সুকান্ত ভট্টাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০২০

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের আজ ৯৪তম জন্মদিন। প্রগতিশীল এ কবি ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার কালীঘাটের মহিমা হালদার স্ট্রিটে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত একগুচ্ছ কবিতা পুনর্মুদ্রন করা হলো:

আজব লড়াই

ফেব্রুয়ারি মাসে ভাই, কলকাতা শহরে
ঘটল ঘটনা এক, লম্বা সে বহরে!
লড়াই লড়াই খেলা শুরু হল আমাদের,
কেউ রইল না ঘরে রামাদের শ্যামাদের;
রাস্তার কোণে কোণে জড়ো হল সকলে,
তফাৎ রইল নাকো আসলে ও নকলে,
শুধু শুনি ‘ধর’ ‘ধর’ ‘মার’ ‘মার’ শব্দ
যেন খাঁটি যুদ্ধ এ মিলিটারি জব্দ।
বড়রা কাঁদুনে গ্যাসে কাঁদে, চোখ ছল ছল
হাসে ছিঁচকাঁদুনেরা বলে, ‘সব ঢাল জল’।
ঐ বুঝি ওরা সব সঙ্গীন উঁচোলো,
ভয় নেই, যত হোক বেয়নেট ছুঁচোলো,
ইট-পাটকেল দেখি রাখে এরা তৈরি,
এইবার যাবে কোথা বাছাধন বৈরী!
ভাবো বুঝি ছোট ছেলে, একেবারে বাচ্চা!
এদের হাতেই পাবে শিক্ষাটা আচ্ছা;
ঢিল খাও, তাড়া খাও, পেট ভরে কলা খাও,
গালাগালি খাও আর খাও কানমলা খাও।
জালে ঢাকা গাড়ি চড়ে বীরত্ব কি যে এর
বুঝবে কে, হরদম সামলায় নিজেদের।
বার্মা-পালানো সব বীর এরা বঙ্গে
যুদ্ধ করছে ছোট ছেলেদের সঙ্গে;
ঢিলের ভয়েতে ওরা চালায় মেশিনগান,
“বিশ্ববিজয়ী” তাই রাখে জান, বাঁচে মান।
খালি হাত ছেলেদের তেড়ে গিয়ে করে খুন;
সাবাস! সাবাস! ওরা খেয়েছে রাজার নুন।

ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা,
রক্ত-রাঙানো পথে দু’পাশে ছেলের মেলা;
দুর্দম খেলা চলে, নিষেধে কে কান দেয়?
ও-বাড়ি ও ও-পাড়ার কালো, ছোটু প্রাণ দেয়।
স্বচে দেখলাম বস্তির আলী জান,
‘আংরেজ চলা যাও’ বলে ভাই দিল প্রাণ।

এমন বিরাট খেলা শেষ হল চটপট
বড়দের বোকামিতে আজো প্রাণ ছটফট;
এইবারে আমি ভাই হেরে গেছি খেলাতে,
ফিরে গেছি দাদাদের বকুনির ঠেলাতে;
পরের বারেতে ভাই শুনব না কারো মানা,
দেবই, দেবই আমি নিজের জীবনখানা।

আগ্নেয়গিরি

কখনো হঠাৎ মনে হয়,
আমি এক আগ্নেয় পাহাড়।
শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো
চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা।
এক বিস্ফোরণ থেকে আর এক বিস্ফোরণের মাঝখানে
আমাকে তোমরা বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছ বারংবার
আমি পাথর, আমি তা সহ্য করেছি।

মুখে আমার মৃদু হাসি,
বুকে আমার পুঞ্জীভূত ফুটন্ত লাভা।
সিংহের মতো আধ-বোজা চোখে আমি কেবলি দেখছি,
মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমাদের শহর,
আমাকে ঘিরে রচিত উৎসবের নির্বোধ অমরাবতী,
বিদ্রূপের হাসি আর বিদ্বেষের আতসবাজি
তোমাদের নগরে মদমত্ত পূর্ণিমা।

দেখ, দেখ
ছায়াঘন, অরণ্য-নিবিড় আমাকে দেখ;
দেখ আমার নিরুদ্বিগ্ন বন্যতা।
তোমাদের শহর আমাকে বিদ্রূপ করুক,
কুঠারে কুঠারে আমার ধৈর্যকে করুক আহত,
কিছুতেই বিশ্বাস করো না
আমি ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর।
তোমাদের কাছে অজ্ঞাত থাক
ভেতরে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠা আমার অগ্ন্যুদ্‌গার,
অরণ্যে ঢাকা অন্তর্নিহিত উত্তাপের জ্বালা।

তোমার আকাশে ফ্যাকাশে প্রেত আলো,
বুনো পাহাড়ে মৃদু-ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন:
ও কিছু নয়, হয়তো নতুন এক মেঘদূত।
উৎসব কর, উৎসব কর–
ভুলে যাও পেছনে আছে এক আগ্নেয় পাহাড়,
ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার জাগ্রত বংশধর।
আর,
আমার দিন-পি কায় আসন্ন হোক
বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি।

আগামী

জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;
মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।
যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে
তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে,
বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা
শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।
আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা
উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা;
তার পর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে,
ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে।

সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়;
শাখায় শাখায় বাঁধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়;
অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে
জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে।
আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে;
জয়ধ্বনি কিশলয়ে; সম্বর্ধনা জানাবে সকলে।
ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি,
বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি।
সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে
তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে;
ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন
একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।

নিভৃত

বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো
আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়,
সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো,
শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়।

নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে
যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব।
নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে,
অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ?
জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা
কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী,
আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা
মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি।