
Behind The Rain by Jose Miguel Barrionuevo
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ১
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০১৮
বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই মাকে কলকাতা থেকে ফিরে আসতে হয়, কোন্নগরে দাদুর বাড়িতে। তখন আমি তার পেটে। বিয়েটা অ্যারেঞ্জড ছিল। দাদুই দেখাশোনা করে দিয়েছিলেন, হয়তো সেখানেই ফাঁক থেকে গিয়েছিল। মা সুন্দরী ছিলেন। গান গাইতেন ভালো। ছবি আঁকতেন। বিয়ের আগে তারও গানের ক্লাস, আঁকার ক্লাস, কলেজ, বন্ধু বান্ধব নিয়ে একটি উড়ে বেড়ানো জীবন ছিল। শুনেছি, দাদুর বাড়িতে ওপরের দোতলার ঘরটি ছিল তার গানের ঘর। সেখানে কার্পেট বিছানো থাকতো। কার্পেটের ওপর হারমোনিয়াম, তানপুরা, তবলা আর ঘরে থাকতো ধূপকাঠির সুগন্ধ। এমনই এক আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরে লম্বা চুল খুলে কোলে তানপুরা নিয়ে উনি গান গাইতেন, যেন মীরাবাঈ।
এমনই মা আমার বিয়ে হয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে তার তানপুরা, হারমোনিয়াম, তবলার কোনও স্থান হয়েছিল কীনা আমি জানি না। সঙ্গীত তাল লয় মূর্চ্ছনার বদলে সেখানে এসেছিল বেদনা। হয়তো ধূপকাঠি জ্বালতেও ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। স্বামীর সাথে অসম্ভব কালচারাল ডিফারেন্সের মধ্যেও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তবু, যেমন সব মেয়েরাই করে থাকে কম-বেশি। তাও আজ থেকে তিন দশকেরও বেশি আগে। তারপর আমি তার পেটে আসি। আমাকে গর্ভে নিয়েই মা ফিরে আসেন দাদু-দিদিমার কাছে।
প্রথমে কেউ তাকে সেভাবে বিশ্বাস করতে চায়নি। ভেবেছিল হয়তো খামখেয়ালিপনা। স্বামীর সাথে ঘর করতে গিয়ে মেয়েদের কতকিছুই না সহ্য করতে হয়! এটাই নিয়ম। তাই বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই এভাবে ফিরে আসাটা স্বাভাবিক মনে হয়নি কারো কাছে। আমাকে পেটে নিয়েই মা গান শেখানো শুরু করেন। আমার দাদু নিজেও খুব কালচারাল মানুষ ছিলেন, সমাজসেবী, জনদরদী ছিলেন। উনি কোন্নগরের একটি কালচারাল স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন। ওই স্কুলেই মা সঙ্গীত শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেয়ার সুযোগ পান। স্কুলের পাশাপাশি উনি প্রাইভেটেও গান শেখাতে থাকেন।
সেই তখন থেকে আমারও গান শেখা শুরু। কোনও কিছু শেখার জন্য এর চেয়ে ভালো অবকাশ আর কীইবা হতে পারে বা পারতো! সেই গর্ভের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কত যে গান শুনেছি! ভোরের গান সন্ধ্যার গান বর্ষার গান বসন্তের গান বিরহের গান প্রেমের গান বিচ্ছেদের গান আনন্দ-বেদনার কত রাগ রাগিণী শুনেছি বা অনুভব করেছি। আমার রক্তধারায় মিশে সেসব আমার মর্মে গেঁথে গেছে। যেন কোনও অচিন সমুদ্রে কে আমায় কলাপাতায় করে ভাসিয়ে দিয়ে গেছিলো আর আমি চোখ বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে কেবলি শুনেছি, কেবলই কান পেতেছি তরঙ্গে, আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান...
ন’মাসের পোয়াতি মানুষটা ভারি পেট নিয়ে হেঁটে হেঁটে ছাত্রবাড়ি যেত ঘেমেনেয়ে। হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে সুর যখন চড়ায় উঠতো পুরিয়া ধানেশ্রী রাগে-
পায়লিয়া ঝনকার মোরি
ঝনন ঝনন বাজে ঝনকারি।
পিয়া সমঝাউ সমঝত নাহি
সাস ননদ মোরী দেগি গারি।
এই পিয়া সমঝাউতে এসে, গর্ভের অন্ধকারে শুয়ে শুয়েও আমি এক কম্পন অনুভব করতাম। মনে হতো, সুরের ওঠা-নামার সাথে সাথে মায়ের হৃৎপিণ্ডখানাও তিরতির করে কাঁপছে। তাই যবে থেকে সুরের সাথে সঙ্গীতের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, সেই সেদিন থেকেই আরো দুটো অনুভূতি একই তীব্রতা নিয়ে আমার রক্তে এসে মিশেছিল। একজনের নাম `বিষাদ` আর আরেকজনের নাম `ভয়`। যেই হৃদয়ের স্পন্দনের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম সেদিন পৃথিবীর আলো দেখবো বলে, হঠাৎ তা নিস্পন্দ হয়ে যাওয়ার ভয়। একটি মানুষের শরীর ও মনের বিকাশ তার গর্ভস্থ দশা থেকেই শুরু হয়। অর্থাৎ এ পৃথিবীতে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার অনেক আগে থেকেই। মাতৃজঠর হলো সেই ব্রহ্মাণ্ড যেখানে তুমি কেবল একটি লিঙ্কের সাথে জীবনের সাথে যুক্ত, আর সেই লিঙ্ক বা মাধ্যম হলো `মা`। সেই অন্ধকারে যে প্রাণস্পন্দন সেই তোমার জীবনের আদিম স্পন্দন। মাতৃগর্ভরূপ যে ব্রহ্মাণ্ড সেখানে যেমন তরঙ্গ সৃষ্টি হবে, সে ততোধিক ভাবাবেগ নিয়ে তোমার অস্তিত্ব রচনা করবে। সেখান থেকেই শুরু তোমার আমার জার্নি।
আমিও তেমনি সুর আর বিষাদের তরঙ্গে খেলা করতে করতে অঙ্কুরিত হয়েছি। আমি সেই প্রাণ যাকে ভূমিষ্ঠ করতে গিয়ে জননীকে অনেক চ্যালেঞ্জ আর বেদনার অরণ্যময় পথ পার করতে হয়েছিল। আমি তারই আত্মার অংশ। তাই আনন্দ আমার কাছে সহজে ধরা দেয় না। অনেক ঝংকারের মধ্যে দিয়ে অনেক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমি তার সামান্য স্পর্শটুকু পাই, আর সেই অমৃতসমান আনন্দ আমার কবিতা হয়ে ফিরে আসে।
তখন জুনমাস, বাংলার আষাঢ়। একটু বৃষ্টির জন্য একটু প্রেমের জন্য তেতেপুড়ে থাকার মাস। বিত যাত বরখা ঋতু সজন না আয়ে মোরি ...। তারপর বর্ষা এলো। এত বৃষ্টি হলো যে, সেবার নাকি বন্যা। বৃষ্টি থামারও নামগন্ধ নেই। এমনই কোনও বৃষ্টির রাতে, যখন নিবিড় ঘন শাখার উপর আষাড় মেঘ জল হয়ে ঝরছে অবিরাম, পথঘাট শুনশান, দোকানপাট বন্ধ, নির্জনে চুবুচুবু হয়ে ভিজছে গাছগুলো, সেদিন আমি পৃথিবীতে এলাম। মায়ের শরীরের সাথে যে অসামান্য যোগসূত্রটির বলে এই পৃথিবীতে আমার আসা, তা ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই, এ পৃথিবীতে আমি একা। তাই একাকিত্ব যোগে, কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে, পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্রে এই জাতিকার জন্ম।
জন্মের পর, কপালে গোল টিপ দেয়া, মায়ের পাশে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটির মুখের দিকে চেয়ে কেউ নাকি বলেছিল, ওর নাম হোক তবে `বন্যা`।
লেখক: কবি
চলবে