সন্ত জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালে

সন্ত জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালে

অপারেশন ব্লুস্টার: জার্নাল সিংয়ের উত্থান

পর্ব ২

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : জুন ১০, ২০২০

সন্ত জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালে এবং অমৃতসরের শিখ গণহত্যা ১৯৮৪ সালের নীলনকশা (যা অপারেশন ব্লুস্টার নামে পরিচিত) খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অপারেশন ব্লুস্টার কিভাবে একজন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাকে টার্গেট করে শেষে একটি এথনিক ক্লিনজিংয়ের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক খেলায় পরিণত হয়, সেটির কারণ খুঁজে বের করতে হলে জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালের উত্থান জানা জরুরি। আশির দশকে কিভাবে পাঞ্জাব সম্পূর্ণ একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ খালিস্তান মুভমেন্টের (যা ১৯৪৭ সালের গোড়ায় শুরু হয় এবং আবার ৭০ পরবর্তী সময়ে ফিরে আসে) শক্ত গোড়াপত্তনে সশস্ত্র  ভূমিকা রাখে, তার বিশ্লেষণ হবে এই পর্বে।

ভারতের ভূখণ্ডে শিখদের আদি-ইতিহাস এবং এই ধর্মের শুরু থেকেই নানা রকম বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাস কম রক্তক্ষয়ী নয়। তাদের সঙ্গে মুঘলদের যে অবারিত যুদ্ধ ইতিহাসে লেখা রয়েছে, তাতে শিখদের সাহসী মনোবল আর বীরত্ব প্রশংসনীয়। তাদের অনেক গুরুই নিজ ও পরিবারের শহিদি ত্যাগের মধ্যে দিয়ে মাথা নত না করা স্পষ্টভাবে শিখিয়ে গেছেন। বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই তারা মিত্র বাহিনীর হয়েও অসংখ্য যুদ্ধে অবদান রেখেছে। শিখদের যুদ্ধ দক্ষতা অন্যদের, বিশেষ করে দমন-পীড়নকারী শাসকের চিন্তার কারণ হবার যথেষ্ট কারণ রাখে।

জার্নাল সিং তরুণ বয়স থেকে শিখদের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দমদমি টাকশালে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ভিন্নধর্মী চরিত্রের প্রকাশ পেতে শুরু করলে তৎকালীন টাকশাল প্রধান কারতার সিংয়ের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন জার্নাল সিং। মাত্র ৩১ বছর বয়সে অমৃতসর থেকে ২৫ মাইল দূরত্বের দমদমি টাকশালের প্রধান জাথেদার (সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা) নির্বাচিত হন জার্নাল সিং। কংগ্রেসের ভূমিকা এরপর শুরু হয়, জার্নাল সিংয়ের গুণমুগ্ধ কংগ্রেস তখন তাদের পাঞ্জাবের বিরোধী দল ‘আকালি ডাল’ এর বিরুদ্ধে জার্নাল সিংকে আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে নিজেদের ভোট-ব্যাংক ভারি করতে শুরু করে।

জার্নাল সিংয়ের প্রিয় প্রার্থীদের ‘ডাল খালসা’ থেকে ভোটে দাঁড় করাতে কংগ্রেস কোনো কমতি রাখেনি। ১৯৮০ সালের ভোটে একক পরাক্রমশালী জার্নাল সিং কংগ্রেসকে সরাসরি সমর্থন দিতে শুরু করেন। জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালে এরপর আর কারো ছত্রছায়ার পুতুল নন, তখন তিনি একাই পাঞ্জাবের অধিক শক্তিশালী নাম, বিভিন্ন সভা সমাবেশে তিনি প্রধান প্রভাবশালী বক্তা, পুরো পাঞ্জাব তাকে সমীহ করতে শুরু করেছে। এক সাধারণ কৃষক খালসা ছাত্র থেকে তিনি দমদমি টাকশাল প্রধান, এবং পুরো পাঞ্জাবের এক অনন্য রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়ে উঠলেন দ্রুত। খেলার মোড় নিতে বেশিদিন সময় লাগেনি, ১৯৮০ সালের শেষভাগে এবং ১৯৮১ সালের পুরোটা সময়জুড়ে, জার্নাল সিং তার একক শক্তির প্রয়োগ শুরু করতে থাকেন, নিরাঙ্কারীদের (তখনকার একটি শিখ ধর্মীয় দলের) সঙ্গে ভিন্ডরাওয়ালের অনুসারীদের শুরু হয় সশস্ত্র বিরোধ এবং তার জের ধরে খুন হয় দলটির প্রধান গুরবচন সিং। এর দায়ে জার্নাল সিংসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
 
জার্নাল সিংয়ের বিরুদ্ধে বাব্বর খালসা (যারা একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র শিখ প্রদেশ গড়তে চাইছিল) গ্রুপের সাথে সখ্য এবং তাদের সাহায্য করার অভিযোগ আসে। অল ইন্ডিয়া শিখ স্টুডেন্ট ফেডারেশন (বাব্বর খালসা গ্রুপের সহযোগী) ব্যান করে সরকার। পাঞ্জাবে বিভিন্ন সহিংসতায় খুন হতে থাকে মানুষ। পাঞ্জাব পুলিশের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় জার্নাল সিংয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করতে গিয়েও সহিংস হামলার মুখোমুখি হয় পুলিশ। যদিও জার্নাল সিং তার সমর্থকদের অনুরোধ করেন শান্ত থাকার। কিন্তু এটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, কংগ্রেসের ওপর থেকে আস্থা হারাতে থাকেন জার্নাল সিং।

তিনি এটিও বুঝতে থাকেন, তার আর কোনো রাজনৈতিক সহযোগিতা দরকার নেই। তার একক ক্ষমতায় তখন পাঞ্জাবের হাওয়াও কোনদিকে বইতে হবে, সেটির দিক-বিবেচনা করছিল জার্নাল সিংয়ের কথায়। ১৯৮২ তে জার্নাল সিং তার শুরুর দিকে বিরোধী দল আকালি ডালের সঙ্গে মিলে ‘ধর্মযুদ্ধ মোর্চা’ শুরু করেন, যা মূলত শিখদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবার কথা বলে। জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালের ব্যাপক লোকপ্রিয়তার কারণে আকালি ডাল তার সঙ্গে মোর্চা খুলে নিজেদের দল ভারি করে। এরপর পাঞ্জাবের ‘ল অ্যান্ড অর্ডার পারতপক্ষে আরো খারাপ হয়। পাঞ্জাবের সিএম ও দরবারা সিংয়ের ওপর হত্যা-চেষ্টায় হামলা করা হয়।

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ২৫০০০ আকালি কর্মী গ্রেফতার হয়। জার্নাল সিং ইন্দিরাকে আহ্বান জানান এদের মুক্ত করতে। ইন্দিরা গান্ধীর এক সময়ের প্রিয় মুখ জার্নাল সিং ধীরে ধীরে তার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে থাকেন। পরিস্থিতি আসলে দিন দিন শোচনীয় পর্যায়ে যাচ্ছিল, যেটির শেষ ইন্দিরা গান্ধী এবং জার্নাল সিংসহ পাঞ্জাবের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তখনো আন্দাজ করতে পারেনি কোনোভাবে। ১৯৮২ তে বিভিন্ন ধরনের সহিংতা আর খুনোখুনিতে আকালি ডাল এবং জার্নাল সিংয়ের বাব্বর খালসা গ্রুপ এই দুই বিরোধী দল একে অন্যকে দোষ দিতে থাকে। এরই মধ্যে জার্নাল সিংকে গোল্ডেন টেম্পল শ্রী হারমান্দির সাহিবে এসে আস্তানা নিতে আমন্ত্রণ জানায় হারচান্দ সিং, প্রেসিডেন্ট শিরোমানি আকালি ডাল। জার্নাল সিং অত্যন্ত খুশি হন এবং সাথে সাথেই এতে সম্মতি জানান। হারচান্দ সিং ও জার্নাল সিংকে সরকারের বিরুদ্ধে অনন্য হাতিয়ার সম্বোধন করেন।

এবার পর্দায় অন্তর্ভুক্ত হয় আরেক বিষফোঁড়া, খালিস্তান। এখন পর্যন্ত চলা এসব রাজনৈতিক ঘটনার উত্থান ও প্রেক্ষাপট কাল কিন্তু খুব বেশি নয়, ১৯৮০-১৯৮২। এই দুই বছরে এত দ্রুত ক্ষমতার অদল বদল, আর সব খেলার শীর্ষ অবস্থানে থাকা গরম রক্তের জার্নাল সিং আদৌ বুঝতে পারেননি তাকে খুব সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতমভাবে ব্যবহার করেছে পাঞ্জাবের প্রায় প্রতিটি শিখ মুভমেন্ট এবং রাজনৈতিক দল। তার লোকপ্রিয়তাকে নিজেদের বিভিন্নভাবে লাভবান করতেই ব্যবহার করা হয়েছে। একইভাবে অনেকের চোখের কাঁটা হয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের দাবার ঘুটি এবার উল্টো চাল দিতে থাকে তাদের বিরুদ্ধেই। ইন্দিরা গান্ধীকে বিভিন্ন ভাষণে ও বক্তৃতায় ‘ইন্দিরা’ বলে সম্বোধন করতে থাকেন জার্নাল সিং।

‘আমি খালিস্তান চাইছি না, কিন্তু ইন্দিরা যদি খালিস্তান (শিখদের স্বতত্র প্রদেশ) দেয় তো আমি মানা করবো না, নিয়ে নেব’— জার্নাল সিং ১৯৮৪ সালে এ এক বক্তব্যে এ কথা জানান। অভিযোগ ওঠে, জার্নাল সিং হিন্দু-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন দরবার সাহিব আকাল তাখত থেকে। গুজব ওঠে খালিস্তান তৈরির সব প্রস্তুতি নিচ্ছে ভিন্ডরাওয়ালের সমর্থকরা। কিন্তু আদতে বিভিন্ন সাংবাদিক এবং সাধু-সন্ন্যাসীসহ বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলের নেতারা সেখানে যান। অধিকাংশই সেখানে কোনো ধরনের খালিস্তান কারখানা দেখতে পাননি। এমনকি আজ এত বছর পরেও কোথাও জার্নাল সিংয়ের রেকর্ডেড কোনও বক্তব্যে হিন্দু-বিদ্বেষ কিংবা হিংসা-উস্কানিমূলক বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যার ফলে এমন সব আরোপ শুধু মাত্রই কংগ্রেসের আরোপ হিসেবে থেকে যায়।

ধরেই নিলাম, পাঞ্জাবের একচ্ছত্র ত্রাস-সৃষ্টিকারী জার্নাল সিং। তিনি এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরও রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকার কেন তাকে কখনো আলাপের মাধ্যমে কিংবা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে উপযুক্ত জ্ঞান দেবার কথা ভাবেনি, সেটি সত্যি অবাক করা বিষয়। বরং দিনের পর দিন পাঞ্জাবে অভিযোগের পাহাড় আর খুনোখুনির অবাধ মাতামাতিতে মনে হয়— সরকার একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো ১৯৮৪ সালের ইলেকশান সামনে রেখে, নাটকের পর নাটকের জাল বিছিয়ে কখন কংগ্রেস নিজেই জড়িয়ে গেছে। সেটি তারা টের পায় একেবারে ইলেকশানের বছর। ব্যাপারটি কাকতালীয় ভাবলে ভুল হবে। এটি শুধুমাত্রই নিজের হাত সাফ করার পায়তারা ছিল কংগ্রেসের।  এরপর শুরু হয় অপারেশন ব্লুস্টারের পরিকল্পনা। চলবে