অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ সমস্যা

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৯

শুরুতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে একটা প্রশ্ন, বর্তমান বাংলাদেশে শাড়ি পরে স্বাধীনভাবে চলার মতো নিরাপত্তা কি আছে নারীদের? চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে বাংলাদেশে শুধু ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে বলে জানাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। নারীদের ক্ষেত্রে তালিকা আরো ভয়াবহ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শাড়ি বিষয়ক লেখাটা পড়ার দুর্ভাগ্য হলো। দুর্ভাগ্য বলার কারণ, যেদিন শাড়ি বিষয়ক লেখাটা প্রথম আলোতে প্রকাশ হয় (৩০ আগস্ট ২০১৯) সে দিনটি ছিল ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস’। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিগত কয়েক বছরে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। আসক কর্তৃক বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৯ (জুলাই) পর্যন্ত ৩৪৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছে। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৬০ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৩৫ জন ফেরত এসেছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই তথ্য জানতেন না? প্রশ্ন ফাঁস থেকে ছাত্রদের উপর হামলা, সব ঘটনা উনার জানা, অথচ উনি কিছুই জানেন না। উনি সুন্দরবন চেনেন না, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামও উনার অজানা। মানুষ বিনা বিচারে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে আর উনি আলোকিত মানুষ হয়ে সেই অন্ধকারে আলো না জ্বেলে দেশের তরুণদের শাড়ির যৌনাবেদনের পাঠ দিচ্ছেন। আমাদের মতো তরুণদের মনে সন্দেহ জাগে, এই আলোকিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও কি শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের অন্ধকারে ডুবে আছেন? একজন চিন্তাশীল মানুষ কিভাবে এটা বলেন যে, ‘শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক।’

পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ পোশাক আবার কী! প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্র আলাদাভাবে তাদের পোশাক নির্ধারণ করে। আর শালীনতার প্রশ্ন যদি ওঠে তাহলে বলতে হয়, শালীনতা নির্ধারিত হয় মানুষের অর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে। তাই তার এই বক্তব্য যেমন ভুলে ঠাসা, একইসঙ্গে বর্ণবাদীও।

আলোকিত মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের একটা শ্রেণিতে তার জনপ্রিয়তা আকাশ সমান। উনার মতো সচেতন আলোকিত মানুষের কাছে আমরা তরুণরা কী শাড়ির বর্ণনাই শুনে যাব? এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা অন্যায় হবে? গুম, খুন, ধর্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান অন্যায় অনিয়মের কথা শুনতে চাওয়া কি বেশ বড় দাবি হয়ে যায়? রাষ্ট্রীয় বিষয় এলেই তার সব আলো কি নিভে যায়? এই প্রশ্ন রইলো তার প্রতি।

সায়ীদ লিখছেন, ‘না, সব দেশের মেয়েদের শাড়িতে এমন অপরূপ লাগবে না। পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকার নারী শরীরেই কেবল শাড়িতে এ অলীক রূপ ফুটে ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রিয়দর্শিনী সুকুমারী তন্বীদের দেহবল্লরীতে— সে বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতের— যেখানকারই হোক। বিশালদেহী আফ্রিকার নারীর জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ নারীর উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না। শাড়ি সুকুমার ও নমনীয় শরীরের জন্যই কেবল সত্যিকার অর্থে মধুর। হয়তো উপমহাদেশের বাইরে একধরনের মঙ্গোলীয় নারীকেও শাড়িতে ভালো লাগবে তাদের শারীরিক কমনীয়তার জন্য। কিন্তু পোশাকটি তাদের ভেতর প্রচলিত নয় বলে সে কথায় এখন যাব না। এটি ভালো লাগে বিপুলসংখ্যক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েদের। যদি বাঙালি মেয়েদের প্রশ্ন ওঠে তবে বলব, এটি ভালো লাগে প্রায় প্রত্যেকটি বাঙালি মেয়েকে। সত্যি কথা বলতে কি, অধিকাংশ বাঙালি মেয়েকে শাড়ি ছাড়া আর হয়তো কিছুতেই মানায় না। এ জন্য তাদের প্রকৃতিগত পোশাক—তাদের সহজাত রূপের অংশ।’

সব দেশের মেয়েদের শাড়িতে এমন অপরূপ লাগবে না, এমন কথা আমরা প্রায় শুনি। কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, এই কথাগুলোই আমাদের সংকীর্ণ চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। কাকে অপরূপ লাগবে এবং কাকে অপরূপ লাগবে না, সেটা নির্ভর করে কে কাকে দেখছে। বিষয়টা আপেক্ষিক। শুধু আপেক্ষিকই না একইসঙ্গে ভৌগলিকও। তাই শীতের দেশগুলোতে শাড়ি চল নেই কিংবা মরু অঞ্চলে।

তিনি আর লিখছেন, ‘ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না। তবে মাঝে মাঝে এ দেশেও যে এক–আধজন সুন্দর মুখের দেখা পাওয়া যায় না, তা–ও নয়। তবে একটিমাত্র কারণেই কেবল তা হতে পারে; যদি তারা তাদের কমনীয় শাড়িগুলোকে নান্দনিক বা সুরুচিসম্মতভাবে পরতে পারে। রবীন্দ্র সংগীতের সুরের সঙ্গে রবীন্দ্র সংগীতের অনিন্দ্য কথা যোগ হলে যা হয় আমাদের প্রিয়দর্শিনী ললনারা তখন তা–ই হয়ে যায়।’

সুন্দর মুখ বলতে শুধুই ব্রিটিশদের ফর্সা ত্বক? এ দেশে এক–আধজন না সকলেই সুন্দর মুখের লোক। সারা দুনিয়ার সকল লোকের মুখই সুন্দর। ব্যক্তিগতভাবে কারো কাউকে বেশি সুন্দর মনে হতেই পারে কিন্তু সামগ্রিক যায়গায় সকলেই সুন্দর। আর যদি আমরা সেটা স্বীকার না করি, তাহলে সেই ব্রিটিশ আমলের কথা বলতে হবে অর্থাৎ কালো মানেই কুচ্ছিত! উনার বক্তব্য মতে সুন্দর মুখের যে সংজ্ঞা দাঁড়াচ্ছে, তাতে তো উনিও অসুন্দরের তালিকায় যাবেন, সাথে আমরাও। তাহলে আমরা ত্বক ফর্সা করার ক্রিম মেখে সুন্দর হব ব্রিটিশদের মতো?

এই লেখাতে উনার সবচেয়ে বর্ণবাদী মন্তব্য ছিল এমন, ‘বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমার ধারণা, ‘উচ্চতা’। সবচেয়ে কম যে উচ্চতা থাকলে মানুষকে সহজে সুন্দর মনে হয়—যেমন পুরুষের ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও মেয়েদের ৫ ফুট ৫ বা ৬ ইঞ্চি— আমাদের গড় উচ্চতা তার চেয়ে অন্তত ২–৩ ইঞ্চি কম। দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় মেয়েরা। আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। এরপর তাদের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৫, ৬ বা কিছু পরিমাণে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত উঠলে তা ক্রমাগত অলীকতর হয়ে উঠতে থাকে।”

তিনি আরো লিখছেন, ‘বাঙালি মেয়েদের উচ্চতার অভাবকে আড়াল করে তাদের প্রীতিময় ও কিছুটা তন্বী করে তুলতে পারে একমাত্র শাড়ি। মেয়েরা শাড়ি পরে মাথা বা কাঁধ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। এভাবে শাড়িতে শরীর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেকোনো মেয়ের রূপে কমবেশি দীর্ঘাঙ্গি বিভ্রম দেখা দেবেই, ঠিক যে কারণে দীর্ঘ পাঞ্জাবি বা শেরওয়ানি পুরুষদের শরীরে দীর্ঘদেহিতার বিভ্রম জাগায়। এতে সঠিক উচ্চতার তুলনায় তাদের কিছুটা বেশি দীর্ঘ লাগে। মেয়েদের ব্যাপারেও তা–ই। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মেয়েদের ভুল করে এভাবে মনে হতে পারে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মেয়ে! আর সেই সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী হাইহিলের উচ্চায়ত রহস্য তো রয়েছেই।’

৫ ফুট ৪–এর কম হলে কোনো নারীর শরীরের নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না, এমন অবান্তর বক্তব্যের পিছে তার বৈজ্ঞানিক বা দর্শনগত যুক্তি আছে কি না তা জানা জরুরি। এই প্রশ্নও রইলো। বাঙালি মেয়েদের উচ্চতার অভাবকে আড়াল করতে শাড়ি নয় দরকার জ্ঞানের আলো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস। আর ইউরোপীয় দেশগুলোতে নারীদের গড় যে উচ্চতা, তা বাংলাদেশের নারীদের থেকে অবশ্যই ভিন্ন। তাই উচ্চতাও শেষ পর্যন্ত আপেক্ষিক বিষয়।

সায়ীদের শেষ লাইন দিয়ে আলাপ শেষ করা যায়। উনি বলছেন, ‘আমার মনে হয়, এ রকম একটা অপরূপ পোশাককে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বাঙালি মেয়েরা সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি।’ জনাব, কেউ ঝেঁটিয়ে বিদায় করেনি, বরং শাড়ির স্থান দখল করেছে বোরখা কিংবা পাশ্চত্যের পোশাক। কেন এমনটা হলো? রাষ্ট্র কিভাবে বদলে যায়? ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম, সে বাংলাদেশ কাদের হাত ধরে বর্তমানের এই অবস্থায় পৌঁছলো? কারা রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বলে, প্রতিবাদ না করে তরুণদের শুধুই বই পড়ার জ্ঞান দিয়েছে?

ব্যক্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্য এসব প্রশ্ন না বরং আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছেই এই প্রশ্নগুলো রইলো। যদিও তার উত্তর পাওয়া যাবে না। এসব প্রশ্নকে পাশ কাটিয়েই ‘শাড়ি’র মতো লেখার জন্ম হয়।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও কার্টুনিস্ট