হুমায়ুন আজাদ: শীর্ণ প্রতিভার কথা
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০২০
হুমায়ুন আজাদকে যারা কম পড়েছেন বা একমাত্র তাকেই অধিক পড়েছেন, এমন পাঠকরাই মূলত হুমায়ুন আজাদের ভক্ত। যারা শুধু তার সাক্ষাৎকার পড়েছেন, অথবা ‘আমার অবিশ্বাস’ বা ‘নারী’কে মাথায় রাইখা প্রগতিশীলতার তৃপ্তির ঢেঁকুর যারা তুলেছেন, তারা তার ফ্যান। হুমায়ুন আজাদের জিহ্বায় জোর ছিল, আর তার তীর্যক বাক্য রচনা ও শ্লেষ করবার শক্তি অনেককে মুগ্ধ করত। ‘বাপের ব্যাটা একখান, দেখছ কয় কি’ টাইপের।
হুমায়ুন আজাদের ইতিহাস জ্ঞান ও দর্শন জ্ঞান এ কালের তেইশ ঊর্ধ্ব যুবকের সমান। ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তার জ্ঞান মাদ্রাসার প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ুয়া ছাত্রের চেয়েও কম। চমস্কি নিয়া তার যে ‘চমস্কীয় বিপ্লব’ প্রবন্ধ, ওটা আজকালকার প্রাথমিক লিংগুইস্টিক জানা পোলাপানদের কাছে বালখিল্য রচনা মনে হইব। তার সুবিদিত কুম্ভিলকবৃত্তির কথা নাইবা কইলাম! সবচেয়ে বিরক্ত হইছি তার ‘অর্থবিজ্ঞান’ বইটি পইড়া। এ নিয়ে একটা ইংরেজি বইও যে পড়ছে, হুমায়ুন আজাদের ওপর সে মহাবিরক্ত হইবো।
বাঙলা ভাষা নামক দুই খণ্ডে সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলনটা কাজের, এই অর্থে যে, ধারাবাহিকভাবে বাংলাভাষা চিন্তার একটা সহজ মানচিত্র এতে পাওয়া যায়। তবে, তিনি ভাষা চিন্তায় সুনীতি কুমারের অনুসারী, তার মতোই উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তার সামগ্রিক মূল্যায়নেও তিনি ব্যর্থ। ভাষাবিজ্ঞানে ছাত্রপাঠ্য পরিচিতিমূলক রচনায় তার সফলতা। পূর্ব বাংলার ভাষা ও উচ্চারণ পদ্ধতি ও বিশিষ্টতা নিয়েও তার জরুরি অবলোকন নাই।
‘বাংলা আধুনিক কবিতা’ নামক সংকলন তিনি করছিলেন নিজের নামটা ঢুকানোর জন্যে। বুদ্ধদেব বসুর আমলে হু. আজাদ থাকলে আর তার কবিতা সেখানে ছাপা হইলে ‘বাংলা আধুনিক কবিতা’ নামক এই সংকলন বাইর হইতো না। আর, এক্সট্রা পোয়েটিক মানদণ্ডে বিচার করে কিছু কবিকে বাদ দিয়া তিনি তার জাত চিনিয়েছেন। আধুনিকতার একনিষ্ঠ পূজারি তিনি। আধুনিকতাকে প্রশ্ন ও পর্যালোচনা করার যুগে আধুনিকতার কাছেই তিনি সানুনয় নতজানু থেকেছেন।
সাহিত্য চিন্তায় পাশ্চাত্যের ক্ষয়ে যাওয়া আধুনিকতাকেই তিনি তার স্বদেশ ভেবেছেন। তবে কবিতা বিশ্লেষণে তার কৃতিত্ব অন্য অনেকের চেয়েই বেশি। কাব্যালোচনাকে তিনি কাব্য-পাঠের সমতুল্য করে ফেলতে পারতেন। বুদ্ধদেব বসুর অনুসারী তিনি। তবে, বুদ্ধদেব যেমন খুলে খুলে বোঝাতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ দাশ বা রবি ঠাকুরের নানানুখি শক্তি, তেমন তিনি কাউকে নিয়ে মূল্যবান আলোচনা করতে পারেননি। শামসুর রাহমানকে নিয়ে তার রচনা যতটা পরিশ্রমের সাক্ষ্য দেয়, ততটা তার মননের নয়।
তার নিজের কিছু ভালো কবিতা আছে, আর আছে কিছু কিশোরপাঠ্য অনবদ্য রচনা। বিদেশে পড়েছেন ও আধুনিক সাহিত্যের ভক্ত বলে হোসে আর্তেগা গাসেত-এর নাম শুনেছেন, ও তার রচনা অনুসারে লিখেছেন ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’। গাসেত কিন্ত Dehumanisation of art লিখছিলেন ১৯২৫ সালে আর এন্তেকাল করেছিলেন ১৯৫৫ তে। মানে, গাসেতের অন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ রচনা আজাদ হয় হজম করতে পারেননি বা আগ্রহী হন নাই, বা খোঁজ পান নাই। হুমায়ুন আজাদের গদ্যের প্রশংসা করেন অনেকেই। ঠিক আছে। তবে তার গদ্য বুদ্ধদেব বসুর গদ্যেরই স্মার্ট সংস্করণ। তার গদ্য তার ভাবের দৈন্যকে লুকাতে পারে না।
তিনি ‘মহাবিশ্ব’ নামক বইটি লিখেছেন বলে প্রগতিপাড়ায় তিনি বিজ্ঞানীর চেয়ে কম কিছু নন! যাই হোক, হুমায়ুন আজাদ হয়তো বেঁচে থাকবেন তার ছাত্রপাঠ্য রচনায় (ভাষা বিজ্ঞানের কিছু পাঠ্য বইয়ে), কিছু কবিতায়, কিশোর-সমগ্রের গদ্য ও কল্পনা বিভায় এবং বিসিএস পরীক্ষার্থীদের লাল-নীল, নদী-সরোবরে! দার্শনিক-ঐতিহাসিক অন্তর্দৃষ্টি না থাকায় তিনি তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন এ-কালে। কতিপয় স্বল্পপাঠ বাংলা বইয়ের পাঠকের কাছে তিনি হয়তো আরো কিছুকাল পূজনীয় থাকবেন। আর তিনি বেঁচে থাকবেন নাস্তিক্য আর বিবর্তনবাদকেই প্রগতিশীলতার চূড়া-ভাবা কথিত জ্ঞানবানদের মধ্যে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক
























