রান্ত পিরামিডে উষান্ত ঘোড়ায়
তুমি ফিরে এলে পাখি সব করে রব
ছাদেরা গান গায়...
সারা পৃথিবী ভেসে যায় শৃঙ্গার রসে... আমি ফিরে যাই একান্ত তার আশ্রয়ে। ❤
চলবে