আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘গোধূলির জাদুকর’

প্রকাশিত : মে ০৩, ২০২১

বেশিরভাগ সময় এখন আমি ঘুমিয়ে থাকি। জেগেও থাকি কখনও কখনও। ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে আমি চারপাশ দেখি। কত কত কিছু এই পৃথিবীতে। একই মানুষের ভেতর কত কত মানুষ। কিছু সময় এইসব চেয়ে চেয়ে দেখি, এরপর মনে হয়, এই তো দেখলাম। এইবার ঘুমিয়ে পড়লেই হয়। এইভাবে আবার আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

এইভাবে, ঘুম থেকে জেগে, জেগে থেকে ঘুমিয়ে, এক দুপুরে আমার ঘুম ভাঙে। চকচকে চড়া রোদ চারদিকে। ঘাসবনে শনের মাথায় ওড়াউড়ি করছে ফড়িং। গাছপালার ভেতর থেকে নানা স্বরে পাখি ডাকছে। নরম হয়ে এলো রোদ। উজ্জ্বলতার ছায়া ছড়িয়ে পড়ল ঘাসবনে। উজ্জ্বলতার ছায়া এখন আমার চারদিকে।

আমার ভালো লাগছে আজকের এই দুপুর। নির্জনতার ভাষায় কথা বলতে পারে এই দুপুর। চনমনে অনুভূতি তৈরি হলো আমার ভেতর। উচ্ছ্বলতা। আজ, অনেকদিন পর আমার মনে হলো, ঘুমিয়ে না থেকেও তো পারা যায়। এই রকম একটি দুপুরের মুখোমুখি বসে থেকে সময় পেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু দুপুর তো এক সময় বিকেল হয়ে যাবে, এটাই নিয়তি। এরপর?

এসব ভাবতে ভাবতে আমি ভাবলাম, এইবার আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আর তখন জানলায় একটি মুখ দেখতে পেলাম। মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব। হাসছেন তিনি। জিগেশ করলেন, আবার বুঝি ঘুমিয়ে পড়বে?

আমি জবাব দিলাম না। চেয়ে রইলাম তার চোখের দিকে। সরল দুটো চোখ তার। আমি জিগেশ করলাম, কেমন আছেন?
তিনি বললেন, চলো একটু ঘুরেফিরে আসি। এইভাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্নই তো তো তুমি বহন করে চলেছ। এবার জগৎ-সংসারটাকে একটু ঘুরেফিরে দ্যাখো, ভালো লাগবে।
বলেই তিনি হাসলেন। স্বচ্ছতোয়া হাসি। আমি বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। চারদিকে এত আলো আর শব্দে পূর্ণ যে, আমি আনন্দ পেতে লাগলাম। এই তবে আনন্দ। চারদিকে নানা রকম পাখি ডাকছে। রোদ একটু ঝিমিয়ে এলে হঠাৎ ছুটে আসা ঝিরঝির হাওয়ার ঢেউ কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। আর কাঁপতে কাঁপতে আমি শুনতে পাই ঘুঘুর ডাক। এই ডাকে দুপুরের নির্জনতা ভেঙে ভেঙে পড়ে।

হঠাৎ টের পেলাম, আমি দুলছি। দুপুর ঘুরতে শুরু করেছে। সে ঘুরছে গোধূলির দিকে। ঘুরতে থাকা এই গতি এত দ্রুত যে, হতবিহ্বল চোখে আমি চারদিকে তাকাতে লাগলাম। চারপাশের সবকিছু নিয়েই দুপুর ছুটছে। মির্জা গালিব নির্বিকার। হাসছেন। গোধূলির দিকে ছুটতে ছুটতে আমার কেন যেন মনে হলো, বইতে পড়ে আমি যে গালিবকে চিনি ইনি তিনি নন। তবে এই মানুষই যে আবার মির্জা গালিব তা আমি নিশ্চিত।

আমার চোখের ওপর এখন যে পরদা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানে আমি দেখলাম, বিমর্ষ আর যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত চিহ্ন ফুটে ওঠা একটি মুখ। আর আমি বিড়বিড় করে বললাম, মির্জা, নিজেকে আপনি কুকুরের থেকেও নিচে নামিয়ে এনেছেন যে বোধ থেকে আমাকে এবার তা বহন করতে দিন।

আমি বিড়বিড় করতে থাকি, আমার কেবলই ঘুম পায়। আমার চারদিকে সমুদ্রের সফেন, তবু শান্তি নেই। শান্তি নেই মাথার ওপরে। শান্তি নেই পায়ের নিচে। আমাকে ঘিরে কেবলই ঘুরতে থাকে কারও  ছায়া। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুমের মধ্যেই আমি অনন্ত শূন্যতার শব্দ শুনতে পেলাম। যে শব্দ অক্ষরের শব্দে প্রকাশ করার ক্ষমতা কোনও ভাষার নেই। এই শব্দ মাথার ভেতর নিয়ে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। তারপর জেগে উঠলাম। আমার চারদিকে সময়ের নানা বিলুপ্তির চিহ্ন। কেন জানি না, আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আর বললাম, মানুষ জেগে উঠে যা দ্যাখে, তা যেরকম সত্যি, ঘুমিয়ে যা দ্যাখে, তা-ও সেরকম সত্যি।

আমি উঠে বসলাম। আমার মাথার কাছে পাথরে ঠেস দিয়ে বসে আছেন মির্জা। আমাকে জেগে উঠতে দেখে আর চিৎকার শুনে তিনি একটু ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। বললেন, আশ্চর্য সুন্দর মনে হচ্ছে না তোমার এই জেগে ওঠা?

আমি তাকালাম তার দিকে। আলুথালু তার চুল। নির্বিকার চোখের চাউনি। বললেন, চারদিকে চেয়ে দ্যাখো, বিলুপ্তির কত কত চিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এখন এইসব এক মৃতনগরী। এই নগরী একদিন জীবিত ছিল। মানুষ ছিল। আর সব প্রাণীও ছিল। আনন্দ ছিল। আনন্দে জৌলুশ ছিল। ভোগ ছিল।
আমি বললাম, আর এখন চারদিকে কেবল অনন্ত শূন্যতার ধ্বনি।
হাসলেন তিনি। বললেন, এই ধ্বনির অনুবাদ করতে পারো তুমি?
আমি বললাম, কখনও কখনও। পারি বলতে ঠিক পারি না, কী রকম যেন এসে যায়।

গালিব যেখানে বসে আছেন তার পেছনে গোধূলির রঙ ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। এখানে পাখি নেই। পাখির কিচিরমিচির নেই। তাই গোধূলিকে গোধূলি মনে হলো না আমার।
মির্জা বললেন, যে মানুষ একা হয়ে যায় সে-ই কেবল শুনতে পায় অনন্ত শূন্যতার ধ্বনি। একজীবন ঘুমিয়ে থেকেও তুমি একা হতে পারোনি। পরিপূর্ণ একা হয়ে গেলে মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারে না।
পারে, বললাম আমি। আপনি তো ছিলেন।
তিনি বললেন, হ্যাঁ। পৃথিবীতে কয়েকজন মানুষ তা পারে। আর পারে বলেই পৃথিবী তার ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে।
আমি জিগেশ করলাম, পৃথিবীর ভারসাম্য ব্যাপারটা ঠিক কি?
জবাব দিলেন না মির্জা। চুপচাপ চেয়ে রইলেন দূরে। একসময় মুখ ফেরালেন আমার দিকে।

গোধূলির আশ্চর্য রঙে তাকে মনে হচ্ছিল জাদুকর। কুয়াশা জড়ানো গলায় তিনি বললেন, আমরা যেখানে এখন বসে আছি, এই জায়গাটার নাম সাদুম নগরী। অভিশপ্ত একটি জনপদ। আমি এই ধ্বংসস্তূপ দেখাশুনা করি। দিন-রাত আমার এখানেই কাটে। একা। অনন্ত নিঃসঙ্গতায়।

থত্থর কেঁপে উঠলাম আমি। হযরত লুতের কওম বসবাস করত এই নগরীতে। তারা ছিল সমকামী। এই প্রবৃত্তি পৃথিবীতে প্রকৃতির বিরুদ্ধ। যা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে প্রকৃতি তা ধ্বংস করে ফেলে। আর তাই সাদুম শহরের ওপর আকাশ থেকে নেমে এসেছিল গন্ধক ও আগুনের বৃষ্টি। যখন তা আরম্ভ হয় তখন সূর্য উঠছে। চারদিকে ভোরের রঙ।

এই অভিশপ্ত শহরে এখন আমি বসে আছি। গলা শুকিয়ে এলো আমার। তাকালাম মির্জার মুখের দিকে। জিগেশ করলাম, আপনি এখানে কি করছেন?
নির্বিকার মুখে তিনি বললেন, ওই যে বললাম, এই ধ্বংসনগরী দেখাশুনা করি।

থতমত খেয়ে যায় আমি। তিনি হাসলেন আমার মুখের দিকে চেয়ে। বললেন, তুমি যদি বিশ্বাসী হতে পারো তবে জগতের একটা রহস্য খুলে দেব তোমার সামনে। আর, অবিশ্বাসী মানুষ আসলে জানেই না, প্রতি মুহূর্তে সে নিজের অস্তিত্বই অস্বীকার করে চলেছে।

কথা শেষ করে উঠে তিনি দাঁড়ালেন। গোধূলির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। প্রার্থনার মতো তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি। বেশ কিছু সময় এই রকম দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, জানো তো, সৃষ্টিকর্তা খুব একা।
হ্যাঁ, আমি জানি। বললাম তাকে। অনন্ত মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা তার সর্বময় প্রতিষ্ঠা নিয়েও নিজের কাছে নিজে খুবই একা। বেদনাহত তার নিঃসঙ্গতা। অবশ্যি সব নিঃসঙ্গতাই বেদনাহত।

তিনি বললেন, আমিও নিঃসঙ্গ। অভিশপ্ত এই চরাচরে আমিই কেবল একা একা ঘুরে বেড়াই। ধ্বংসস্তূপ আগলে রাখাই যেন আমার নিয়তি।

হঠাৎ খুব শীত করে আমার। আর ঘুম ঘুম পেতে থাকে। মির্জা গালিব এসে বসলেন পাথরের ওপর। বললেন, তুমি যদি বিশ্বাসী হও তবে বলি, মহাবিশ্বে পৃথিবীর একটা ফটোকপি পৃথিবী আছে। পৃথিবীতে যত মানুষ আছে প্রত্যেকের ফটোকপিও এই জগতে আছে।
কেঁপে উঠলাম আমি। জিগেশ করলাম, এই আমিও আছি ওই ফটোকপি জগতে?
হাসলেন তিনি। বললেন, হ্যাঁ, তুমিও আছো। তবে সেই তুমি জেগে থাকো। আর এই তুমি ঘুমিয়ে থাকো।

একটু থেমে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে তিনি বললেন, তোমাকে দেখে আমার সত্যিই হিংসে হয়। কী নির্বিকারভাবেই না তুমি ঘুমিয়ে থাকতে পারো। একটা জীবন যেন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়া যায়।
বিড়বিড় করে উঠলেন তিনি, স্বপ্ন... স্বপ্ন... স্বপ্ন...
আমি বললাম, এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, বসে আছি মুখোমুখি, এটাও কি স্বপ্ন?
মির্জা মুচকি হাসলেন। বলেন, ধরে নিতে পারো এটাও একটা স্বপ্ন।

আমার এখন আর ভয়টয় কিছু করছে না। নতুন এক জগতে ঢুকতে পেরেছি, এই আনন্দ নতুন এক অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। যা বিস্বয়ের মতো। রোমাঞ্চকর। অভিশপ্ত এক শহরের ধ্বংসস্তূপে বসে আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি। বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই শোনালাম, হাসতে হাসতে রক্তাক্ত হও। রক্তাক্ত হতে হতে হাসতে থাকো।
মির্জা ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে। বললেন, কী, আবার ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
আমি হাসলাম। হাসতে হাসতে বললাম, কবিতা শুনবেন একটা?
তিনিও হাসলেন, শুনি।
আমি আবৃত্তি করতে থাকি :

বৈদ্যুতিক তারের দুটো শক্তিপ্রবাহ
একটি নেগেটিভ
আরেকটি পজেটিভ
পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুরই এরকম দুটো শক্তিপ্রবাহ
মানুষেরও
একটি শক্তি দুঃখ থেকে প্রবাহিত
আরেকটি আনন্দ থেকে

দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেতে কেউ কেউ
আত্মাকে সংযমী করে তোলে
নিষ্কাম সাধনার গূঢ়মন্ত্রে সে দীক্ষিত
পরমের সন্ধানে আনন্দ খোঁজে, যা অজ্ঞেয়
অথচ মানুষের জীবন সুখ আর দুঃখ দুটো শক্তির আয়োজন
কেউ কি এরকম আছে যে, তীব্র আনন্দের মুহূর্তে
তীব্র দুঃখ খোঁজে আনন্দ থেকে পরিত্রাণ পেতে?

