
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১৭
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ১৪, ২০১৯
রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতার সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন। সম্পাদনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাভাষার সকল প্রতিনিধিত্বশীল কবি ও কবিতাকে সমকালীন এবং ভবিষ্যতের পাঠকের সামনে তুলে ধরা। এই কাজটিতে খুব শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। শিব গড়তে বানর গড়ে ফেলেছিলেন।
‘বাংলা কাব্যপরিচয়’ নামের এই সংকলনটি প্রকাশের মাত্র কয়েকদিনের মাথাতেই এটি সরিয়ে নিতে বা বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ ব্যাপক সমালোচনা। বিরূপ সমালোচনা। তার চাইতে বড় কথা সমালোচনা ছিল ন্যায্য। রবীন্দ্রনাথের পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব বা প্রভাবও এই সংকলনের বিরুদ্ধে অব্যাহত মতামত প্রকাশ বন্ধ করতে পারেনি। সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন প্রমথনাথ বিশী, দিলীপকুমার রায়, যতীন্দ্রমোহন, জীবনময় রায় থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পর্যন্ত।
রবীন্দ্রনাথের এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত, কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়, কিশোরীমোহন সাঁতরার কবিতা। তাদের একমাত্র যোগ্যতা, তারা ছিলেন সেই সময় রবীন্দ্রনাথের পার্শ্বচর। সংকলনে স্থান পেয়েছিল বনফুল, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী, হাসিরাশি দেবী, সুকোমল বসুর কবিতাও। অথচ স্থান পাননি অতুলপ্রসাদ। স্থান পাননি বিষ্ণু দে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তর এমন একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন যা ছিল তার প্রথম দিকের লেখা নিজেরই অপছন্দের একটি কবিতা। ‘অর্কেস্ট্রা’ ও ‘ক্রন্দসী’ ততদিনে বেরিয়ে গেছে। অথচ সুধীন দত্তের সেইসব কবিতাকে বিবেচনায় না নিয়ে স্থান দেওয়া হয়েছে ‘নবীন লেখনী’র মতো দুর্বল কবিতাকে। জীবনানন্দ দাশের পদবী সংকলনে ছাপা হয়েছে ‘দাস’ বলে। এবং আরো আশ্চর্যের বিষয় তার ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি সংকলনে ঠাঁই পেয়েছে ইচ্ছামতো কাট-ছাঁটের মাধ্যমে। এমন অধিকার কোনো সম্পাদকের থাকে?
‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার ১৩৪৫-এর আশ্বিন সংখ্যায় অশোক মিত্র ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’কে ‘নিকৃষ্ট সংকলনগ্রন্থ’ বলে রায় দিলেন। একই সময়ে অর্থাৎ ১৩৪৫ এর আশ্বিন মাসেই ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু তুলোধূনা করলেন ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’কে। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য বিশ্বভারতী থেকে ‘কবিতা’ পত্রিকায় যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো, সেটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। তবুও রবীন্দ্রনাথ বাধ্য হলেন ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’কে প্রত্যাহার করে নিতে। এই ঘটনা আমাদের অনেক কিছুই চিন্তা করতে শেখায়।
প্রথমত, কোনো সংকলন সম্পাদনা, লেখা নির্বাচন ও লেখক নির্বাচন সম্পাদক নিজের ইচ্ছামতো করার অধিকার রাখেন না। লেখা নির্বাচনে তিনি স্বাধীন নন। ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের মাপকাঠিতে কোনো সংকলন সম্পাদনা করা যাবে না। কারণ সম্পাদক একটি কালখণ্ড বা সময়খণ্ডকে ধারণ করেন। সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক ও রচনাগুলিকে স্থান দিতে তিনি বাধ্য। সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি একটি বিশাল দায়িত্ব পালন করছেন। তার সম্পাদিত গ্রন্থটি ভবিষ্যতে গবেষণায় ব্যবহৃত হবে, ব্যবহৃত হবে সাহিত্যের ইতিহাস রচনায়। সম্পাদকের খেয়াল-খুশি সাহিত্যের ইতিহাস রচনাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। আবার তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য দিয়ে সংকলন করলে ভবিষ্যতে তাকে অবশ্যই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। হয়তো সেদিন জবাব দেবার জন্য তিনি নিজে পৃথিবীতে উপস্থিতও থাকবেন না। তখন একতরফা কালিমালিপ্ত হবে তার সম্পাদনাকর্ম।
অনেক ধরনের সংকলন প্রতিবছর বইমেলাতে প্রকাশিত হয়। অথচ সেগুলি আলোচিত হয় না বললেই চলে। প্রধান কারণ হচ্ছে এই সংকলনগুলোর পেছনে খুব পরিষ্কার কোনো উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনার ছাপ থাকে না। অধিকাংশই হয় গোষ্ঠীগত। কিছু কিছু হয় বিষয়ভিত্তিক। সেগুলি কোনো বুদ্বুদ না তুলেই মিলিয়ে যায়। পরিশ্রম অনুযায়ী সাড়া পান না সম্পাদক-প্রকাশক। বইমেলার আগে তড়িঘড়ি করে একটি গল্প বা কবিতার সংকলন করতে আসেন অনেকে। অথচ একটি ভালো সংকলন করার জন্য কমপক্ষে ২-৩ বছর ধরে কাজ করা উচিত। সংকলনে শুধুমাত্র গল্প বা কবিতা থাকবে না, থাকবে বড়-সড় ভূমিকা বা সম্পাদনা-তথ্য। কেন এই সংকলন করা হলো, কেন বাছাইকৃত লেখকদের এখানে গ্রহণ করা হলো, বাছাই-এর মানদণ্ড কী, অনেকের দৃষ্টিতে শক্তিশালী কোনো কোনো লেখককে কেন সংকলনভুক্ত করা গেল না— এইসব তথ্য না থাকলে সম্পাদনাটি অর্থবহ হয় না। আর বইয়ের শেষে সংকলিত লেখকদের চুম্বক-পরিচিতি দিতে হবে। যাতে পাঠক-গবেষক লেখকের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বই এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।
আমাদের দেশে তেমন পূর্ণাঙ্গ সংকলন খুব বেশি হয়নি। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’। গল্পগ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন আবুল হাসনাত। মোটামুটি ভালো মানের সংকলন। কিন্তু এই ধরনের সংকলন ১০-১২ বছর পর পর বর্ধিতকরণের দরকার পড়ে। কারণ নতুন লেখক আসছেন, নতুন গুরুত্বপূর্ণ লেখা পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো সংযোজিত না করলে একসময় ঘাটতি সকলেরই চোখে পড়ে, এবং সম্পাদিত গ্রন্থটি অপূর্ণাঙ্গ মনে হতে থাকে।
খুব বিতর্কিত একটি সম্পাদনা ও সংকলন ছিল রণজিৎ দাশ এবং সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের কবিতা’। বাংলাদেশের কবিতাকে যখন দেশ-বিদেশের বাংলাভাষী পাঠক-গবেষকদের কাছে উপস্থাপন করা হয়, তখন সেই কাজটি করার জন্য বাংলাদেশের কবিতার সার্বিক দিকগুলোর সাথে পরিচিত থাকা যেমন দরকার, তেমনই দরকার গুরুত্ব অনুযায়ী কবি ও কবিতাকে ঠিকভাবে বিন্যাস করা। এই সংকলনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি ও কবিতার জায়গা হয়নি। আবার অনেক গৌণ কবি এবং কবিতা ঢুকে পড়েছিল। কাকবন্ধ্যা লেখক বা কাকবন্ধ্যা কবি বলে একটি অভিধা আছে। একটা-দুইটা বই করার পর সাহিত্য জগৎ থেকে উধাও হয়ে যান তারা। কিন্তু প্রভাবশালী সম্পাদক-বন্ধুদের সুবাদে তারা জায়গা পেয়ে যান অনেক সংকলনে। সাজ্জাদ শরিফ এবং রণজিৎ দাশ এইরকম বেশকিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তারা দুজনেই দুই বাংলার সাহিত্য জগতে মোটামুটি সেলিব্রেটি। তাই পশ্চিমবঙ্গে বেশ সাড়া ফেলেছিল বইটি। বিক্রি হয়ে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। পরবর্তীতে রণজিৎ দাশ অন্তত ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নতুনভাবে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করে নতুন এডিশন প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা প্রথমেই হয়ে গেছে। প্রথম সংস্করণ যিনি কিনেছেন, তিনি তো খুব সহসাই দ্বিতীয় সংস্করণ সংগ্রহ করতে চাইবেন না।
আমাদের দেশে দশকওয়ারি সংকলন করার প্রথা আছে। দশকওয়ারি চিন্তা ভালো না মন্দ তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না। তবে প্রথা যে আছে, সেটি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সত্তর, আশি, নব্বই দশকের গল্প এবং কবিতার সংকলন বেরিয়েছে। বেশ কয়েকটি করে। একাধিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রকাশনী থেকে। কোনোটাই যে শতভাগ অবিতর্কিত নয়, সেকথা না বললেও চলে। তবু সেগুলো থেকে মোটামুটি পরিষ্কার একটি ধারণা পাওয়া যায়।
এরই মধ্যেই বেরিয়েছে ‘শূন্য দশকের গল্প’ ‘পয়লা দশকের গল্প’ও। সেগুলোর কয়েকটি আমি সংগ্রহ করেছি। প্রথমেই ধাক্কা খেয়েছি এটা দেখে যে ঐ সংকলনগুলোতে ভালো গল্পের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের কম। নতুন প্রজন্মের লেখকরা আগের প্রজন্মের চাইতে লেখায় দুর্বল হবে, এমনটি ভাবা যায় না। এমনটি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু শূন্যের এই সংকলনগুলোকে যদি ঐ সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল গল্পের সংকলন বলে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্মের গল্প নিয়ে আশাবাদী হবার সুযোগ খুব কমে যায়। খুব রূঢ়ভাবেই বলতে হয়, সংকলনের সবচেয়ে দুর্বল গল্পের লেখক হিসাবে পাওয়া যাচ্ছে সম্পাদককেই। নিজের গল্পের মানই যদি এমন হয়, তাহলে তিনি সম্পাদনা করতে পারেন কোন যোগ্যতায়? আমার তাই মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল থেকে যাচ্ছে। একটা হতে পারে, গল্প নির্বাচন ঠিক হয়নি। আরেকটি হতে পারে, এই দশকে লিখতে আসা তরুণ-তরুণীরা এখনো পরিপূর্ণ গল্পলেখক হয়ে উঠতে পারেননি। সেক্ষেত্রে তাদের আরো সময় নিতে এবং দিতে হবে। শূন্য দশকের গল্পের বাছাইকৃত সংকলন আরো ২০ বছর পরে বেরুলেও ক্ষতি নেই। অপেক্ষাতেও ক্লান্তি নেই। অপেক্ষা শেষে আমরা যেন সত্যিকারের যোগ্য গল্পগুলির সংকলন পাই।
অনুজরা হয়তো রুষ্ট হবেন আমার ওপর। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ এটাই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক