
সশস্ত্র সঙ্গীদের সঙ্গে সন্ত জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালে
অপারেশন ব্লুস্টার: শিখ হত্যার নীলনকশা
পর্ব ১
রিফাহ সানজিদাপ্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২০
১৯৮৪ সাল , জুন মাস। অমৃতসর, পাঞ্জাব প্রদেশ। পহেলা জুনের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে সম্প্রদায়ের অসংখ্য অনুগত ধর্মপ্রাণ লোক সমাগমে উৎসবমুখর পরিবেশ শ্রী দরবার সাহিব গুরুদুয়ারাতে, যা গোল্ডেন টেম্পল নামে পরিচিত। শিখ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুরুদুয়ারা। হঠাৎ সেখানে কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট এবং পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই দুপুরের দিকে ফিল্মি স্টাইলে ভারতীয় আর্মি নামলো। ট্যাংক-বহর, গোলা বারুদ ও গুলির অজস্র মজুদ নিয়ে আর্মি জায়গাটি ঘিরে ফেলল। এরপর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে পুরো পাঞ্জাব ভারত থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। বাইরে বেরুনো এবং ঢোকা বন্ধ করে দেয়া হলো। গণমাধ্যমকে ব্ল্যাকআউট করে দেয়া হলো।
এরপর? এত আয়োজন করে টানা ছয় থেকে আট দিন সেখানে আর্মির অপারেশন ব্লু-স্টারে পরিকল্পনামতো হত্যা করা হয় প্রায় সাতশো নিরপরাধ মানুষকে। এর মধ্যে তিন বছরের শিশু ও নারীসহ, বৃদ্ধ শিখ এবং অন্য ধর্মের মানুষও ছিল যারা সেদিন গুরু আর্জন দেবের শহিদি দিবস উদযাপনে বিভিন্ন জায়গা থেকে সেখানে হাজির হয়েছিল। এটি ভারত সরকারের নিজ দেশের ভেতর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সেনা-অপারেশন।
গণহত্যা ও রাজনৈতিক সংকট
কেন একটি ধর্মীয় উপাসনালয়ের কেন্দ্র রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের এত ভীতির কারণ হয়ে উঠল? আর সেদিন দরবার সাহিবে কি ঘটেছিল? ভারত সরকারের অফিশিয়াল রিপোর্ট দেখায়, সেদিন ৮৩ সেনা অফিসার এবং ৪৯২ সিভিলিয়ান মারা যায়। কিন্তু সত্যিকারের হিসেবটা বরাবরের মতোই এর চেয়ে বেশি এবং অপারেশন ব্লুস্টার ভারত সরকারের সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ এবং কলঙ্কিত রাজনৈতিক অধ্যায়ের একটি। অনেকটা নীল নকশার মতোই এর নামকরণ করা হয়, অপারেশন ব্লুস্টার। ভারত সরকার এর পক্ষে যতই সাফাই দিক, এর পূর্ববর্তী নকশা উল্টো দিকে মোড় নেয়া, অপারেশনে চলাকালীন জেনোসাইড, মিডিয়া ব্ল্যাক আউট এবং পরবর্তীতে এর জের ধরে ইন্দিরা গান্ধী হত্যা এবং হত্যার পর শিখ-বিরোধী দাঙ্গা, পাঞ্জাবে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ এবং পুলিশ হয়রানি, ফেক এনকাউন্টার, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, পাঞ্জাবিদের ‘পাকিস্তানি মদদের সাথে লিংক’ করে দেয়া (যা এখনো চলমান) সব মিলিয়ে যে জটিল রাজনৈতিক মহল এখন ভারত থেকে আলাদা হয়ে, একটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ভারত সরকারের ১৯৮৪`র অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের ফসল।
জেনোসাইড মানেই সেখানে যুদ্ধাপরাধ সমতুল্য ঘটনা ঘটেছে, নির্বিচারে সিভিলিয়ান হত্যা করেছে আর্মি। দোষী ব্যক্তি থাকলেও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং এর সবটাই সেদিন ১ জুন, ১৯৮৪ তে ভারত সরকার কর্তৃক ভারতের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শিখদের বিরুদ্ধেই ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সেটি ছিল শুরু মাত্র।
কেন অপারেশন ব্লু-স্টার
এই অপারেশন ব্লুস্টারের প্রধান টার্গেট ছিল ৩৭ বছরের এক যুবক, শিখ ধর্মীয় নেতা, তৎকালীন দমদমি টাকশালের প্রধাণ সন্ত জার্নাল সিং ভিন্ডরাওয়ালে। যার ওপর ভারত শাসন-মুক্ত স্বাধীন পাঞ্জাব গড়ার উস্কানি দেয়ার অভিযোগ আনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের দাবি, পাকিস্তান থেকে জার্নাল সিংকে অনেক রকম অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ অর্থ সহযোগিতা সরবরাহ করা হচ্ছে, যা দিয়ে ভারতের ভেতরেই স্বাধীন আরেকটি রাষ্ট্র গড়ে তুলছেন ভিন্ডরাওয়ালে। তিনি ‘খালিস্তান’ গড়ে তুলতে চান এবং পাঞ্জাবের যুবক ছেলেদের এজন্যে মিলিটারি ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। খালিস্তানের নোট ছাপা হচ্ছে, খালিস্তানের গোপন হেড-কোয়ার্টার গড়ে উঠছে গুরুদুয়ারাতে।
কেমন করে এসব আরোপ করা হলো, আর কে এই জার্নাল সিং? ভারত সরকারের দাবি অনুযায়ী, তিনি কেমন করে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠলেন? নাকি এসবই শুধু মনগড়া আরোপ? আসলে পুরোটাই তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের একটি ‘পলিটিক্যাল গেম’ যার মধ্যে জার্নাল সিং ছিলেন শুধুমাত্র দাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি? কিন্তু দাবার ঘুঁটি উল্টো চাল দিতে শিখে গেলে বিপদটা খেলোয়াড়দের হবেই, এসবই বিশ্লেষণ করা হবে পরের পর্বে। চলবে