পৃথিবীতে জীবনের মানে হচ্ছে,
হাসতে হাসতে রক্তাক্ত হও
রক্তাক্ত হতে হতে হাসতো থাকো।

আমি থামলাম। বেশ কিছু সময় নীরবতা। মাথা নিচু করে বসেই রইলেন মির্জা। একসময় মাথা তুললেন। সূক্ষ্ম হাসির এক রেখা তার ঠোঁটে। জিগেশ করলেন, কার কবিতা?
জবাবে বললাম, আমার লেখা। আপনার মতো আমিও কবিতা লিখতে পারি।

মির্জা বললেন, মানুষের পৃথিবীর বিপরীত আরেক পৃথিবীতে আরেকজন আবু তাহের সরফরাজ আছে। যেরকম আমি যখন জীবিত ছিলাম, আমারও ছিল। আমার নিঃসঙ্গতা-যন্ত্রণা বহন করে বেড়াতো সেই গালিব। সে ভেতরে ভেতরে আমার যন্ত্রণা বহন করে চলত, আর রক্তাক্ত হতো। রক্তাক্ত হওয়ার প্রতিটি মুহূর্তে তাই সে লিখে চলত তার বোধের কথা। এভাবেই যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটে। প্রকাশ ঘটলেই যন্ত্রণামুক্তির আনন্দ সে পেত।
থামলেন মির্জা। কী যেন ভাবলেন। বললেন, এই আনন্দ আছে বলেই আমি বেঁচে থাকতে পেরেছিলাম। আমার সেই বেঁচে থাকা আসলে ছিল আরেক জগতের গালিবের মধ্যে দিয়ে।
কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ পাতালপুরীর নিঃসীম ঘুম এসে আমাকে ডুবিয়ে দিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

ছোট্ট এক কুঁড়েঘর। খড়ে আর পলেথিনে ছাওয়া চাল মাথায় এসে ঠেকেছে। ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে। কী রকম ভেজা ভেজা। ইট দিয়ে এক পায়া ঠেকিয়ে রাখা ভাঙাচোরা একটা টেবিল। টেবিলে রাজ্যের বইখাতা আর ছেঁড়া কাগজ। টিমটিমে কুপি জ্বলছে টেবিলে।

টেবিল লাগোয়া ভাঙাচোরা চৌকিতে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। মুখ নিচু করে তিনি বসে আছেন। গায়ের ওপর ছেঁড়া কাঁথা। বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে। চৌকির তলা থেকে ডাকছে ব্যাঙ। বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন রবীন্দ্রনাথ। কী যেন জানাতে চান তিনি। কিছু বলতে চান।
তার সামনে আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছি। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, আমার সামনে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথ তো অনেক আগেই মরে হেজে গেছেন। এই মানুষটা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ সেজে মানুষকে ধোঁকায় ফেলছেন।

আমরা ফিরে যাচ্ছি। যেতে যেতে আমার মনে হলো, আমি তো স্বপ্ন দেখছি। ফিরতে চাইলাম, বন্ধুরা বলল, কাল আসিস যদি তুই বিশ্বাসী হোস। পরদিন আমি এক বন্ধুকে নিয়ে রিকশা করে রওনা দিলাম। যেতে যেতে রাস্তার পাশেই দেখতে পেলাম একটা মসজিদ। বিস্তৃত তার সীমানা। প্রাচীন স্থাপত্য। বন্ধু বলল, আমি এখানে নেমে পড়ব। তুই রবীন্দ্রনাথ সত্যি না মিথ্যে, দেখে আয়।

আমিও নামলাম। নীরবতা কয়েক শতাব্দী ধরে যেন এখানে বসবাস করছে। শিহরন লেগে যাচ্ছে যত ঘুরছি। ঘুরতে ঘুরতে মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ বিড়বিড় করে কী যেন আমাদের বলতে চেয়েছিলেন। তাকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি বলেই তা শোনা হলো না। আমি বিশ্বাসী হলে রবীন্দ্রনাথ হয়তো সৃষ্টির গূঢ়তত্ত্ব আমাকে বলে দিতেন। অথবা কিছু তো বলতেন, যা আমার অজ্ঞেয়।

ছটফট করে জেগে উঠলাম আমি। চোখ খুলেই দেখি, আমার মুখের ওপর মির্জার মুখ। হাসছেন তিনি। আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, পৃথিবীর সব কাহিনিই বিশ্বাসীদের জন্যে। পৃথিবীর সব সৃষ্টিও তাই। যারা বিশ্বাস করে, পৃথিবীর সব কিছুই তাদের জন্যে।

অনুতাপ আর সন্তাপে আমার মুখ বিবর্ণ। ফ্যাসফেসে স্বরে বললাম, হ্যাঁ, আমিও তাই জানি। কিন্তু ভুলে গেছিলাম। এভাবেই স্খলন হয়। আমি ভুলেই গেছিলাম, ২৭ অক্টোবর ১৯৫৯ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় ছাপা হওয়া খবরটি। খবরটা ছিল এই :

অ্যান্টি প্রোটন আবিষ্কারের জন্য গতকাল দুই মার্কিন বিজ্ঞানীকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এঁরা হলেন, ড. এমিলো সেগ্রে ও ড. ওয়েন চেম্বারলেন। তাদের মতবাদের ধারণা অনুযায়ী, অপ্রাকৃত তত্ত্ব দিয়ে তৈরি আরেক প্রকৃতি রয়েছে। এজগত অণু ও পরমাণু বস্তুকণা দিয়ে তৈরি। আমাদের পরিচিত জগতের গতির পরস্পর বিপরীতমুখী কক্ষপথে এজগত পর্যটন করছে। প্রাকৃত আর অপ্রাকৃত, এই দুই জগতের সংঘর্ষ হলে উভয়ই এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে।

কথা বলতে বলতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব ঘুমিয়ে পড়ছেন। আর এখন তিনি ঘুমোচ্ছেন। গভীর ঘুম। কত কত বছর যেন তিনি ঘুমোন না। কী আশ্চর্য প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে তার ঘুমন্ত মুখে। আমি বসে রইলাম। বসে রইলাম অন্তহীন অন্ধকারে, একা। কয়েকটি ভাবনা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাথার ভেতর। নীরবতার গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে ভাবনাগুলো আমি পড়তে লাগলাম।

বস্তুজগতের সমান্তরালে বিপরীত আরেক জগৎ সৃষ্টি হয়ে আছে। পৃথিবীতে যত সত্তা আছে, ওই জগতেও তত বিপরীত সত্তা আছে। প্রতিটি মানুষের বিপরীত সত্তা ওই জগতে সৃষ্টি হয়ে আছে। আগামীতে যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে, ঠিক ততজনের বিপরীত সত্তা ওই জগতে সৃষ্টি হয়ে আছে। মানুষ যা যা করে, এর সরাসরি প্রভাব ওই জগতে পড়ে। কণিকা জগৎ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞান এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তারা বলছে, বস্তুজগতের সমান্তরালে রয়েছে প্রতিজগৎ।

সূরা আয যুমারের পাঁচ আয়াতে বলা আছে, যথাযথভাবে (প্রতিটি বিষয়ের পরিমাপ ও পরিমাণের অনুপাত ঠিক করে) তিনি সমগ্র মহাবিশ্ব (বস্তু ও প্রতিবস্তুজগৎ এ দুভাগে বিভক্ত করে) সৃষ্টি করেছেন।

সূরা আন নাবার আট আয়াতে রয়েছে, জোড়ায় জোড়ায় আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। এ আয়াতের মানে, পৃথিবীতে যত মানুষ, একই চেহারা ও আকারে তত প্রতিমানুষ রয়েছে প্রতিজগতে।

বিজ্ঞান প্রমাণ করে দেখিয়েছে, বিজড়িত আলোর কণার জোড় থেকে একটি ফোটন কণিকা আলাদা করে দূরে নিয়ে তাকে যদি নাড়াচাড়া করা হয়, তবে অপর ফোটন কণিকাও একইভাবে নড়েচড়ে ওঠে। যদিও তাদের মধ্যে অনেক দূরত্ব। মানুষসহ প্রতিটি বস্তুই মহাবিশ্বে আলোর কণা ফোটন দিয়েই সৃষ্টি।