অমিতাভ পালের গল্প ‘রূপার মেডেল’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০২০

একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গিয়েছিল আজ। তছনছ হয়ে গিয়েছিল সব। সীমান্ত ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছিল, যেন একটা মাঠের কাছে সব দেশ হারিয়ে ফেলেছে তাদের পরিচয়। শহরগুলি সব যুদ্ধবিধ্বস্ত, জনশূন্য। আইন কানুন, শৃঙ্খলা, দমন, পীড়ন— সবকিছু যেন উধাও হয়ে গেছে রাতারাতি, নির্দেশ দেবার মতো কোথাও কেউ নাই। এখন কেবল দিকচিহ্নহীন চারপাশ, এখন কেবল মুক্তি, স্বাধীনতা।

আমি এসবের কিছুই জানতাম না। ডুবেছিলাম অবিরাম রুটিনের মধ্যে। অফিস আর বাসার মাধ্যাকর্ষণ আমাকে কক্ষচ্যুত হতে দেয়নি কখনো। এমনকি গতকালও শেষবিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে নিয়মিত বাস আর পথের ট্র্যাকে চড়ে ফিরেছিলাম বাসায়। তারপর সংসারের হট্টগোলের মধ্যে না জানিয়েই চলে এসেছিল রাত। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। যান্ত্রিক জীবনের সারাদিনের ক্লান্তি আজকাল আমাকে স্বপ্নও দেখতে দেয় না যেহেতু, তাই কালো একটা পর্দা ছাড়া ঘুমকে আর কিছুই ভাবতে পারি না বলে ওই পর্দাটা মুড়ি দিয়েই পড়েছিলাম বিছানায়।

রাতে একবার উঠে বাথরুমেও গিয়েছি। তখন চোখে পড়েছিল জানালা দিয়ে মেঝের ওপর এসে পড়া সাদা কাপড়ের টুকরার মতো একখণ্ড জ্যোৎস্না। কিন্তু সেটাও দাঁড়িয়ে দেখিনি কারণ জ্যোৎস্নার চেয়েও ক্লান্তি দূর করাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নাহলে যে পরদিন অফিসের জোয়াল টানতে পারবো না। এই ক্লান্তি আমাকে বউয়ের কাছ থেকেও দূরে রাখে ফলে শরীরের সুখের কথা আমি যেন ভুলেই গেছি। এই ক্লান্তি যেন অফিসের গোপন এজেন্ট, সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখে আর প্রস্তুত করে ড্রাইভে বের হবার আগে ইঞ্জিন পরীক্ষার মতো।

কাল রাতেও ওই পরীক্ষার পাল্লায় পড়ে আমার জ্যোৎস্না দেখা হয়নি, জানালায় দাঁড়ানো হয়নি, এমনকি একটা সিগারেট খাবার ইচ্ছাকেও দমন করতে হয়েছিল নির্মমভাবে, যাতে চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে না যায়।

তারপর যথারীতি সকালে উঠে জেগে থাকার রুটিনের মধ্যে ঢুকে গেছি, বাথরুম-চা-সিগারেট-নাস্তা-বাজার শেষে অফিসে রওনা হয়ে গেছি, উঠে পড়েছি বাস আর পথের ট্র্যাকে, অফিসে পৌঁছে ঢুকে পড়েছি বরাদ্দ করা রুমে, বসে পড়েছি চেয়ারে আর টেনে নিয়েছি গতকাল পর্যন্ত করা কাজের লেজ, তারপর ডুবে গেছি লেজটাকে একটা কোনো শরীর দেয়ার ব্যস্ততায়। এইভাবেই কখন যে দুপুর হয়েছে, বিকেল হয়েছে— টের পাইনি কিছুই। শেষে পিয়নের ডাকে যখন বুঝতে পেরেছি অফিস শেষ, তখন বেরিয়ে এসেছি ট্র্যাক ধরার জন্য।

প্রতিদিনের মতো আজও বাসার বাসস্টপে নেমে যখন গলিটাতে ঢুকবো, এক পুরানো বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। বন্ধুটা হৈহৈ করে উঠলো আমাকে দেখে। কলকল করে বলতে লাগলো আমাদের প্রথম যৌবনের স্মৃতিমাখা গল্পগুলি। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, বন্ধুটা বাড়াবাড়ি করছে, এগুলি একটাও আমার গল্প না। এদিকে ক্লান্তি আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল আগামীকালের অফিসের কথা। ফলে আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়াতে চাইলাম স্মৃতির ওই নাগপাশ থেকে। কিন্তু বন্ধু নাছোড়, সে একটু আড্ডা দিতে চায়, জানতে এবং জানাতে চায় আমার আর তার কথা। এখন কী যে করি! এদিকে ক্লান্তির চোখ এখন রাগে লাল।

হঠাৎ মনে হলো বন্ধুর আহ্বানে গা ভাসিয়ে দেই। মনের একেবারে গভীরে চাপা পড়ে যাওয়া স্মৃতিগুলিকে তুলে আনি পুরানো ফটোগ্রাফের মতো। ভুলে যাওয়া নিজেকে আবার একটু দেখতে নাহয় আজ নিজেকে বের করে আনি এই ক্লান্তি আর অফিসের ঘেরাটোপ থেকে। নাহয় আরেকটু বেশি ক্লান্ত হবো অথবা প্রতিদিনের এই ক্লান্তিকে যদি পাত্তা না দেই, তাহলে হয়তো সেও আর দাপট দেখাতে সাহস পাবে না। ভাবনাটা মনে আসতেই একটু যেন চনমন করে উঠলো মনটা, যেন বোঝাতে চাইলো আমার এই সিদ্ধান্ত সে সমর্থন করে। মনের এই সায় আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল, ঠিক আছে চলো, একটু আড্ডা দেয়া যাক।

বন্ধুর মুখটা সাথে সাথেই ঝলমল করে উঠলো। বললো, এইতো, এতক্ষণে তুমি তোমার মতো কথা বলেছো। তাহলে চলো, আড্ডাটা শাহবাগে দেই। আমাদের পুরানো জায়গাগুলিতে ঘুরে ঘুরে দেখি তারা কেমন আছে। একটু দাঁড়াও, আমি একটা সিএনজি ডাকি।

বড় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খালি সিএনজি খুঁজতে শুরু করে দিল বন্ধু। এদিকে আমার মনে তখন ক্লান্তির সঙ্গে বাকযুদ্ধ চলছে। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে, বলে ক্লান্তি শুরু করেছিল এই যুদ্ধ। আর আমি মরিয়া বিদ্রোহীর মতো তার তলোয়ারের কোপগুলি ঠেকাচ্ছিলাম আমার তলোয়ার দিয়ে। আমাদের সেই যুদ্ধ ছিল অলিম্পিক ফেন্সিংয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ লড়াইয়ের মতো।

ঠিক তখনই আমার পাশে এসে দাঁড়ালো একটা সিএনজি এবং ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে বন্ধু বললো উঠে পড়তে। আর আমিও অভ্যাসবশত যাব না বলে গলায় একটা রূপা মেডেল ঝুলিয়ে ঢুকে পড়লাম বাসায় যাওয়ার গলিতে। আমার পরাধীনতায়।

বিজয়ী ক্লান্তি তখন সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে হাসছে আর তৈরি করছে তছনছ হয়ে গুড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীটাকে।