
আজিজুল হক
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১৩
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ০৮, ২০১৯
১৯৭৩-৭৪ সালে ক্লাস থ্রিতে পড়ি। রাত নামলেই সাধারণ মানুষজন পারতপক্ষে বাইরে থাকত না। সদর দরজা বন্ধ। অদ্ভুত ভীতিতে আচ্ছন্ন মানুষ। দোকানপাট, বাড়িঘরে নিয়মিত ডাকাতি হচ্ছে। গ্রামে তো কথাই নেই। আমাদের অনেক আত্মীয় গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে থাকছেন সপরিবারে।
রাত ৮টা বাজলেই শহর ফাঁকা। গোলাগুলি বা বোমার শব্দ ভেসে আসে। কারা করছে? লোকজন বলাবলি করে, গোলাগুলি করছে মুজিববাদ, রববাদ (জাসদ), আর নকশাল। আমাদের বাড়িতে তখন কলেজ পড়ুয়া একজনই। আমার ফুপাত ভাই। নাম সেলিম। সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা। মানে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল। মুজিববাদের ক্যাডার। সেলিম ভাই বলেছিলেন, নকশালরা সাধারণ মানুষদের কিছু বলে না। ওরা জোতদারদের গলা কাটে।
তবু নকশাল শব্দটি খুব ভীতিকর। বাচ্চারা না ঘুমালে অনেক মা ভয় দেখায়, ঘুমা ঘুমা, নাহলে নকশাল আসবে! একদিন স্কুলে শুনলাম থানাতে ধরে এনেছে কয়েকজন নকশালকে। আমাদের স্কুলের পরে নদী। নদীর ওপারেই থানা, আদালত। টিফিন পিরিয়ডে কয়েকজন সাঁকো পেরিয়ে থানায় গেলাম। পুলিশ আর রক্ষীবাহিনী গিজগিজ করছে। থানা তখন অনেকটাই খোলামেলা। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে চলে গেলাম একেবারে হাজতখানার কাছে। ওমা! এ তো দেখি হাসু ভাই, কাইউম ভাই, হীরা আপা, আর অচেনা একজন। এরাই নকশাল! তেজ দেখে বিশ্বাস করতে হলো। ওই রকম লকআপের মধ্যে থেকেও চারজন হ্যান্ডকাফ পরা হাত উঁচিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে, জয় সর্বহারা! নকশালবাড়ির পথ ধরো, মানুষের রাজ কায়েম করো!
নকশালদের রাজনীতিতে আমার সায় নেই। কিন্তু বিপ্লবীকে তো বিপ্লবীই বলতে হবে। পরে বড় হয়ে দেখেছি নকশালদের কারো কারো পতন এবং পচন। সমাজে উঁচু জায়গা, প্রভাব, টাকা, ঠিকাদারির জন্য এমনকী স্ত্রী-কন্যাকেও ব্যবহার করেছে কেউ কেউ। আর যারা বসে গেছে, তারা ফিরে গেছে নিরুপদ্রব সংসারী জীবনে।
কলকাতায় নকশাল দেখলাম অনেক বছর পরে। সুচন্দন খবর দিল, আজ কফি হাউসে আসবেন আজিজুল হক। পড়িমড়ি দৌড় দিলাম। একটা টেবিলে আরো দুইজনের সাথে বসে ছিলেন আজিজুল হক। বসেই থাকতে হবে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি তো নাই। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সুচন্দন আমার পরিচয় দিল। তিনি জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার? আমার কাছে কেন?
বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। আসলেই তো! তার কাছে কী দরকার আমার? বললাম, নকশাল দেখতে এসেছি। তারপর হড়বড়িয়ে বললাম ক্লাস ফোরে পড়ার সময়কার নকশাল দেখতে যাওয়ার গল্পটুকু। তিনি একটু হাসলেন। চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন! আমি দুচোখ ভরে দেখছি আজিজুল হককে। মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, ছোটখাট কৃষকায় মানুষ। জানি জেলখানায় ভেঙে দেয়া হয়েছে তার শরীরের সমস্ত হাড়-জোড়। অণ্ডকোষের পাশ দিয়ে বৈদ্যুতিক শক লাগিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে পুরুষত্ব। কুড়ি আঙুলের সবগুলো নখ উপড়ানো। চামড়া ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে শুকনো মরিচের গুড়ো আর লবণ মাখানো হয়েছে প্রতিটি দিন। পঙ্গু শব্দটি ঠিক যথেষ্ট মনে হয় না আমার কাছে। নাটোরের স্থানীয় ভাষার একটা শব্দ লুলা। লুলার চলাফেরা-কাজ করার ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। আজিজুল হককে সেই রকম লুলা বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু তার কথায় বা আচরণে বেদনাপ্রকাশের কোনো চিহ্ন নেই। তার ওপর অত্যাচার নিয়ে বাক্যবিস্তারে রাজি নন। শুধু বললেন, আমি এই রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থাকে ভাঙতে যুদ্ধ করেছি। রাষ্ট্র বা সরকার কি আমাকে টর্চার না করে জামাই আদর করবে?
এখন কী করছেন?
বললেন, এখন তো আমার পার্টির কাজে অংশ নেবার সামর্থ্য নেই। আবার অন্যরা আমার সাথে যোগাযোগ করতে এলেই ধরা পড়বে। তাই কোনো সংযোগ নেই। তবে অন্যরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিষাণজী আর মাওবাদীদের ইঙ্গিত করলেন তিনি। তার পেশা কয়েকটি প্রকাশনী সংস্থার বইয়ের প্রুফ দেখা। আর নিজের লেখা বই বিক্রি করা। আগের বইমেলাতে বেরিয়েছিল তার বই ‘গতর’। মেলায় ঘুরে ঘুরে ‘গতর নেবে গো, গতর’... হেঁকে বই বিক্রি করেছেন। ক্ষুব্ধতার সাথে বললেন, বড় পরনির্ভর পেশা। গতরে শক্তি থাকলে রিক্সা চালিয়ে খেতাম।
আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার লেখা তো পড়িনি। কী লিখছেন? তরুণ-যুবকদের স্বপ্ন দেখানোর মতো কিছু কি লিখতে পারছেন? আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বললেন, স্বপ্নেরও তো একটা আধার লাগে। আমাদের তারুণ্যে-যৌবনে একটি কমিউনিস্ট পার্টি ছিল। স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিল। হাজার হাজার তরুণ-যুবক নিজের ক্যারিয়ারের আত্মস্বার্থপরতার সংকীর্ণতাকে জয় করে বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিল। ক্যারিয়ার শব্দটি বলায় মনে পড়ল আজিজুল হক সেকেন্ডারি এবং হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে আইসিএস অফিসার, ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক হতে পারতেন। তিনি নিজের কথা না ভেবে সমাজের মুক্তির জন্য বিপ্লব করতে গেছিলেন।
নিজমনেই বলে যাচ্ছিলেন, পার্টি নাই, তারুণ্যকে ধারণ করার মতো ভালো কিছু নাই, তাহলে তরুণরা করবে কী? তারুণ্যের শক্তি দেখানোর জন্য হুলিগান হবে, বিকৃত পথে যাবে, খুব জোরে মোটর সাইকেল চালিয়ে মনে করবে এটাই তারুণ্যের কাজ। শেষের কথাটা বলতে গিয়ে কান্নায় বেঁকে এসেছিল মুখটা। আমার মনে পড়ল মাত্র কিছুদিন আগে তার একমাত্র পুত্র মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন অসাধারণ মনের জোরে।
আমাদের অভ্যেস টোটকা খোঁজার। তাই বোকার মতো প্রশ্ন করি, তাহলে এখন কী করতে পারি আমরা? আপনিই বা কী করতে চান? উনি রাগলেন না। বললেন, আপনাদের দেশে খবরটা ছাপা হয়নি হয়তো। আমাদের দেশের কিচু কাগজে খবরটা বেরিয়েছিল। রাতের ট্রেনে ডাকাতি করতে উঠেছিল তিনজন ডাকাত। দুইশো জন যাত্রী ছিল সেই বগিতে। কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি। এসেছিল সাধারণ ধুতি আর ফতুয়া পরা একজন বৃদ্ধ মানুষ। ডাকাতের ছুরিকাঘাত সত্ত্বেও সেই বৃদ্ধ অসম যুদ্ধ চালিয়ে গেছিলেন। সেই বৃদ্ধের নাম কানু সান্যাল। নকশাল আন্দোলনের আরেক কিংবদন্তি কানু সান্যাল।
আজিজুল হক বললেন, যখন যেখানে আছি, সেখানে প্রতিবাদ করাই এখন আমাদের কাজ। নিজে সাহস দেখানোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সাহসী করে তোলাই এখনকার কাজ।
ভারতের নথিপত্রে আজিজুল হক নামের কোনো লোকের অস্তিত্ব নেই। তার কোনো রেশনকার্ড নেই, ভোটার আইডি নেই, জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, পাসপোর্ট নেই। অর্থাৎ সরকারের কাছ থেকে কোনো নাগরিকের যে আইনগত পাওনাটুকু থাকে, সেটুকুও দেবে না তাকে সরকার। যতদিন জেলে আটক ছিলেন, ততদিন তাকে বিভিন্ন নাম দেয়া হতো। কখনো রামসিং, কখনো মুহাম্মদ আশরাফ, কখনো বিদঘুটে কোনো নাম। তাকে জেল থেকে বের করে দেয়ার সময়ও নিজের নামটি তালিকাভুক্ত করতে দেয়নি কোথাও। তিনিও কার্ল মার্কসের মতো রাষ্ট্রহীন মানুষ। তবে তাকে স্বাধীনভাবে চলতে দিচ্ছে সরকার। লিখতে দিচ্ছে পত্রিকায়। বইয়ের জন্য প্রকাশকও পাচ্ছেন তিনি।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি স্মৃতি আছে তার। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে শেখ হাসিনা কলকাতায় সফরে গিয়ে কয়েকজনের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের আজিজুল হকের সাথেও দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শেখ হাসিনা উঠেছিলেন বিমান বন্দর রোডে ‘সোনার বাংলা’ নামের ফাইভস্টার হোটেলে। আজিজুল হক সেখানে যেত রাজি হননি। কারণ, ঐ হোটেল তৈরির সময় যে গরিব মানুষগুলোর ভিটে এবং জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছিল, সেই মানুষদের নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন আজিজুল হক। আন্দোলন যে খুব একটা সফল হয়েছিল তা নয়। কিন্তু নিজেকে সেই হোটেলের লবিতে বা কক্ষে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না আজিজুল হকের পক্ষে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছিল সাক্ষাতের। তিনি শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, বাঙালিদের নিজেদের দেশ হয়েছে, সেই দেশটাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার তো কোনো কাগজপত্র নাই। আপনি চাইলে হয়তো ব্যবস্থা হতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আপনারে বাংলাদেশে নেওয়া মানে ঝামেলা। সুনীল যাইব উপন্যাস নিয়া, শক্তি যাইব কবিতা নিয়া, কিন্তু আপনি তো ভাই যাইবেন দিয়াশলাই নিয়া মানুষের মনে আগুন জ্বালাইতে।
বাংলাদেশের আর একজন রাজনীতিবিদের সাথে আজিজুল হকের ভাই-ভাই সম্পর্ক। তিনি লতিফ সিদ্দিকী। তার গল্প আরেকদিন হবে। আদর্শবাদী রাজনীতি থেকে ঝরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। স্খলন এবং পচন ধরা বিপ্লবীর উদাহরণ অনেক। কিন্তু আদর্শ বিক্রি না করে আত্মদান করা এবং আজীবন আদর্শকে বুকে নিয়ে পথচলা বিপ্লবীর সংখ্যাও অনেক। যারা বারবার পতিতদের কথা উদাহরণ হিসাবে টেনে আনে, তারা মূলত তা করে দুইটি কারণে। একটি কারণ হচ্ছে নিজেদের পতন এবং পচন জায়েজ করা। অন্যটি হচ্ছে, নিজেদের দল যে কোনোদিন আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মী জন্ম দিতে পারেনি বা পারবে না, তা তাদের জানা। বিপ্লবীর আদর্শিক পতন দেখলে সে খুশি হয়ে ভাবে, আমাদের দলকে এককভাবে আর দোষ দেওয়া যাবে না। আমি বাজারে গেলে পচা মাছ কিনি না। পচা রাজনীতি, পচা রাজনীতিক, পচা আমলা-পুলিশ, মাথাপচা বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকাব কোন দুঃখে? চোখের সামনে আজিজুল হক তো আছেন। তার মতো আরো অনেকেই আছেন।
কলকাতায় আমার প্রথম প্রকাশিত বই ‘কুরসিনামা’। ‘দীপন’ সম্পাদক এন জুলফিকারের উস্কানিতে ছোঁয়া প্রকাশনীর তারেক কাজী আর সুনিতা প্রকাশ করেছিল বইটি। আমার দ্বিধা ছিল। সেটি সত্য হয়েছে। এখনো পর্যন্ত ‘কুরসিনামা’ সেখানে ৫০-৬০ কপির বেশি বিক্রি হয়নি। ওদের পুরো টাকা জলে গেছে।
‘কুরসিনামা’র কথা যে বলছি তার কারণ আলাদা। কলকাতা বইমেলায় মোড়ক উন্মোচিত হয়েছিল বইটার। সেদিন শঙ্খ ঘোষ এবং দেবেশ রায় ছিলেন মেলায়। একসাথেই ছিলাম আমরা। তাদের যে কাউকে মোড়ক উন্মোচনের জন্য পেলে বর্তে যায় যে কেউ। হয়তো আমিও। তবে ‘কুরসিনামা’র মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন আজিজুল হক। সে এক বিরাট প্রাপ্তি আমার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক