
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০১৯
আশির দশকে কলকাতা বইমেলায় সৈয়দ শামসুল হককে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছিলেন নাকউঁচু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়— আপনি নাকি বাংলাদেশের বড় লেখক! তা মশাই সল বেলো-র লেখা পড়েছেন?
সৈয়দ হক রেগে গেলেও উচ্চকণ্ঠ হতেন না। তবে জবাবটা দিতেন মোক্ষম। বললেন, শুধু পড়েছি বললে যথেষ্ট হবে না। সল বেলোর ‘হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং’ আমি যখন ‘শ্রাবণ রাজা’ নামে অনুবাদ করেছি, আপনি বোধহয় তখন হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতেন।
নিজের ভারিক্কি পাঠবিদ্যা জাহির করার জন্য কেউ যখন আমাকে শুনিয়ে বলে ওয়ালীউল্লাহ্, অমিয়ভূষণ, কমলকুমার, ইলিয়াস, তলস্তয়, চেখভ, দস্তয়ভস্কি, মার্কেজ, ফুকো, সার্ত্রে, কামুর কথা তখন আমি হাসি লুকিয়ে রেখে হাসি। কেউ কেউ ফেসবুকে ছবি সেঁটে দেয় কিছু বই বা পত্রিকার, যেগুলো তার চোখে উচ্চমার্গের, এবং দেখাতে চায় যে, সে উচ্চমার্গের লেখা পড়ে, তখনও আমার করুণামিশ্রিত হাসি আসে।
কথাসাহিত্যে আমার সরব আগমন একটু দেরিতে। কারণ লিখতে শুরু করার আগে আমাকে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে অনেক। সময়ও নিয়েছি। আমি দশক বিচারে আস্থাহীন। তবে আমার এই দেরিতে আত্মপ্রকাশের কারণে আশির দশকের বদলে আমাকে নব্বই দশকে ঢুকিয়ে রাখেন দশক-বিচারীরা। তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। আমি প্রস্তুতির জন্য সময় নিয়েছি, এটা জানানোই মুখ্য।
আর লেখকের প্রস্তুতি বলতে আমি কেবল গ্রন্থপাঠকেই বুঝি না। মানুষ পাঠ, সমাজকে তন্ন তন্ন করে দেখা, রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বিশ্বায়নের অভিঘাত, বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক-পাঠচক্র, বিশ্ব সাহিত্যের নানা ঘরানা সম্পর্কে ধারণা অর্জন, প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তাদের জীবনদর্শনের পরিচয় পাওয়া— সবকিছুকেই বুঝি।
অনেকেরই ধারণা আমি দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। কিন্তু আসল সত্যটি হচ্ছে, দলীয় রাজনীতির আয়ুষ্কাল আমার খুবই অল্পদিন। আশির দশকে বাম ঘরানার অবস্থান ছিল শক্তিশালী। এবং সম্মানজনকও। তবু দলের মধ্যে পদ-পদবী-অবস্থানের জন্য নেতাকে তোষণ করা, তার বাক্যকে বেদবাক্য বলে মান্য করার প্রবণতা, পদলাভের জন্য অন্যকে ল্যাং মারা, অযোগ্যকে নিজের স্বার্থে ওপরে তুলে আনা— এইসব প্রবণতা বেশ ভালোভাবেই প্রচলিত ছিল। আদর্শবাদী রাজনীতির মধ্যে এইসব জিনিস আমার মধ্যে বিতৃষ্ণা তৈরি করেছিল খুব তাড়াতাড়িই। তাই সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে কোনো দ্বিধা হয়নি আমার। তবে জাতীয় স্বার্থের জন্য যে কোনো মিছিলে থেকেছি সবসময়। এখনো চেষ্টা করি থাকার।
সংগঠন থেকে বেরিয়ে এলেও সঙ্গীদের আমি ত্যাগ করিনি কখনোই। তারাও আমাকে ত্যাগ করেনি। আর সংগঠন করতে গিয়ে ভালো যে জিনিসগুলো শিখেছি, সেগুলোর অনুশীলন করার চেষ্টা করি এখনো। আত্মসমালোচনা, যান্ত্রিকভাবে কোনো ঘটনা বা ব্যক্তি বা দলের ব্যাখ্যা না করা, অন্যের দেখানো আলোর পাশাপাশি নিজের আলো টিমটিমে হলেও সেটিকে ব্যবহার করা, উৎকটভাবে নিজেকে স্বতন্ত্র হিসাবে প্রকাশ না করা— এইসব আমি সংগঠনের কাছে শিখেছি। অনেকেই আমার চাইতে বেশি পাঠ করেছেন মার্কসকে। কিন্তু তারা মার্কসবাদের এসেন্সকে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছেন, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কতখানি আত্মীকরণ করতে পেরেছেন সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। কিন্তু আমি মার্কসবাদকে আত্মস্থ করতে পেরেছি বলেই মনে করি। সেই কারণেই মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতাগুলোও আমি বিবেচনায় রাখি। মার্কসবাদের পুরো প্র্যাকটিস আমার নেই। তা করার কারণও দেখি না। তবু এটুকু বলব, যতগুলি দর্শন এবং মতবাদের সাথে পরিচিত হয়েছি, পৃথিবীকে ব্যাখ্যার জন্য মার্কসবাদকেই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত মনে হয় এখন পর্যন্ত। যদি অন্য কোনো উৎকৃষ্টতর মতাদর্শের সন্ধান পাই, আমি বিনা দ্বিধায় মার্কসবাদ ত্যাগ করে সেই দর্শনকে ধারণ করতে প্রস্তুত। তবে একটা কথা পরিষ্কার যে, কোনো চিন্তাশীল মানুষই কোনো একটি মতবাদ বা শরা-শরিয়ত বা সংহিতায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন না। তার কাছে কোনো একক দর্শন, এমনকী ধর্মীয় দর্শনকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে হবে না। বর্তমান সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে কওমী মাদ্রাসা থেকে পাশ করে আসা অনেক তরুণ-তরুণীর সাথে মত বিনিময়ের সুযোগ ঘটেছে। তারা যখন সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন, দেখতে পাই তাদের মধ্যেও চিন্তার রূপান্তর ঘটে চলেছে। তখনই মনে পড়ে সেই আপ্তবাক্য— শিল্পের কাছে চিরকাল পরাজিত হয় শাস্ত্র।
হুমায়ুন আজাদ তার ‘আমার অবিশ্বাস’ নিয়ে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। আমার কাছে সেটি তখন নাস্তিকতার শিশুপাঠ্য একটি পুস্তক বলে মনে হয়েছিল। কারণ, সেই বই প্রকাশের অনেক আগেই আমরা পাঠচক্রে ঐতিহাসিক এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ পড়ে এসেছি। হুমায়ুন আজাদের প্রবণতা ছিল সবসময় আলোচিত হওয়া। তিনি নাস্তিকতা নিয়ে আলোচিত হতে চেয়েছেন, কিন্তু বস্তুবাদী হতে শেখার অবকাশ পাননি। অথবা হতে চানও নি।
যখন নিজের কাছে পরিষ্কার হলো, রাজনীতি নয়, লেখালেখি করাই আমার কাজ, তখন সাহিত্যের প্রস্তুতিতে ঢেলে দিলাম মনপ্রাণ। সেখানেও একটি সমস্যা। সাহিত্যের কোন মাধ্যমে কাজ করব আমি? ছাত্রজীবনে লেখা শুরু করেছিলাম ছড়া। পরে কবিতার কিছুটা মকশো-ও করেছি। কিন্তু উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে ছড়া-কবিতা দিয়ে আমি নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি না। কথাসাহিত্যে মনোযোগ দিলাম পুরোপুরি। দেখলাম খাপ খেয়ে যাচ্ছে। এই নিজের জন্য সঠিক মাধ্যম খুঁজে নিতে পারাটা লেখকজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ‘নিজেকে জানো’ বলি এবং শুনি আমরা সবসময়। কবি-সাহিত্যিকের জীবনে ‘নিজেকে জানো’-র প্রথম ধাপ হচ্ছে এটাই। কোন মাধ্যমে কাজ করার জন্য তিনি উপযুক্ত। অথবা কোন মাধ্যমটি তার জন্য উপযুক্ত। এটা বুঝতে না পেরে শত শত মানুষ সারাজীবন ধরে তৃতীয় শ্রেণির কবিতা লিখে যান। অথচ তিনি হয়তো হতে পারতেন সবচেয়ে ভালো কাব্য-আলোচক বা কাব্যবিদদের একজন। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক