শামসুর রাহমানের ৭ কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২০

কবি শামসুর রাহমানের আজ ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেষ ইচ্ছানুযায়ী বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত চারটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো

জো, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমারই মতো
একজন কালো মানুষ গলার সবচেয়ে
উঁচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান, যে গানে
তোমার দিলখোলা সুরও লাগছে।

জো, যখন ওরা তোমার চামড়ায় জ্বালা-ধরানো
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হো হো করে হেসে ওঠে,
যখন ওরা বুটজুতোমোড়া পায়ে মারে তোমাকে,
তখন ধূলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
জো, যখন ওরা তোমাকে
হাত পা বেঁধে নির্জন রাস্তায় গার্বেজ ক্যানের পাশে
ফেলে রাখে, তখন ক্ষ্যাপাটে অন্ধকারে
ভবিষ্যৎ কাতরাতে থাকে
গা` ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্যে।
যদিও আমি তোমাকে কখনো দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালো অক্ষরের মতো তোমার দুফোঁটা চোখ
তোমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে, তোমার বেদনা
এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপ্ত, জো।

ট্রেন

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
          রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
         ট্রেনের বাড়ি কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
         মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
         ঝন ঝনাঝন ঝন।

দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
         নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
         দিন কেটে যায় বেশ।

থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
        একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
        ঝক ঝকাঝক ঝক।

উত্তর

তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোত্স্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।

মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।

তুমি বলেছিলে

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু`জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
‌`আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।`

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।

বারবার ফিরে আসে

বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।

‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ’রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।

আমার মৃত্যুর পরেও যদি

একটি পাখী রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।

পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনো তাঁর ঠোটে হয়তো গচ্ছিত।

কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো সেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।

যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।

আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।

সুধাংশু যাবে না

পাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা।
জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায়
সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা
কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা।
আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
সেই একপাল বন্ধুগুলো ­ রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে
প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশু
আড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্ক ­-
এই বাস্তুভিটার সাথে আর একঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা।
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
কোথায় সেই কল-কাকলীতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালী-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশু
দু’টি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালী ভিটায়।
কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলা
ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা।
তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশু
তোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ঐ ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’
কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবে, কোথায় চকলেটগুলা?
তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা।
আরও জানি বন্ধু সুধাংশু
তোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে নাঃ আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন?
চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা।
তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা।
তোকে যে বলা হয় নি বন্ধু সুধাংশু
মিলা’র সহপাঠী আমার ভাইটি ‘রিপন’ বলছিল সেদিনঃ ভাইয়া মিলা’টা যা সুন্দর হয়েছে না!
বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে, তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না।
তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা।
মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশু
অসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবন ­
হবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা।
তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা।