অমিতাভ পালের গদ্য ‘বন্দি বায়োরোবট’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০২১

একবিংশ শতাব্দীতে তো চায়ের দোকানের আড্ডায় মার্কসিজম, জিনোলজি— এইসব নিয়া আলোচনা হওয়ার কথা। এইসব জ্ঞানতো এক-দেড়শো বছরের পুরানো। অন্তত এখনতো এদের চায়ের দোকান পর্যন্ত পৌঁছানো উচিত এবং আলোচনা হতে হতে বহুবার পড়া একটা বইয়ের মতো এবড়ো থেবড়ো হয়ে যাওয়া উচিত। অথচ হচ্ছে না।  আজকের সময়ে বসে থাকা আমরা কি তাহলে আরো পুরানো?

বলা যায়। কেননা মানুষ নিজেও একটা বায়োমেশিন, বায়োরোবট। জরায়ূর ল্যাবরেটরিতে জন্ম নেয়া এই মেশিনে ইনপুট দেয়া হয় সামাজিকভাবে। ফলে একটা সমাজ যে সময়ে বাস করে, তার প্রতিষ্ঠানগুলি যে সময়কে ধারণ করে— বায়োরোবটের ইনপুটও হয় সেই সময়েরই। আমরা মূলত দুভাবে শিখি— সমাজের মুখ থেকে আর শিক্ষার জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে। সমাজ নিয়ন্ত্রকদের হাতেই থাকে এই দুই পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ। ফলে আমাদের শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত, আমাদের ভাবনা নিয়ন্ত্রিত, আমরা যতই নিজস্বতার গুণগান গাই না কেন— খুব গভীরে আমরা নির্দেশিত পথেই চলছি। মেশিনের তো আর কিছু করার নেই।

তবে একটা জিনিস করা যায়। মেশিন যদি মেশিনেরই নিয়ন্ত্রক হয় তাহলে নিজের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সে নিজেকে দিতে পারে। সেই শিক্ষার কারিকুলাম সে নিজেই তৈরি করতে পারে। সমাজের বাতাসে জীবাণুর মতো তাদের ছড়িয়ে দিতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সে হয়ে উঠতে পারে নিজেরই শিক্ষক। মেশিন বা এখন থেকে মানুষই বলি, নিজের নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয় না বলেই আজকের করোনা মহামারির দিনে সামাজিক বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছে। মহামারির নিয়ন্ত্রণে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা দরকার, সেটার শিক্ষা সমাজ এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে পায়নি মানুষ। বা তাকে শেখানো হয়নি। এটা রাতারাতি শেখানো যায় না। এক ধারাবাহিক শিক্ষাপদ্ধতির ভিতর দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য মন তৈরি হওয়ার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান গ্রহণের যে ক্ষমতা জন্ম নেয়, সেটার অভাবেই মহামারিকেও নিয়তির হাতেই সঁপে দিয়েছি আমরা, সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছি।

চায়ের দোকানের আড্ডায় মার্কসিজম ও জিনোলজি নিয়ে আলোচনা যদি নিয়মিত কোনো ঘটনা হতো, তাহলে মহামারির সময়ে করণীয় বিষয়ে শিক্ষা এমনিতেই থাকতো মানুষের। বরং তখন সর্বশেষ তথ্য সংযোজন করে সরকার বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপকরা ওই শিক্ষাকে আপডেট করার মাধ্যমে আরো নিবিড়ভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারতো। আমাদের সামাজিক স্বাস্থ্যও থাকতো অ্যান্টিবডিতে ভরা।

নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে, নিজেকে নিজের শিক্ষক বানাতে এখনো চাইছে না মানুষ। কারণ পুঁজি ও ধর্মের প্রোপাগাণ্ডা তাকে ঢেকে রেখেছে আপাদমস্তক। এই অন্ধকার আচ্ছাদন সরিয়ে মানুষকে সূর্যের আলোয় স্নান করাতে প্রয়োজন চিন্তায় অগ্রসর মানুষদের। আমরা এমনিতেই পিছিয়ে আছি অনেক। অন্তত বর্তমানের কাছাকাছিও যদি আমাদের পৌঁছাতে হয়, তাহলে এক মূহূর্ত নষ্ট করা যাবে না। নতুন পৃথিবী তৈরির কাজে খরচ করে ফেলতে হবে আমাদের সব সম্পদ। তাহলেই হয়তো সব মানুষ নিজের শিক্ষক, নিজের নিয়ন্ত্রক হতে পারবে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক