আন্ডারগ্রাউন্ড

উপন্যাস ৭

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০১৯

কি খবর মামুন, সব ভালো তো?
মামুন ভাবলো কানের ভুল। ‘কি খবর মামুন স্যার, সব ভালো তো?’ এটাই বলেছে তোফাজ্জল। গাড়ির আওয়াজে স্যার শব্দটা শুনতে পায়নি সে। তাই এবার কানটা খাড়া করে মামুন জিজ্ঞেস করলো, চা খাবেন? তফাজ্জলকে চায়ের দাওয়াত দেয়ার সামান্য ইচ্ছা নেই কিন্তু মামুনের কানের ভুল কিনা সেটা পরীক্ষা করতেই চায়ের প্রশ্ন।

তুমি চাও আমি চা খাই? তাহলে খাই আর কি করার!
মামুনের হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেল। চোখ কুচকে এলো, হার্টবিটও বেড়ে গেছে, রাগে মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ছে সে। কুরবানির জবাই হওয়া প্রাণীর মতো গোঙরাচ্ছে। তোফাজ্জল নরম হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। মামুন নিজেকে শান্ত রেখেছে, রমজান মাস, তারাবীহ মাত্র শেষ হয়েছে। মসজিদ থেকে মুসল্লিরা বের হয়ে সবাই চায়ের দোকানে আসছে দলে দলে। এরমধ্যে মন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়া, কোনোভাবেই অন্যকোনো সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না এখন। যেটা ঘটার সম্ভাবনা আছে সেটাই ঘটাতে হবে অর্থাৎ কাদেরের হাতে তোফাজ্জলকে তুলে দেয়াটাই একমাত্র কাজ। সেটাই ঘটাতে হবে।

নতুন একটা সিগারেট জ্বলে উঠলো আবার। কয়েকজন মুসল্লি তাকিয়ে দেখছে তাদের। বাঙালির আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নাই। মামুনের বিরক্ত লাগছে, কারো দৃষ্টিতে মায়া নাই। অধিকাংশই দুর্নীতিবাজ, বাটপার। মামুন নিজেও কম না, সে নামাজ কালাম পড়া ছেড়ে দিয়েছে। চোরের আবার কিসের ধর্মকর্ম? টাকাই চোরের ঈশ্বর! আর মামুন বিজ্ঞানের ছাত্র, পুরোপুরি নাস্তিক না হলেও ‘কেন নামাজ পড়া অহেতুক’ এই বিষয়ে তার লজিক আছে।

মকবুল ইসলাম নামের এক ফিজিক্স শিক্ষক ছিলেন, আজও মামুনের প্রিয় শিক্ষকের আসনেই আছেন উনি। প্রচণ্ড যুক্তিবাদী মানুষ। উনিই বলতেন, তরা মানুষ হ, ধার্মিক হোস না, এসব হাস্যকর, মহা হাস্যকর। প্রায় প্রায় স্যারের এসব বক্তব্য শুনে ছাত্ররা মনে মনে রেগেও যেতো, মামুনও ছিল তাদের মধ্যে। এদেশে ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে বড় বিষ আর নাই। এই এক বস্তু দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হয়ে যাচ্ছে। পারমাণবিক যুদ্ধও সম্ভাব্য। মামুন মাঝে মাঝে এসব ভাবে আর অস্থির হয়ে ওঠে।

ওই স্যারের ক্লাসেই ক্লাসেই থিওরি অব প্রবাবিলিটি নিয়ে কিছুটা শুনেছিল। মকবুল ইসলাম বলতেন, আমাদের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে, একই সাথে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমরা যদি আমাদের পছন্দের সম্ভাব্য ঘটনাকে ঘটাতে চাই, তাহলে সেই ঘটনাকে ঘটানোর জন্য যে যে সম্ভাবনা জরুরি সেগুলোতে আমদের মনোযোগ দিতে হবে। তাহলেই যা চাই তার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব। স্যারের এই কথা বুঝতে মামুনের অনেক বছর লেগেছিল। এখন মামুন খুব ভালোই বোঝে বিষয়টা। সে রাগ কমিয়ে হাসি মুখে বললো, অবশ্যই চাই আপনি চা খান। দোকানের ছেলেটাকে বললো, ওই, স্যারকে একটা ভালো চা দে তো। সব যেন খুব স্বাভাবিক, মামুন যেন কিছুই শোনেনি একটু আগে।

তোফাজ্জল আরো কাছে এলো। আতরের গন্ধে মনে হচ্ছে কোনো ফেরেশতা আকাশ থেকে নেমে এসেছে। মামুনের হাত থেকে সিগারেটটা নিলো, তারপর দিলো একটা লম্বা টান। মামুন ঠিক করলো, মন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েই তোফাজ্জলকে একটা চড় দিবে এবং টার্গেট থাকবে এক চড়ে অন্তত ২টা দাঁত ফেলার। তারপর বলবে, শুয়রের বাচ্চা তোকে নিয়ে এতক্ষণ খেলছিলাম আসলে, তোকে চায়ের দোকানেই মেরে ফেলতে পারতাম।

তোফাজ্জল আবার হাসছে, দুষ্টু হাসি। মামুন ঠিক করলো, একটা না শালাকে মিনিমাম পাঁচটা চড় দেবে। মিনিমাম দশটা দাঁত!

তোফাজ্জল বললো, আচ্ছা মামুন রাস্তা তো ফাঁকা প্রায়। দুইদিন পর ঈদ। ঢাকার লোক বাড়ি গেছে, আমরা রিকশায় যাই? আজ হাওয়াও ভালো দিচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভিজতে ভিজতে যাবো। মন্ত্রী সাহেবকে বলবো যাতে খিচুড়ি রান্না হয় সাথে বেগুন ভাজা আর শুঁটকি ভুনা। একটু মগজ ভুনাও খাওয়া যায় সাথে। মামুনের এবার রাগের পরিবর্তে বিরক্তি এলো। এই লোকটার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার কোনো মানেই হয় না। সে প্রেমিকা নাকি!

রিকশা চলছে, রাস্তা ফাঁকা, পিছে পুলিশের গাড়ি। গাড়িতে দীনেশও আছে। সে ঘটনার আগা মাথা কিছু বুঝছে না। শুধু এটা বুঝছে, ঘটনা উপর লেভেলের। তাই আপাতত চুপ থাকা ভালো।

থানার প্রায় সকলকে একটা গাড়িতে তুলে রিকশাকে ফলো করার নির্দেশ মামুনের। সে কোনো রিক্স নিতে চায় না। যতো দ্রুত সম্ভব এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। এরই মধ্যে পাঁচটা চড়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে সে। তোফাজ্জলের সাথে এক সেকণ্ডও সে থাকতে চাই না সে। চড়ের লোভেও না। অতি বুদ্ধিমান লোকের সাথে থাকা ভয়ানক অস্বস্থিকর। কারণ এরা আগেই চাল বুঝে যায়। তোফাজ্জলও তাই। মামুনের অস্বস্থি হচ্ছে। অথচ তফাজ্জল তো কোনো বুদ্ধির খেলাও দেখাইনি। তাহলে তার সাথে কেন এতো অস্বস্থি হচ্ছে? মামুন এসব ভাবছে আর সিগারেট টানছে, মাঝে মাঝে মামুনের হাত থেকে তোফাজ্জল সিগারেট নিয়ে নিজেও টানছে। সে শুধু একাই না আবার, রিকশাঅলাকেও জোর করে টানাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে টান দিয়ে রিকশাওয়ালা আবার সেটা মামুনকে দিচ্ছে। এটা চার নম্বর সিগারেট।

একইভাবে বণ্টন চলছে। পতপত করে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। তিনজন ভিজতে ভিজতে মন্ত্রির বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। চলবে