হাসপাতালের সিসিইউতে শিল্পী মুর্তজা বশির

হাসপাতালের সিসিইউতে শিল্পী মুর্তজা বশির

অসম্মানের অপসংস্কৃতি বন্ধ হবে কবে

মুনিরাহ বশির

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৮, ২০১৯

২৬ অক্টোবর রাত ১১টায় অ্যাপোলো হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে মুমূর্ষু অবস্থায় বাবাকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাই। রাত দেড়টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন, স্যারকে ডা. রেজা (ডা. এ কিউ এম রেজা, কার্ডিওলজিস্ট, বাবার ডাক্তার) সিসিইউতে ভর্তি করতে বলেছেন। বাবাকে বললাম, সিসিইউতে ডা. রেজা ভর্তিতে হতে বলেছেন। বাবা বললেন, তোর ঝামেলা হয়ে গেল। সুজাত, কুটটুর খাওয়া দাওয়া কে দিবে। বললাম, ওইসব চিন্তা করতে হবে না। সব হয়ে যাবে।

আমার কাছে অ্যাপোলো হাসপাতাল মানেই আমার আম্মা... ইমারজেন্সিতে আম্মার স্মৃতি... চারদিকে আম্মার স্মৃতি... ছবির মতো সব চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে... দাঁতে দাঁত চেপে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করছি। ইমারজেন্সিতে আম্মা যেখানে ডায়ালাইসিস করতেন সেইসব জায়গা দেখছি। শেষবার আম্মা চলে যাওয়ার আগে ইমারজেন্সিতে ৭ মে ২০১৭... ডায়ালাইসিস চলছে... আম্মা বমি করছেন... আম্মার চোখ স্থির হয়ে আছে... বাবার চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে... যুথী চিৎকার দিয়ে বলছে দিদি তাড়াতাড়ি আসো... আম্মা চলে যাচ্ছে... আমি ডাকছি, আম্মা আম্মা...

বাবা সিসিইউতে চলে গেলেন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। সিসিইউ ডাক্তার ডাকলেন। আম্মা চলে যাওয়ার চার মাস আগে এই সিসিইউতে ছিলেন। আম্মার স্মৃতিতে নষ্টালজিক হয়ে এগিয়ে গেলাম। সিসিইউ ডাক্তার বললেন, স্যারের কি হয়েছিল? বললাম, খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি বারবার বাবাকে বলছিলাম বাবা হাসপাতালে চলেন। উনি আসতে চাচ্ছিলেন না। আমি জোর করে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার বললেন, সময় মতো এনেছেন। বললাম আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু হয়। ডাক্তার বললেন, তা না হলে দুঃসংবাদ শুনতেন। তিনটা Lasix Injection দিয়েছি। শরীর থেকে প্রায় দুই লিটার পানি বের করেছি। সাত লিটার অক্সিজেন দিচ্ছি। আরো পানি আছে।

বললাম, বাবাকে দেখতে চাই। ডাক্তার অনুমতি দিলেন। সিসিইউর ভিতরে আমার জন্য কষ্টকর বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। আম্মা ছিলেন ২৪১৩ তে, বাবা ২৪১৪। মনে হচ্ছিল, আমার পা দুইটায় প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছে। বাবার কাছে যাব কী... ২৪১৩ তে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি, আম্মা শুয়ে আছেন। আমাকে ডাকছেন যুই পানি দে... সিস্টাররা দেয় না... কাত করে দে... দেখ না হাত দুইটা বেঁধে রেখেছে... খুলে দে না মা। আমি ফিরে গিয়েছি ২৬ অক্টোবর ২০১৯ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৭ তে। সিস্টার কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। বললো, খালি রুমে কি দেখেন আপু। বললাম, আম্মা এখানে ছিলেন।

২৭ তারিখে সকালে ডা. রেজা বললেন, বাবার Acute Left Ventricular Failure হয়েছে। আমি বললাম, Medical Terms বুঝি না। বাংলায় সরাসরি বলেন। তিনি বললেন, হার্টের ভেতরে চারটে চেম্বার আছে। রাইট এট্রিয়াম, লেফট এট্রিয়াম, রাইট ভেন্ট্রিকল এবং লেফট ভেন্ট্রিকল। এই চারটে চেম্বারের মধ্যে লেফট ভেন্ট্রিকলই জোরে পাম্প করে চেম্বারে থাকা রক্ত সমস্ত শরীরে পাঠায়। কিন্তু ব্লাড প্রেসার যদি বেশি থাকে তবে লেফট ভেন্ট্রিকলকে অনেক বেশি জোরে দিয়ে পাম্প করতে হয় শরীরের সমস্ত প্রান্তে রক্ত পাঠাবার জন্য। বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে বেশি চাপ দিয়ে রক্ত পাঠাবার ফলে লেফট ভেন্ট্রিকলের আকার বেড়ে যায়, যাকে লেফট ভেন্ট্রিকুলার হাইপাট্রফি বলে। লেফট ভেন্ট্রিকলের এই আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে হার্ট মাসলের কর্মক্ষমতা কমে যায়। ফলে রক্ত যখন ডায়াস্ট্রোলের সময় লেফট ভেন্ট্রিকল যতটা রিলাক্স হওয়ার কথা ততটা রিলাক্সড হতে পারে না।

দীর্ঘদীন এই বেশি প্রেসার দিয়ে পাম্প করার ফলে লেফট ভেন্ট্রিকল ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে সেই রক্ত কাছাকাছি কোনো নির্ভরযোগ্য অর্থ্যাৎ লাংসে জমা হতে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত রক্ত লাংসে জমা হওয়ার জন্য লাংসে সঙ্কোচন ও প্রাসরণে ব্যাঘাত ঘটে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। লাংস তখন অতিরিক্ত পরিপূর্ণভাবে শ্বাস নিতে পারে না। ফলে শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়। এবং অতিরিক্ত জলীয় পদার্থ জমা হওয়ায় লাংস প্রশ্বাস ভালো ভাবে ছাড়তেও পারে না। ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড জমার ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যার ফলে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন লেফট ভেন্ট্রিকুলার ফেলিওর বা হার্ট ফেলিওর হয়। দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে অল্প সময়ের মধ্যে রোগী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে।

২৬ তারিখে রাতে বাবার তাই হয়েছিল। একে তো ফুসফুসের অসুখ, এবার আবার নতুন উপসর্গ। যুথী ২৬ তারিখে সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে চিটাগং চলে গিয়েছিল। বেচারি খবর পেয়ে দুপুরের মধ্যে হাসপাতালে চলে আসে। ৩০ তারিখে দুপুরে বাবার কাছে সিসিইউতে বসে আছি। বাবাকে চিন্তিত মনে হলো। জিজ্ঞাসা করায় বললেন, হাসপাতালের বিল কত এসেছে? বললাম, শুনে কি হবে? বললেন, টাকাটা তো যোগার করতে হবে। বললাম, চিন্তার কারণ নাই। হয়ে যাবে। একজন অসুস্থ মানুষ সিসিইউতে বসে চিন্তা করছেন বিলের টাকার কথা। দুপুরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে ফোন করে বাবার শারীরিক অবস্থা জানার পর মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় জানতে চাইলেন কত টাকা খরচ হয়েছে। আমি অ্যামাউন্ট বলার পরে তিনি বললেন, আপনি এখনই একটা আবেদন করুন আমি কিছু অনুদান দেব। বললাম, কিসের অনুদান?

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বললেন, চিকিৎসার জন্য অনুদান। এবং উনি বললেন সন্ধ্যার দিকে আসবেন। তখনো বাবার শারীরিক উন্নতি খুব ধীরে ধীরে হচ্ছে। আমি সারাক্ষণ বাবার সাথে সিসিইউতে। ওই মুহূর্তে অনুদানের জন্য আবেদন করার মতো মন মানসিকতা কার থাকে! একজন অসুস্থ মানুষ যে কিনা একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন তাকে চিকিৎসার জন্য অনুদান পেতে হলে আবেদন করতে হবে। এই অসম্মানের শেষ কবে হবে! আমি ফোন রেখে বাবাকে বিস্তারিত জানালাম। বাবা সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়ে গেলেন। বললেন, আমি আমার চিকিৎসার জন্য আবেদন করে অনুদান নেব? আমি কি ভিক্ষুক? আমি বললাম, বাবা শান্ত হোন। আপনার হার্ট ফেলিওর হয়েছে। এখন হার্ট অ্যাটাক হবে। আর আপনার এই অবস্থা দেখে আমার ব্রেইন স্ট্রোক করবে (আমাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি)। আপনার পাশের রুম যেটায় আম্মা ছিলেন, খালি আছে। আমি ভর্তি হয়ে যাই।

কারো অনুদান আমার বাবার প্রয়োজন নাই। আমরা তিন ভাইবোন আছি। আল্লাহ ছাড়া আমাদের বাবা-মা কারো কাছে মাথা নত করতে নিষেধ করেছেন। আমার বাবা তার বাবা-মার থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছিলেন। উত্তম যোগ্যতাবিশিষ্ট জনপ্রিয় গুণীজন যারা, রাষ্ট্রের জন্য নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে সম্মান বয়ে আনেন, তাদের অনেকের স্বপ্ন থাকে তার সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মানের... জীবিত অবস্থায় স্বাধীনতা ও একুশে পদকের জন্য সুপ্ত স্বপ্ন অন্তরে সযতনে লালন করে থাকেন। আমার বাবা শিল্পী মুর্তজা বশির স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮০) পাওয়ার ৩৯ বছর পর। বাবার থেকে জুনিয়র শিল্পীরা স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন অনেক আগে। দীর্ঘ সময়ে স্বাধীনতা পদক না পাওয়াতে বাবার মনে কষ্ট ছিল। আমাদের পরিবারে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমার দাদা একুশে পদক পান (মরণোত্তর) ২০০২ এবং তাঁর দুই পুত্র কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ আমার চাচা (মরণোত্তর) পান ২০১৮ ও শিল্পী মুর্তজা বশীর আমার বাবা একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৮০ সালে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্বাধীনতা পদক পান ১৯৮০ সালে (মরণোত্তর)। শিল্পী মুর্তজা বশীর স্বাধীনতা পদক পেলেন ২০১৯ সালে। একই পরিবারে এতগুলো রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা পাওয়া সত্যি বিরল! এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ, গুরুতর অসুস্থ গুণীজনদের জন্য আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুদান প্রদান করা হয়। জীবিতকালে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যা তারা deserve করে মরণোত্তর পদক প্রদান করে অসম্মান করার অধিকার কে দেয়? এটা কোন ধরনের সম্মান? অনেকের কাছে জীবিতকালে এই সব পদক সোনার হরিণই হয়ে থাকে। বাবা বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পদক দিলে তোমরা flatly refused করবে। Hypocrisy (বাংলায় কী হবে জানি না)... মিথ্যা মৌখিক আশ্বাস... এই অসম্মানের অপসংস্কৃতি বাংলাদেশে বন্ধ হবে কবে?