অ্যাডগার অ্যালান পো: ম্যারি রজার হত্যা রহস্য

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১

অ্যাডগার অ্যাল্যান পো’কে হরর সাহিত্যের অত্যন্ত গুণী লেখক হিসেবে ধরা হয়। তিনি ডিটেক্টিভ স্টোরির জনক হিসেবেও বহুল পরিচিত। সূক্ষ্মভাবে বিস্তারিত কাহিনি রচনায় নিঃসন্দেহে তিনি অনন্য মেধার অধিকারী ছিলেন। মানুষের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো তিনি এত দক্ষতার সাথে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন, যা পাঠককে অ্যাডভেঞ্চারের সাথে সাথে দিয়েছে ভয় আর অস্বস্তিমাখা অনুভূতি।

১৮৪২ সালের নভেম্বর থেকে পো’র লেখা বেশ কিছু গল্প প্রকাশিত হয় লেডিস কম্পেনিয়ন জার্নালে। এর মধ্যে একটি ছিল, মেরি রজার হত্যা রহস্য। তিন পর্বের এ গল্পটি বাস্তবের ম্যারি সিসিলিয়া রজার নামের এক কালো চুলের সুন্দরী তরুণীর হত্যা রহস্য নিয়ে লেখা। ১৮৪১ সালের কথা, জুলাই মাসের শেষদিকে মেরি রজার নামের নিউ ইয়র্কের এই তরুণীর লাশ মেলে হাডসন নদীতে। আর সত্যি অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, পো ছিলেন এই হত্যার সম্ভাব্য সন্দেহভাজন। কিন্তু কীভাবে? কে এই ম্যারি রজার আর পো`র সাথে তার কী সম্পর্ক? এ বিষয়টি নিয়েই লিখেছেন এনশায়েন্ট অরিজিন। বাংলায় অনুবাদ করেছেন রিফাহ সানজিদা।

ম্যারি রজার

নিউ ইয়র্কের স্বনামধন্য এক সিগার-শপে কাজ করতো সুন্দরী ম্যারি রজার। স্বভাবসুলভ সরলতার সাথে সাথে তার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করতো সিগার-শপের পুরুষ খদ্দেরদের। অনেকেই ওর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে লিখতো প্রেমের কবিতা। ম্যারির রূপে-গুণে সাধারণ খদ্দের থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যেত। হত্যার এক বছর আগে একদিন স্থানীয় পত্রিকায় ম্যারিকে নিয়ে অদ্ভুত খবর বেরুলো, ম্যারি রজার নিখোঁজ।

প্রায় দু`সপ্তাহ নিখোঁজ থাকার পর ম্যারি আবার কাজে ফিরে এলো। যদিও ম্যারি দাবি করলো, সে তার এক বন্ধুর বাড়িতে ছিল। সিগার-শপে অন্যান্যদের বক্তব্য এবং কেসের গতিবিধি অনুযায়ী পুলিশ ধারণা করেছিল, ম্যারি রজারকে অপহরণ করা হয়েছে।

এর কিছুদিন পরই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটলো। ম্যারি রজার আবার নিখোঁজ হলো। পুলিশ এবার সিগার-শপের মালিক জন অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। কারণ সে প্রতিদিন ম্যারিকে কাজের পর বাড়িপর্যন্ত এগিয়ে দিতো। তবে কোনো প্রমাণ না পেয়ে তাকে ছেড়ে দিলো পুলিশ। এবার সন্দেহ ঘুরলো ম্যারির প্রেমিক ও বাগদত্তা ডেভিড পেয়নের দিকে। ডেভিড স্বীকার করলো, গায়েব হবার দিন ওরা একসাথে ছিল, তবে ম্যারি কোথায় গেছে সে জানে না। আর এ ব্যাপারে সে জড়িতও নয়।

জুলাইয়ের ২৮ তারিখ। অবশেষে মিললো ম্যারি রজারের মৃতদেহ। যাতে স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। এম আর আদ্যক্ষর যুক্ত ম্যারির রুমাল, শাল, জামার ফিতে ইত্যাদি উদ্ধার করা হলো হাডসন নদীর ধারের এক বনের ভেতর থেকে। একই দিন রহস্য আরো ঘনীভূত করে আত্মহত্যা করে ডেভিড, ম্যারির বাগদত্তা। যাবার আগে সে লিখে রেখে যায় চিরকুট। যাতে লেখা ছিল "ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন আমার নষ্ট জীবনের জন্য, যে পৃথিবীতে আমি সবার চোখে অপরাধী"

এ ঘটনায় সবার ধারণা হলো, ডেভিডই ম্যারির হত্যাকারী। কিন্তু পুলিশ জানালো ভিন্ন কথা। ঘটনার দিন ডেভিড সেখানে উপস্থিত ছিলো না। তাই রহস্য আবার দানা বাঁধে। এতকিছুর মধ্যে জনতার মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে। ক্লুহীন অবস্থায় বিভিন্ন থিওরি নিয়ে পুলিশ কাজ করতে থাকলো। কিন্তু বিভিন্ন মিথ্যে তথ্য আর এ নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বারবার পুলিশের ব্যর্থতা ফুটিয়ে তুললো। জনতার আগ্রহও কমে আসতে থাকলো এ নিয়ে। শেষপর্যন্ত কেসটি আনসলভড কেস হিসেবেই পড়ে রইলো।


পো এবং ম্যারি  

ম্যারির মৃত্যুর পর একসময়ে সিগার-শপের নিয়মিত খদ্দের অ্যাডগার অ্যাল্যান পো লিখতে শুরু করেন ম্যারির হত্যা রহস্য নিয়ে। লেখার দ্বিতীয় পর্বে যে ডিটেক্টিভের অবতারণা করেন পো, সি অগাস্টে ডুপিন, বলা হয়ে থাকে যে, এই ক্যারেক্টারটিই পরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত ডিটেক্টিভ ‘শার্লক হোমস’ এর ভিত্তি তৈরির অনুপ্রেরণা দেয়। নাম ও স্থান বদলিয়ে প্যারিসের ঘটনা হিসেবে এ কাহিনীর শুরু করে,  পো তার লেখায় ম্যারি রজার হত্যার খুঁটিনাটি একই রকম রাখেন। সি অগাস্টাস ক্যারেক্টারটিকে পো তার লেখায় ভিন্নতা এনে সাফল্য দিতে চান। লেখকের প্ল্যান ছিল, প্রথমেই ডিটেক্টিভ আসামিকে খুঁজে পাবে, এরপর তিন পর্বে হত্যা রহস্য খুলবে। কিন্ত শেষপর্ব প্রকাশিত হবার আগেই বাস্তবে ম্যারি রজার কেসের মোড় ঘুরে যায়।

পুলিশের ইনভেস্টিগেশন আর লেখকের ডিটেক্টিভের ইনভেস্টিগেশন দুই মেরুতে অবস্থান নেয়। পরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পো তাই আদালতের রায়ে বাধ্য হন শেষপর্বের কাহিনিতে পরিবর্তন আনতে। পো তার লেখায় সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যসূত্র থেকে সব সন্দেহভাজনদের নিয়ে লেখা শুরু করেন। হত্যাকাণ্ডের একের পর এক বর্ণনা দিয়ে সন্দেহভাজনদের গতিবিধি আর মোটিভ তালিকায় আনা শুরু করেন। তবে তিন পর্বের লেখায় এসব রহস্য জট পো এত বিস্তারিতভাবে লেখেন যে, সবাই এ নিয়ে কানাঘুষো শুরু করে।

এমন সব তথ্য নিয়ে আসেন পো, যা প্রকাশিতও হয়নি কোথাও। তাহলে পো কী করে জানলেন এত নিখুঁত সব তথ্য, যা মিলে যাচ্ছে মৃতদেহের বর্ণনার সাথে? তাহলে কি পো নিজেই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কোনোভাবে? এমন সব আলোচনার মধ্যে ফিরে যাওয়া হয় তিন বছর আগে। উদ্ঘাটিত হয় যে, পো ম্যারির শপে একসময় নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। ম্যারি প্রথমবার নিখোঁজ হবার আগের দিন, আর কেউ নয়, বরং পো’ই ছিলেন ম্যারির সাথে। যার সাথে মেয়েটিকে ঘনিষ্ঠভাবে হাসতে দেখা গেছে। আবার হত্যাকাণ্ডের তিনদিন আগে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এক লোকের সাথে হাঁটছিল ম্যারি। যার শারীরিক বর্ণনো হুবহু মিলে যায় পো’র সঙ্গে। তবে আসলেই ম্যারি আর পো’র কী সম্পর্ক ছিল, তা নিয়ে এখনো জল ঘোলাটে। কেউ নিশ্চিত করে এ বিষয়ে তথ্য দিতে পারেনি।

তবে ম্যারি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন পো তা পুলিশ আর জনমনে সৃষ্টি করেছিলো নতুন প্রশ্ন , নতুন বিতর্ক। ম্যারি কি শুধুই একটা সাবজেক্ট ছিলেন পো`র জন্য? যে ম্যারির সাথে এক সময় ঘনিষ্ঠতা ছিল পো`র, তার মৃত্যু রহস্য এত নিখুঁতভাবে কী করে লিখলেন তিনি? একি শুধুই পো`র দুর্দান্ত সব বুদ্ধির খেলা নাকি পো নিজেই এমন একটা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন নিজের লেখা ডিটেক্টিভ স্টোরিকে জনপ্রিয় করতে? সেটি এখনো এক রহস্য। কারণ পুলিশ দোষীকে খুঁজে বের করতে পারেনি। ম্যারি রজার কেস পো`র মৃত্যু রহস্যের মতোই অন্ধকার-ধোঁয়াশার রহস্যজালে ঘেরা। ।