পুলিশ ভ্যানে কবি হেনরী স্বপন

পুলিশ ভ্যানে কবি হেনরী স্বপন

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ১৮

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০১৯

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে ‘ব্লাসফেমি আইন’ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্যোগের পেছনে জামায়াত এবং অন্য গোঁড়া ইসলামি দলগুলোর ভূমিকা ছিল ব্যাপক। যেহেতু তাদের সহায়তা নিয়েই ক্ষমতায় বসেছিল বিএনপি, তাই তাদের দাবিটিকে গ্রাহ্য করার হেতু বিএনপির ছিল।

প্রতিরোধ এসেছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পুরোভাগে থেকে বিভিন্ন প্রগতিশীল লেখক সংগঠন এবং সংগঠন-বহির্ভূত লেখকদের সংগঠিত করেছিলেন। লেখক-কবিরা সমবেত হয়ে মিছিল করেছিলেন ঢাকার রাজপথে। পথসভা, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। সরকার এই পদক্ষেপ স্থগিত না করলে লেখক-কবিরা দলবেঁধে আমরণ অনশন করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

মনে আছে, এই ব্লাসফেমি বিষয়টা নিয়ে ইলিয়াস ভাই ফোনে কথা বলেছিলেন আল মাহমুদের সাথেও। তিনি তখন বিএনপি-জামায়াতের রাজকবি। আল মাহমুদ কিন্তু স্বীকার করেছিলেন যে, ব্লাসফেমি আইন শিল্প-সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার কবিসত্তা তাকে বাধ্য করেছিল এই সত্যটি স্বীকার করতে। তিনি মিছিলে আসেননি। ইলিয়াস ভাই বা আমরা কেউ-ই সেটি আশাও করিনি।

খালেদা জিয়ার সরকার পিছু হটেছিল। ব্লাসফেমি আইন তারা উত্থাপন করেনি সংসদে। আওয়ামী লীগ আমলে একের পর এক এমন সব আইন এবং প্রগতিবিরোধী কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত যা করার সাহস পেত না। এই সরকার ৫৭ ধারা করেছে, ৩২ ধারা করেছে, হেফাজতের সুপারিশে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়েছে, হিন্দু বলে অনেক লেখকের লেখা বাদ দিয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আওয়ামী কবি-লেখকরা এইসব বিষয়ে টুঁ শব্দটি করতেও নারাজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সাথে কথা বলেছি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এসব নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে বিএনপি-জামায়াতের সুবিধা হবে। আশ্চর্য! যে আইন জাতির গলা টিপে ধরবে এবং ধরছে, সেই আইনের বিরুদ্ধে মুখ খুললে সরকারের অসুবিধা হবে! জাতি বড় না সরকার বড়? এই প্রশ্ন তুললে তারা সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের মতো শেখ হাসিনার উন্নয়নের মুখস্ত বুলি আউড়ে পাশ কাটিয়ে গেছেন।

সাংবাদিকদের তো প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করবে এইসব আইন। সাংবাদিক নেতারা, সম্পাদকরা কয়েকদিনের জন্য সোচ্চার হয়ে উঠলেন। তারপর যথারীতি চুপ। সরকারের পক্ষ থেকে কোন দাওয়াই যে দেয়া হলো তাদের, আল্লাই মালুম। দেখা গেল, টক শো-তে এসে তারা যথারীতি সরকারের গুণ গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তোলার কাজ চালিয়ে গেলেন। এখনো যাচ্ছেন। আর এই বিষয়ে মুখ খুলছেন না।

ব্লগারদের যখন একের পর এক হত্যা করা হচ্ছিল, তখন উদীচীর পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদলিপি পেশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার খুব হতাশ হয়ে আমাকে বললেন, অমুক অমুক বড় কবি সরাসরি বলেছেন যে, তারা স্বাক্ষর দিতে পারবেন না। উল্টো সেই সময় পুলিশের আইজি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সবারই বুঝে-শুনে লেখালেখি করা উচিত। হলি আর্টিজানে বিদেশি নাগরিক এবং ধনীদের পোলামেয়েরা জবাই না হলে সরকার আদৌ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতেন কি না সন্দেহ। অন্তত তার আগপর্যন্ত সরকারের কোনো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই।

২০১৮ সালের নির্বাচন নামের কোনোকিছু তো হয়নি। সেই সময় আমি বাম-গণতান্ত্রিক জোটকে সমর্থন জানিয়েছি। যতটা পেরেছি তাদের সপক্ষে কথা বলেছি। আওয়ামী কবিরা ততদিনে আমাকে প্রায় জামায়াত-রাজাকার বানিয়ে দিয়েছে। আমি তাদের বলেছি, আওয়ামী লীগকে আপনি অবশ্যই সমর্থন করতে পারেন, তার পক্ষে ভোট চাইতে পারেন, তবে কবি বা লেখক হিসাবে আপনাদের উচিত আওয়ামী লীগের কাছে কিছু দাবি তুলে ধরা। শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানে আপনারা আমন্ত্রণ পান, বিদেশে তার সফরসঙ্গী হন, আপনাদের সুযোগ আছে এইসব ডিজিটাল আইনের কুফল সম্পর্কে তাকে অবহিত করার। সেটি তো আপনারা করতে পারেন। যদি আলাদাভাবে না করতে পারেন তাহলে হাজার হাজার কবি-লেখক নিয়ে আপনাদের যে বিশাল সংগঠনগুলো আছে, যেগুলো নিয়ে আপনারা মোটামুটি ভালো ব্যবসা-পাতি করেন, সেই সংগঠনের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে এনেও তো অনুরোধ জানাতে পারেন। তাকে মনে করিয়ে দিতে পারেন যে `সুশাসন` নামের একটি শব্দ আছে, যা না থাকলে উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে যায়।

পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত বিষয়টাকেও তারা গুরুত্ব দেননি বিন্দুমাত্র। উদীচী একটি সংকলন করেছিল পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়া লেখাগুলো নিয়ে। আমরা লেখক-কবিদের কাছে সেগুলো পৌঁছে দিয়েছি। সম্ভবত কেউ পাতা উল্টে দেখেননি। অন্তত তাদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অথচ ইনারা নাকি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শেকড়সন্ধানী কবি, প্রেমিক-বিপ্লবী কবি, তামাটে মাটির কবি, জনতার কণ্ঠস্বরের কবি! আরো কত খেতাব যে নিজেদের নামের সাথে ইনারা জুড়ে নিয়ে বেড়ান!

আসলে আওয়ামী লীগের প্রতি যে ভালোবাসাটা তারা প্রকাশ করেন, তা সম্পূর্ণ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। বিভিন্ন একাডেমি, বিভিন্ন কেন্দ্র, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পদ লাভ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমোশন বা ভিসি পদ পাওয়া, বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী কমিটিতে সদস্য পদ পাওয়া, টেলিভিশনে চাঙ্ক পাওয়া, দেশ-বিদেশের সাহিত্য সম্মেলনে সরকারি ডেলিগেট হবার সুবিধা পাওয়া-- এসবই অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। বাহ্যিকভাবেই যা প্রমাণ করা যায় ব্যক্তি ধরে ধরে। আখেরে হলোটা কী?

ক্ষতিগ্রস্ত হলো জাতি। এবং যা তাদের হিসাবে নাই, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা নিজেরাও। এই মানুষগুলেই একসময় সত্যিকারের লেখক-কবি হয়ে ওঠার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বৈষয়িক সফলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আর পারলেন না নিজেদের কবিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। তারা পুরোটাই হারিয়ে ফেলেছেন নিজেদের ক্রেডিবিলিটি। দলান্ধ লোকজন ছাড়া আর কেউ তাদের প্রতি কোনো সম্মান পোষণ করে না।

আজ ডিজিটাল আইনে কবি হেনরী স্বপন কারাগারে। লেখার কারণে প্রথমে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তারপর তাকেই আবার জেলে বন্দি করা হয়েছে। এই ডিজিটাল আইন যদি বাতিল না হয়, তাহলে একদিন আওয়ামী কবি-লেখকরাও এই আইনে জেল-জুলুম খাটতে বাধ্য হবেন। কারণ আওয়ামী লীগ চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নেই। আহমদ ছফা নেই। তাদের শূন্য জায়গা পূরণ করার যোগ্য কেউ আসেনি। ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে লেখক-কবিদের রাজপথে নামার যে আহ্বান ইলিয়াস জানিয়েছিলেন, ৫৭ বা ৩২ ধারার বিরুদ্ধে কেউ এখনো তেমন আহ্বান জানাচ্ছেন না।

কিন্তু এটি নিশ্চিত যে আহ্বান আসবে। আর সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো বিবেকবান লেখক-কবিরও অভাব হবে না এই দেশে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক