রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘নাট্যজগতের দিকপাল উৎপল দত্ত’
পর্ব ২
প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০২৫
যাত্রা নিয়েও কাজ করেছিলেন উৎপল দত্ত। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে যাত্রার চেহারা পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ইতিহাসের বিষয়বস্তু ও ব্যক্তিদের নিয়ে যাত্রা রচনা ও মঞ্চস্থ করেন। বিপুল সাড়া ফেলেছিল সেসব যাত্রা। বিভিন্ন যাত্রাদল তাঁকে ডেকে নিয়ে যেত নির্দেশনা দেবার জন্য। মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতে তিনি ছিলেন সম্মানিত ও আলোচিত অভিনেতা।
বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তিনি প্রবাদ পুরুষের মতন অনেক চরিত্রে মূল ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ ও মৃণাল সেনের ‘ভূবন সোম’ এ তার অভিনয় যারা দেখেছে, উৎপল দত্তকে কি ভুলতে পারবে? সত্যজিৎ রায়ের শেষের দিকের দুটি আলোচিত চলচ্চিত্রে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন, যা এখনো বাংলার মানুষকে ভাবায়।
‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে তার বলা সংলাপ এখনো উচ্চারিত হয়। উৎপল দত্তের জীবনের শেষ দিকের আগন্তুক সবাইকে বিস্মিত করে। গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্ধা নদীর মাঝি’র উৎপল দত্ত অভিনীত হোসেন চরিত্রটি কি ভুলতে পারা যাবে? তিনি তবুও কখনোই উন্নাসিক ছিলেন না। যা তার তুলনায় বহু ক্ষুদ্র মানুষের মধ্যে দেখা যেত।
শেক্সপিয়ারিয়ানা থিয়েটারে অভিনয় করেও পরবর্তী জীবনে কদাচিৎ বৃহৎ ভারতের কথা বিবেচনায় রেখে ইংরেজি ভাষায় তিনি সামান্য দু’তিনটা প্রবন্ধ লিখেছেন। বাকি সব লেখাই বাংলায়। নাট্যাভিনয় ও নাট্যামঞ্চায়ন নিয়ে বাংলা ভাষায় তো বটেই অন্য ভাষায় এত চিন্তাশীল ও সাবলীল লেখা খুবই কম। রাজনীতি বা নাট্য ইতিহাস নিয়ে তার লেখাগুলি যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি উত্তীর্ণ ও সহজবোধ্য।
তিনি এশিয়ার বিদগ্ধজনদের মধ্যেই খুব বেশি আলোচিত হতেন যদি বাংলা ভাষায় না লিখে তার নাটক, প্রবন্ধ বা গবেষণাগুলো ইংরেজি ভাষায় লিখতেন। কিন্তু নিজের ভাষাভাষী মানুষকে বঞ্চিত করে তিনি কখনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রশংসা কুড়াতে চাননি। তবুও তিনি ইউরোপের নাট্যজগতে খুবই পরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন। বিশেষ করে শেক্সপিয়ার সম্পর্কে তার রচিত গ্রন্থ ও শেক্সপিয়ার সম্পর্কিত পাণ্ডিত্যের জন্য। তিনি তার রচিত ও নির্দেশিত নাটক ইউরোপের বহু দেশে আমন্ত্রিত হয়ে মঞ্চায়ন করে এসেছেন।
বাংলাদেশের নাট্যজগতের যারা খুব ফলাও করে নিজেকে প্রচার করতে চান, তাঁদের উৎপল দত্তের দিকে ফিরে তাকালে ভালো হয়। কিংবা যারা না বুঝেই বাংলাদেশের নাট্যজগতের অনেককে পূজা দিচ্ছেন, তাঁদেরও দরকার উৎপল দত্ত সম্পর্কে গভীরভাবে জানা। না হলে অকারণে অনেক অযোগ্য ও স্বার্থপর চালবাজ মানুষজনকে পূজা দেওয়া হয়ে যেতে পারে।
উৎপল দত্ত কত বড় শিল্পী, নাট্যকার তারচেয়ে তার বড় পরিচয় তিনি বৃহত্তর মানুষের প্রতিটি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেসের পত্রিকা যখন তার নাটককে আক্রমণ করেছে, নাটকগুলোর বিরূপ সমালোচনা করেছে, জনগণ তখন তাঁকে গ্রহণ করেছেন। তিনি নাটক করেছেন জনগণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত থেকে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়।
তিনি রাতের পর রাত বস্তিতে গিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষের কাছে শিখবার জন্য, তাঁদের সংগ্রামের ভাষা বুঝবার জন্য, তাঁদের সংগ্রামের পাশে দাঁড়াবার জন্য। মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের মানুষরা দেখতেন, উৎপল দত্ত নামের এক অভিনেতা নিজের শটটি সূচারুরূপে দেয়ার পর এক কোণে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন। উৎপল দত্তের বাড়িতে বিরাট একটি গ্রন্থাগার ছিল, এখন আর তা আছে কিনা জানি না।
কত রকম বই যে সেখানে ছিল। বলতে গেলে তার বেশির ভাগ ইংরেজি ভাষার বই। অথচ তিনি নিজে লিখেছেন বাংলায়। বাংলাদেশের কাউকে কাউকে দেখেছি, বাংলা ভাষায় লিখতে লজ্জা পান। ইংরেজি ভাষায় লিখতে গর্ববোধ করেন। যদি সে লেখার মধ্যে সারবত্তা কিছু থাকতো, তাহলে না হয় ভিন্ন কথা ছিল। বাংলাদেশের এক পণ্ডিতকে আমি আমার বাংলায় লেখা নাটক পড়তে দিয়েছিলাম। তিনি সব মন্তব্য করলেন ইংরেজিতে। না হলে আমি কী করে বুঝতাম, তিনি ইংরেজী জানেন?
বাংলাদেশের নাট্যজগতে এমন সব লোকদের নিয়ে মাতামাতি করা হয় যাদের নাটক সম্পর্কে পরিণত বোধটাই নেই। কত অযোগ্যরা যে এখানে বড় বড় সম্মান পায়! রাষ্ট্রপতি উইলসন একবার বলেছিলেন, ‘কত অযোগ্যরা জনগণকে নেতৃত্ব দেয় সেটা যদি সাধারণ মানুষরা ঠিকমতো বুঝতে পারত, তাহলে পৃথিবীতে প্রতিদিন একটা করে বিপ্লব হতো।’ বাংলাদেশের নাট্যজগতের বহু সম্মানিত মানুষের জ্ঞানগম্যি ও মানসিকতা বুঝবার জন্য সাধারণ ঘটনার কথা বলতেই হয়।
সেবার ১৯৯৫ সালে বাংলা নাটক মঞ্চায়নের দুশো বছরপূর্তি ছিল। সেই উপলক্ষে বাংলাদেশের দুটো নাট্যদল তাদের দলের দুটো রচনায় বাংলা নাটকের দুশো বছরের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলির উল্লেখ করেন। সেখানে দুই-চার পৃষ্ঠায় লেখা সেই কালপঞ্জীতে অনেক ঘটনার সঙ্গে তাদের নিজেদের দলের বহু কাজ ও প্রযোজনাগুলির কথা সবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে নিজেদের দলের কাজগুলোকে দুশো বছরের বাংলা নাটকের ইতিহাসে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের অংশ বিবেচনা করেছে। কিন্তু সেই দুশো বছরের কালপঞ্জীতে সেখানে উৎপল দত্তের নাম গন্ধ বা তার প্রযোজনার কিছুই উল্লেখ ছিল না।
মানে তাদের রচিত কালপঞ্জী পড়লে মনে হবে, উৎপল দত্ত নামে সেই দুশো বছরের মধ্যে বাংলা নাট্যাঙ্গনে যেন কেউই জন্মায়নি। কিন্তু যারা কালপঞ্জী রচনা করেছে তাদের দল বাংলা নাটকে যেন অনেক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলা নাটকে যেন তারাই একটা যুগ সৃষ্টি করেছে। বাংলা নাটকে আসলে তারা কী অবদান রেখেছে সেটা যেন উৎপল দত্তের চেয়ে অনেক গুণ বেশি আলোচিত, আর সেকারণেই উৎপল দত্তের বা তার দলের কথা তাদের কালপঞ্জীতে স্থান হয়নি। এটা এখানকার নাট্যজগতের অনেকের মানসিক ও নিজেদের আত্মতুষ্টির পরিচয়।
নিজেরা কী করেছে সেইটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার জন্য তারা অস্থির। হাস্যকর নয় কি এইসব কর্মকাণ্ড? দুটো দলের নাম উল্লেখ করতে চাই না, একটি দলের প্রধান তো বহু আগেই দুর্নীতিবাজ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। ভিন্ন দলটি বাহাত্তর-তিয়াত্তর সাল থেকেই নাটক করছে, কমবেশি প্রশংসাও পেয়েছে। এই ঘটনার ভিতর দিয়ে তাদের বাংলা নাটকের দুশো বছরের ইতিহাস বা কালপঞ্জী লেখার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ও ইতিহাস বিকৃতির উদাহরণ দুটোই পাওয়া গেল। কিন্তু এরা দ্রুত হারিয়ে যাবে, উৎপল দত্ত আরো বহু বছর আলোচনায় থেকে যাবে।
খুব জোরে সরে একটা কথা উৎপল দত্ত বলতেন, ব্রেখটও বলতেন, নাটককে নিয়ে যেতে হবে বৃহত্তর জনগণের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানে একই বক্তব্য, নাটকের ক্ষুদ্র আঙ্গিনা থেকে আরো বৃহৎ আঙ্গিনায় ছড়িয়ে পড়তে হবে। চীনের গণনাট্য কিংবা ভারতীয় গণনাট্য একই রকম শ্লোগান তুলেছিল। নাটককে বহু মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বাংলার নাটক তার শুরুতে মঞ্চস্থ হতো জমিদারদের বা ধনীদের আঙ্গিনার মধ্যে, সেটা ছিল তাদের সখের নাট্যচর্চা।
গিরিশ ঘোষরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখান থেকে আরো বড় আঙ্গিনায় নাটক নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে নাট্যচর্চা এমনকি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে চাইলো সেই বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের গণনাট্য আন্দোলনের যুগে। বাংলাদেশে যখন নাট্য আন্দোলন শুরু হয় একই কথা বলা হয়েছিল, ড্রইংরুম থিয়েটার চাই না। ধনীর বিলাসিতার থিয়েটার, বাগান বাড়ির থিয়েটার এর বিরুদ্ধে যখন নাট্যচর্চা আন্দোলন করতে করতে বৃহত্তর আঙ্গিনায় ছড়িয়ে পড়তে চাইছে, বাংলাদেশে তখন কদিন আগেই দেখা গেল ধনীর ড্রইংরুমে থিয়েটারকে বিক্রি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কেউ কেউ।
কারা সেই জমিদার বাড়ির ব্যক্তিগত সখের বাঈজী নাচের মতন, নাট্য মঞ্চায়নকে ধনীর বিলাসিতার সামগ্রিতে পরিণত করতে চেয়েছিল? উৎপল দত্ত বলতেন, সাধারণ মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে, প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে সংগ্রামী ঐক্য বজায় না রাখলে, এই রকম সস্তা খেয়াল মাথায় আসবেই। জনগণের সঙ্গে মিলেমিশে সংগ্রাম না করলে নাট্যচর্চার এসব ভূত মাথা থেকে সরানো যাবে না। সামান্য সুযোগ সুবিধার জন্য নিজেকে ব্যক্তির কাছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করতে সদা তৎপর থাকবে শিল্পীরা, নানা সস্তা প্রগতিশীল শ্লোগান তুলেই এসব করবে।
যদিও সাধারণের কাছে শেষ পর্যন্ত এই সব সস্তা ধ্যানধারণা পাত্তা পাবে না। এই সব ঘটনার ভিতর দিয়েই প্রমাণ হবে কে জনগণের বন্ধু। কারা জনগণের শিল্পচর্চা করছে। কারা আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নাট্যচর্চার নামে ফায়দা তুলছে। কারা শাসক শোষকদের পদলেহনে ব্যস্ত। বাংলাদেশ ব্যক্তিপূজার দেশ। রাজনীতিতে যেমন নাট্যজগতেও তাই। সর্বক্ষেত্রে ব্যক্তিপূজা চলে। লুটপাট করলেই এদেশে সম্মান। নাটক না লিখেও বাংলা একাডেমি থেকে নাটকের জন্য পুরস্কার পাওয়া যায়।
ফোকলোর নিয়ে গবেষণা না করেও, সেই ক্ষেত্রে পুরস্কার জুটে যায়। নাম বিক্রি হয় এখানে, কর্মের মূল্য কম। বাংলাদেশ থেকে বা বিশ্ব থেকে বাংলা ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল কবে? কদিন আগে দেখলাম, বাংলা ভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন এবং বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশে একজনকে মাতৃভাষা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিনি আবার খুব উৎসাহে গ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করে অনেকে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছে এই দেশে। সত্যি সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ! এখানে চোরকে চোর বললে, লুটাপাটকারীকে লুটপাটকারী বললে বহু সভ্য লোকে গোসসা করেন।
মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়ে কিংবা ভোটচুরি করে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হওয়া সম্ভব এই দেশেই। বিরাট নাট্যব্যক্তিত্ব, তথাকথিত বিরাট সাংস্কৃতিক বিদগ্ধজনরা একজনের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার লুটপাটের খবর জেনেও তার পক্ষ নিতে পারে। জনগণের সম্পদ যে লুট হয়ে গেছে এ নিয়ে যেন প্রতিবাদ করতে নেই। সেইসব ব্যাপারে প্রতিবাদ করাটা তাদের বিচারে যেন একান্তই দোষের। মানুষকে হত্যা করাও জায়েজ তাদের বিচারে। মানুষকে হত্যার পক্ষে থেকে নিজেদের প্রমাণ করতে চান সাংস্কৃতিক জগতের শুদ্ধ মানুষ। বহু জন তেমন কিছু না করেই নাট্যজগতে খুব শ্রদ্ধাভাজন।
যার লেখা একটা ভালো নাটক নেই, একটা ভালো একক নির্দেশনা নেই, নির্দেশনার নামে আছে চাকচিক্য ও বাহুল্যরকম লম্ফঝম্প যা আদতে কোনো অর্থ বহন করে না, এদের জন্যই কি এই সমাজের সকল সম্মান!
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক























