
রাজনীতি ও প্রেমের মেলবন্ধন ‘কালবেলা’
মো. খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সলপ্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০১৮
সমরেশ মজুমদারের লেখায় আলাদা একটা আবহের জন্ম হয়। যে আবহ পাঠককে দেয় সাধারণ গল্পের এক অসাধারণ শৈলী আস্বাদের সুযোগ। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গল্প বলা শুরু করে পাঠকের অজান্তে গল্পের স্রোতটাকে পরিণত করেন খরস্রোতা প্রবাহিনীর মতো। আর আমার মনে হয়, যে লেখক মানুষের যতটা কাছাকাছি, সেই লেখকের লেখনি ততই শক্তিশালী।
রাজনীতিকে ছাপিয়ে প্রেমের গল্প ‘কালবেলা’ সমরেশ মজুমদারের মোহিনী পড়ার সৌভাগ্য কি সবার হয়েছে! অনেকের হয়তো ভালো লাগেনি, তাইতো! কালবেলাকে মোহিনীর সাথে তুলনা করবো না, তবে আবিষ্কারের নেশায় কালবেলা তেমনি এক উপন্যাস। গভীর রাজনীতির মাঝেও প্রেম খুঁজে পাওয়া, মোহিনীতে মোহে এক মানুষ নারীকে, প্রাণবন্ত সে নারী। আসলে খুঁজতে হয়েছে, রাজনীতি পছন্দের নয় কীনা।
উপন্যাসের চরিত্রে ঢুকে মফস্বলের ছেলে অনিমেষ মিত্র। জলপাইগুঁড়ি থেকে কলকাতা আসে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কলকাতায় পা রাখতে বিপদের মুখে পড়ে। কলকাতায় তখন কারফিউ চলছে। পুলিশ তাকে সন্দেহ করে গুলি ছোড়ে। থাইয়ের নিচে হাঁটুর ওপরের অংশে গুলি লেগে হাসপাতালে পড়ে থাকে তিনমাস। সুস্থ হতে হতে একটা শিক্ষাবছর নষ্ট হয়ে যায় অনিমেষের। রাজনীতি সম্পর্কে বুঝ হবার পর থেকেই সে বামপন্থী মনোভাব ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে জড়িয়ে পরে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। পুলিশের গুলিতে হওয়া ক্ষতচিহ্নটাকে ‘সাধারণ মানুষের উপর পুলিশি নির্যাতনের’ চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্র ইউনিয়নে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।
কিন্তু সে যেই আদর্শ নিয়ে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়, কিছুদিন পরে বুঝতে পারে, সবই ফাঁকি। সবাই ক্ষমতার গদিটাকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আদর্শের দোহাই দেয়। ধীরেধীরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তার সহপাঠিনী মাধবিলতার সাথে। মাধবিলতার ভাষ্য মতে, লতার মতো অনিমেষের জীবনে জড়িয়ে পড়ে মাধবিলতা। অনিমেষ চায় সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। কিন্তু এ পরিবর্তন কিভাবে আসবে! রাজনীতি করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় সেটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল অনিমেষ। যার হাত ধরে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছিল, সেই সুভাসদাকে যখন পার্টি থেকে বের করে দেয়া হলো তখন সুভাসদার পথ অনুসরণ করে বিপ্লবী হলো অনিমেষ। আর মাধবিলতা?
নিজের ব্যক্তিগত মতামত লিখতে বেশ খই হারিয়ে ফেলবো এটি কিঞ্চিৎ নিশ্চিত! বিশাল সাইজের চিত্রপট নিয়ে দ্বিতীয় এটি, এত বড় সিরিজ লিখতে গেলেই লেখকের ব্যক্তিসত্তা এমনিতে উঠে আসে। সমরেশের ব্যক্তিজীবনে উনি অবশ্য কিঞ্চিৎ অস্বীকার করেছিলেন। সে করুক, সমরেশ মজুমদার যে অনিমেষের মাঝে আপন সত্তার বীজ বপন করে কালবেলা লিখেছিলেন তা অস্বীকার করার উপায় এই। বইটি জুড়ে তিনি দেখিয়েছেন সেই অপরাজনীতির অবক্ষয়ের চিত্র, রক্তপাত আর হানাহানি। সেই রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে এই জনপ্রিয় লেখক মুদ্রার অন্য পিঠের কোনো চিত্রের শিক্ষা দেখাতে পারেননি। বাতলে দিতে পারেননি কেন ঘটলো। রাজনীতিকে ছাপিয়ে প্রেমের গল্প `কালবেলা` নামটি মনের গহীনে উঁকি দিচ্ছিলো।
এখানে রেখেছেন দারুণ সব বার্তা। বলা চলে প্রেমের বার্তা। নারী ও ভালোবাসার সংগ্রামের বার্তা। চরম বাস্তববাদী রাজনীতির সাথে সাথে প্রেম পছন্দ করেন না এমন পাঠকের উপন্যাস নয় `কালবেলা`। তবে একটা মেয়ে ভালবাসার দায়বদ্ধতাকে ছাপিয়ে কীভাবে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারে, সেটার জীবন্ত উদাহরণ মাধবীলতা। লেখক হয়তো অনিমেষকে নেতা নয়, বরং বিদ্রোহীই রাখতে চেয়েছিলেন বলে মাধবীলতাকে গণ্ডীতে আবদ্ধ রেখেছিলেন। সাহিত্যপ্রেমী মানুষ যারা, তাদেরকে সমরেশ মজুমদারে বাঙলা ভাষায় লিখিত একটি অনন্য সাহিত্যসৃষ্টি পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।