রহমান মুফিজের গল্প ‘হাবু, বদি ও সান্ডার বিরিয়ানি’

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২৫

এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। কোনো চরিত্র বা ঘটনা কারো সঙ্গে মিলে গেলে সেটাকে নিছক কাকতালীয় ধরে নেবেন।

অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে হাবু উদাস হয়ে যায়। এমন দিন ছিল তাদের, বিরিয়ানি তো দূরের কথা, ঠিকঠাক পান্তাভাতও জুটতো না। আজ বিরিয়ানি তো বিরিয়ানি, একেবারে সান্ডার বিরিয়ানি জুটেছে পাতে। আহা! সান্ডার বিরিয়ানি! হাবুর চোখে জল বাঁধ মানে না। চোয়াল গড়িয়ে বুক, বুক গড়িয়ে পেট, পেট গড়িয়ে নাভি… এভাবে চোখের জল যে কত পথ মাড়িয়ে মাটি ছুঁয়েছে, বলা মুশকিল।

হাবুর সামনে সান্ডার বিরিয়ানি— এইটাই এই মুহূর্তে এই মহাজগতের পরম বিস্ময় মনে হচ্ছে তার কাছে। কোথাকার সান্ডা কোথায় এসে আজ বিরিয়ানির উপাদেয় গোশত হয়ে গেছে— ভাবতেই মনটা চনমনে হয়ে উঠছে।

সান্ডা সম্পর্কে এতদিন কিছুই জানতো না হাবু। সম্প্রতি ফেসবুকে কফিলের পোলা ও সান্ডার বিরিয়ানি সম্পর্কিত রিলস ভাইরাল হওয়ার পর সান্ডা সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের দেশের তক্ষকের মতো দেখতে এক ধরনের সরীসৃপ, মরুভূমিতে চরে বেড়ায়। সৌদি আরবের শেখরা নাকি বেশ আনজাম করে সান্ডা শিকারে যায়। আর সান্ডা ধরে তার ফ্রাই ও বিরিয়ানি খায়। খেতে কেমন তা জানার উপায় নাই হাবুর।

সান্ডার বিরিয়ানির নাম শোনার পর থেকেই হাবুর মনে এই বিরিয়ানি খেয়ে সৌদি শেখদের মতো ঢেঁকুর তোলার খায়েশ জন্ম নিয়েছে। সে খায়েশের কথা কাউকে বলাও যায় না। নিজের শখ-আহ্লাদের কথা মনে গভীর কোণার মধ্যে লুকিয়েই রেখে দিতে হয়েছে। কারণ সান্ডার গোশত কিনবে সে সাধ্য তার নাই। আজ সান্ডার বিরিয়ানি হাতে শেখ বদির প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় হাবুর মাথা নত হয়ে আসে। হাবুর ইচ্ছা হয়, বদির সারা গা চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয়। হাবুর ইচ্ছা হয়, একশো বছর বদির গোলাম হয়ে থাকার।

শেখ বদিউল, নামকরা আদম বেপারি। মধ্যপ্রাচ্যে আদম ব্যবসার তার বিশাল নেটওয়ার্ক। হাবুদের উজানদিয়া গ্রাম থেকে প্রচুর গরিব জোয়ান-জোয়ানিকে সৌদি পাঠিয়ে গোটা গ্রামকে পেট্রো ডলারে আলোকিত করেছেন মহৎ-হৃদয় বদিউল। এবার সৌদি থেকে ফিরে পুরো গ্রামকে সান্ডার বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছেন। বদিউলের নামে জয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে উজানদিয়া গ্রাম ছাড়িয়ে পটলতোলা শহর পর্যন্ত। শেখ বদির সান্ডার বিরিয়ানি খাওয়ার আয়োজনে পটলতোলা থেকেও প্রচুর লোকজন এসেছে। তারা বদির নামে কত যে সুনাম করছে, শুনলেই মন জুড়িয়ে যাচ্ছে হাবুর।

শেখ বদির নামে এসব সুনামও কম হয়ে যাবে। যিনি গোটা গ্রামের লোকজনকে সান্ডার বিরিয়ানি খাওয়াইতে পারেন, তার প্রসংশা এত কম কথায় শেষ হবে কেন? হাবু হিন্দু হইলে এবং সাধ্য থাকলে শেখ বদির নামে ৬৪ প্রহর নামকীর্তনের আয়োজন করতো। যেহেতু সে মুসলমান, তার করা উচিত দোয়া-মাহফিল। বদির নামে টানা ৭২ দিন দোয়া মাহফিল করলে মুটামুটি আল্লাহ তার এ কৃতজ্ঞতা কবুল করবেন।

হাবু সান্ডার বিরিয়ানি সামনে রেখে হাত তোলে মোনাজাত ধরে। পরম কৃতজ্ঞতায় চোখ দুটো বুঁজে আসে। মৃদুস্বরে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে, ইয়া আল্লাহ, আমি তোমার নাদান বান্দা। তুমি আমারে এমন আনন্দ, এমন সুখের দিন দেখাবা ভাবতে পারি নাই। কোন সুদুর মরুর বুকের সান্ডার গোশত আমার পাতে আজ আহার হিসাবে দিলা, এ কেবলই তোমার কেরামতি। এক গোনাহগার বান্দার প্রতি এ তোমার অশেষ রহমত। যার উছিলায় তুমি আমারে আজ এমন আজিব প্রাণির মাংস খাওয়ার তওফিক দিলা, সেই পরম দিলদার, তোমার খাস বান্দা শেখ বদিউলরে শত বছরের হায়াত দিও। তার জন্য জান্নাতের উচ্চতর মোকাম বরাদ্দ রাইখো আল্লাহ...

আশপাশে হঠাৎ মৃদুধ্বনি। গুঞ্জন। সান্ডা জিনিসটা হারাম নাকি হালাল? সান্ডার গোশত হারাম নাকি হালাল— বাক্যটা মৃদুস্বরে কানের কাছে পৌঁছাতেই হাবুর বুকটা ধক করে ওঠে। ক্ষুধার্ত পেটের মধ্যে একটা ঘূর্ণি-মোচড় লাগে। কান থেকে শিরদাঁড়া, শিরদাঁড়া থেকে কোমরপর্যন্ত একটা হিম যেন সান্ডার মতো দৌড়ে নামে। পটাশ করে চোখ খুলে যায় হাবুর।

আশপাশে দুয়েকজন বলতে শুরু করে সৌদির লোকেরা যেহেতু খায়, নিশ্চয় হালাল জিনিসই হবে। নবির দেশের লোকেরা কি হারাম জিনিস খাইতে পারে?

সান্ডার গোশত হারাম না হালাল, এ চিন্তা এতদিন মাথাতেই আসেনি। কেন বিষয়টা মাথায় আসেনি, সেটা ভাবতে পারছে না হাবু। মুহূর্তেই প্রচণ্ড অপরাধবোধ পেয়ে বসে তাকে। মোনাজাত ধরা অবস্থাতে হাবু আসমানের দিকে মুখ তোলে, হে আল্লাহ, তুমি আমায় এ কোন পরীক্ষায় ফালাইলা? পেটের মধ্যে ক্ষুধা, পাতের মধ্যে সান্ডার বিরিয়ানি, মনের মধ্যে সংশয়— হারাম না হালাল, এ কোন কিসিমের পরীক্ষা…

‘সান্ডা মাকরুহ্। নবিজি নিজে সান্ডা খান নাই তবে খাইতে মানাও করেন নাই। তাই কিছু আলেম মনে করেন সান্ডা মাকরুহ, আর কিছু আলেম মনে করেন জিনিসটা অপছন্দীয়। অর্থাৎ দেখতে বীভৎস, ফোসকা পড়া, খাঁজ কাটা, খসখসে টিকটিকির মতো, ঘর্মাক্ত বগলের মতো হাল্কা গন্ধযুক্ত…’

হাবুর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে সান্ডা জায়েজ করছেন শেখ বদিউল। বদিউলের দুই পাশে তার অনুসারীরা। পেছনে দুই বাহু ফুলিয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে পটলতোলা শহর থেকে আসা বেশ কয়েকজন মোষসদৃশ লোক। সবাই হাবুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে  যেন, ওরা হাবুকে হাড়শুদ্ধ চিবিয়ে খাবে। শান্ত দেখা যায় শুধু বদিকে।

শেখ বদি:  খাও, সান্ডার গোশত বগলের গন্ধযুক্ত হইলেও বড়ই উপাদেয়। খাইলে চেতনা শাণিত হবে। সামনে আওয়ামী লীগের হয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নামতে হবে। গ্রামে গঞ্জে ইতিহাসের কথা কইতে হবে।
হাবু: কিন্তু সান্ডার গোশত হারাম না হালাল, বিষয়টা তো ক্লিয়ার না…

পটলতোলা শহর থেকে আসা মোষসদৃস এক তরুণ চোখ পাকিয়ে, মুখ খিঁচিয়ে হাবুকে একটা ধমক দেয়, খা শালা। পটল ভবন থেকে নির্দেশ আসছে, না খাইলে পিটাইয়া খাওয়ামু।

ধমকের চোটে হাবু মুতে দেয়। একদম চিরচির করে মুতে দেয়। তাকে মুততে দেখে মোষসদৃস তরুণদের একজন দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বলতে দেরি আছে, মারতে দেরি নাই। এগিয়ে এসে হাবুর মুখের মধ্যে সজোরে লাগিয়ে দেয় ঘুষি।

ঘুষি খেয়ে আহ করে চিৎকার করে ওঠে হাবু। ঘুম ভেঙে যায় তার। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে। ফেটে বেরিয়ে আসা চোখ নিয়ে সামনে গজরাতে থাকে হাবুর বউ।, ডায়াবেটিসের রোগী, ধ্বজভঙ্গ মিনসে, এই বয়সেও মানুষ বিছানায় মোতে?

হাবুর নিচে ভেজা, ঘামে মুখও ভিজে গেছে। ভিজে সব একাকার। এতক্ষণ তাইলে স্বপ্ন দেখছিল! কী ভয়াবহ স্বপ্নরে বাবা!! ভাগ্য ভালো, বউয়ের ঘুষি খেয়ে স্বপ্নটা ভাঙলো। নইলে স্বপ্নের মধ্যে আরও কী কী যে হতো, আল্লাহ জানে। হাবু ঘামছে আর কাঁপছ। কাঁপছে আর শক্ত হয়ে বসে আছে।

কাঁপন শেষ হওয়ার আগে বউয়ের আরেকটা ঘুষি উড়ে আসে হাবুর মুখ বরাবর। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে দৌড় মারে সে। যেন একটা তাড়া খাওয়া সান্ডা দৌড়াচ্ছে কুরকুর করে।