আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘গোপন কথা, প্রকাশ্য কথা’

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২১

রোদ আর ছায়ার ঝিলমিল রঙে ঘেরা একটি ঘর।
জীর্ণ, তবু তা আছে। ভেঙে এখনও পড়েনি। চৌকির ওপর স্থির বসে আছি আমি। এই ঘরের সংসারী পুরুষ। শুনতে পেলাম, কোথায় যেন ডাকছে ঘুঘু। তার পরপরই কাঠঠোকরা, এবং দোয়েল। এবং ইস্টিকুটুম। দেখলাম, পাখির ডাক কী রকম যেন ঝলমল ঢেউ তুলে বাতাসে ভেসে যাচ্ছে।
আমার ভালো লাগল।
আনন্দ নানা রঙের ঘূর্ণি তুলে নাচতে আরম্ভ করল বুকের ভেতর। ভেসে গেলাম রঙের ঘূর্ণির সাথে। যেতে যেতে দেখলাম, খয়েরি রঙের বৃদ্ধ এক পাতা ঝরে পড়ছে। বুঝতে পারলাম, আজ এই বাঁশপাতার মৃত্যুদিন। আরও বুঝতে পারলাম, পৃথিবীর মৃতপাতাদের মৃত্যুদিন কেউ লিখে রাখে না। মানুষ লিখে রাখে মৃত্যুদিনের আগের মুহূর্তে মৃত্যুদিনের খসড়া। কেবল নিজের, আর কোনও কিছুর নয়। কোনও প্রাণীর নয়।

একটি দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেল আমার বুকের ভেতর। বিড়বিড় করে উঠলাম, সবুজ যে উপায়ে খয়েরি হয়ে যায়, জীবনও সে উপায়ে মৃত্যু হয়ে যায়। ঘরের কোথাও ডেকে উঠল টিকটিকি। এরপর কোনও এক পাখির ডাক। এখানে এত যে পাখি, যেন পাখির সংসার আমার। পাখির সংসার, বেশ তো কথাটা। আমি, বউ আর ছায়াবীথি। এই নিয়ে আমার পাখির সংসার। পাখির ডানায় মমতার যে প্রলেপ থাকে, আমার সংসার ঘিরে সে রকম কিছু একটা আছে।

কখনও কখনও আমার এ রকম মনে হয়। আর মনে হয়, ছায়াবীথি একটা ফুলের নাম। স্নিগ্ধ আর মায়াবী আবরণ ঘেরা একটি ফুল। ছায়াবীথি একটা প্রজাপতি। কী যে আশ্চর্য সুন্দর ছায়াবীথির হাসি, আমি মুগ্ধ হই। যতবার দেখি, ততবার ভালোলাগা কী এক অনুভূতি আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। ছায়াবীথি যখন আধো আধো উচ্চারণে কথা বলে ওঠে, মনে হয় যেন, তার উচ্চারিত প্রতিটি কথাই এক একটি দৃশ্য। ছায়াবীথির হাসি দৃশ্যগুলোতে রঙ ছড়িয়ে দেয়, আর এভাবেই আমার চোখের সামনে একটি দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়।

আয়না তুলে নিলাম হাতে। কবে যেন হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছিল, তা আর মনেও পড়ে না। ভেঙে যাওয়া আয়নার আধেকের কম একটি অংশে ঝুঁকে পড়ে আমি দেখতে লাগলাম আমার মুখ। একটা দেহ আছে। এক রকম আকৃতি আছে, যা মানুষের। এই যে নাক, ঠোঁট, চোখ, চোখের ওপর কপাল, এসব মিলিয়ে আমার মুখ, এই মুখের এক রকম ভাষা আছে। ইঙ্গিত আছে। এই শরীর তবে আমি। বউয়ের যে শরীর আছে, তা তবে তার। ছায়াবীথির যে শরীর, তা আসলে ছায়াবীথির। প্রত্যেক মানুষের যে শরীর আছে তা প্রত্যেক মানুষেরই। শরীর আলাদা তো হৃদয় আলাদা। অনুভূতি আলাদা। প্রাণে প্রাণ তাই মেলে না।

খুব নিমগ্ন এখন দুপুর।
তার ভেতর কড়কড়ে স্নিগ্ধ রোদ। ঝিঁঝিপোকার বিরামহীন ডাক, পাখির শিস, গাছের সবুজ পাতায় হাওয়া লেগে মৃদু ঢেউ নিয়ে পাতাদের দুলে ওঠা, ঘাস আর নানা রঙের ফুলের জগতে ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির নিজস্ব পর্যটন, এ রকম, এ রকম আরও আরও দৃশ্য, রঙ, আর শব্দ নিয়ে দুপুর আছে তার নিজের ভ্রমণে।

নির্জন দুপুর এইখানে স্তব্ধ হয়ে থাকে। এবং ঝিমোয়। তন্দ্রার মতো গভীর আলস্যে ঝিমোই আমি। আমরা দুজন। দুপুর আর আমি। এই সম্পর্কে দুজনের মধ্যে গভীরতর এক সাঁকো আছে। নীরবতার গভীরতর বোধ হচ্ছে এই সাঁকো। বসে থাকতে থাকতে আমি একসময় সাঁকো পেরিয়ে চলে গেলাম। দুপুর খরচোখে হাসল আমাকে দেখতে পেয়ে।
থমকে গেলাম আমি।
দুপুর গম্ভীর।
দেখলাম, তাপীয় বাষ্পের একটি আবরণ দুপুরকে ঘিরে। আর তার ভেতর রঙের অভাবিত এক জগৎ। নদী আছে। গাছপালা আছে। পাখি আছে। নদীতে মোহন সুন্দর রোদ এসে পড়েছে। চিকচিক করছে নদীর জল। একটি মাছরাঙা জলের দিকে মুখ নামিয়ে চেয়ে আছে খুঁটির ওপর বসে। ঝিরঝির হাওয়া বয়ে যাচ্ছে গাছপালার ওপর। পাতা কাঁপছে।
আর, কত কত শব্দ একটা দুপুরের ভেতর।

বললাম, আমি আমার জগৎ থেকে তোমার জগতে যোগাযোগ ঘটিয়েছি। আমি নিশ্চিত, তুমি চেয়েছিলে বলেই আমি ঘটাতে পেরেছি।

দুপুর যেন মেনে নিল, এ রকম ভঙ্গিতে হাসল। এরপর বলল, হ্যাঁ। মানুষের জগৎ আমাকে কী রকম যেন টানত। সেই টানটাই বুঝি ছুটে গেছে তোমার দিকে। এবং তোমাকে নিয়ে আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে। বেশ তো তবে, এসো...
এরপর সখ্য হলো দুজনের।
কথা বলল। অনেক অনেক কথা। গোপন কথা। প্রকাশ্য কথা। কথা বলতে বলতে একসময় আমি বলল, চলো গোধূলি দেখে আসি।
দুপুর থমকাল।
বললাম, তোমাকে সাথে নিয়েই আমি গোধূলি দেখতে চাই।
দুপুর জানতে চাইল, কেন?
যেহেতু এই মুহূর্তে আমার আর তোমার সৌন্দর্যের একটা জগৎ তৈরি হয়ে গেছে। আমরা মিলে গেছি প্রাণে প্রাণে।
দুপুর বলল, কিন্তু বিকেল টপকে কী আমি যেতে পারব গোধূলির কাছে?
বেশ তো, তবে যোগাযোগ ঘটাও বিকেলের সাথে।
সে কী আর ঘটালেই ঘটানো যায়। যেভাবে ঘটে গেল তোমার আর আমার মধ্যে। বলেই হাসল দুপুর।

জীবনে কতবার আমি চেয়েছি, প্রাণে মিলে যাওয়া প্রাণকে নিয়ে গোধূলি দেখতে যাব। প্রাণে প্রাণ বুঝি তাহলে মেলে না। কাতর হলো আমার আত্মা। জখম হলো।
যন্ত্রণার রেখা নানা ভঙ্গিতে ভেসে উঠল আমার মুখে। তাকালাম দুপুরের দিকে। চোখে জলজ মেঘ। দুপুর চেয়ে রইল আমার দিকে বেশ কিছু সময়। এরপর বলল, চলো তবে... দেখাই যাক কতটা পথ পেরোলে তাকে পথিক বলা যায়।
শঙ্খের আনন্দঢেউ বুঝি কেউ ছড়িয়ে দিল আমার বুকে।

আমার দুজন, আমি আর দুপুর যাচ্ছি গোধূলি দেখতে। যেতে যেতে পথে, সামনে পড়ল নদী। নদীর স্বচ্ছ জলে চেয়েই আমি চমকে উঠলাম। বিকেলের করমচা রঙের রোদ টলটল করছে।
আতঙ্কিত স্বরে আমি ডেকে উঠলাম, দুপুর?
নিরুত্তর।
দুপুর?
শব্দহীন।
প্রদীপের শেষ নিশ্বাসের মতো আবারও ডেকে উঠলাম, দুপুর তুমি কোথায়... য়... য়...

একটা ঢেউ হাহাকার ছড়িয়ে দিয়ে ছুটে গেল দিগন্তে। দুপুর কোত্থাও নেই। তবু কোথাও আছে যেন মৃন্ময়ী দুপুর। আমার ভেতর কাতরতা। আমার ভেতর হাহাকার। শরীর যেন ভেঙে আসতে চাইছে। কাঁপছে হাতপা।

কী রকম নিঃসঙ্গতা, মৃতের মতো নিঃসীম নিঃসঙ্গতা আমাকে স্থির থেকে স্থিরতর করে তোলে। যেন আমি পাথর। ভার আছে, প্রাণ নেই। মন্ত্রচালিতের মতো আমি হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি সংসারে। বউ চুল বাঁধছিল বসে মাটির দাওয়ায়। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল আমার দিকে চোখ রেখে।
বললাম, তেষ্টা পেয়েছো। একটু পানি দ্যাও।
বউ কথা বলল না। তবে আবারও হাসল কী রকম যেন চোখে।

বউয়ের পাশে গিয়ে আমি বসলাম। এবং বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। দেখলাম, একটা দুপুরের ভেতর থেকে রিপা একটা একটা করে নদীফুলপাখি লতাপাতাঘাস আলাদা আলাদা করে ফেলছে।
আমার ঝিমুনি পায়। আমি ঝিমোতে থাকি। কাঁপতে থাকে আমার পৃথিবী। অসাড় হয়ে যায় দেহ। তন্দ্রার মতো দুলতে দুলতে আমি ভাবতে লাগলাম, রিপা খাতুন মায়াবিনী কীনা। আমি তো জানি নারী, কিন্তু এবার জানতে হবে মায়াবিনী কীনা। ঢুলতে থাকি আমি। অতলান্তিক অন্ধকার থেকে যেন আমি উচ্চারণ করলাম, তুমি কি মায়াবিনী?
কথা নেই, তবে খিলখিল হাসির ধ্বনি মুখর হয়ে ওঠে চারদিকে।
তুমি কি রিপা খাতুন?
কথা নেই। হাসি নেই। নীরবতা।

নীরবতার এই ভাষা আমি বুঝতে পারলাম। এবং বুঝতে পারলা,, এইবার আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এই শূন্যতায়, এই হু হু হাওয়ায়, শরীর ফুরফুরে হয়ে যাওয়া শূন্যতায়।
তবু, ঘুমিয়ে পড়ার আগে ষড়যন্ত্রমূলক স্বরে আমি জিগেশ করলাম, তোমাকে আমি চিনতে পারছি না কেন?

মায়াবিনী বলল, মায়ার ইন্দ্রজালে যে মানুষ থাকে তাকে চেনার চোখ কী জগৎ-সংসারে কারও থাকে? থাকে না বলেই তো মায়াবিনী হয়ে ওঠে প্রতিটি নারী। মায়াবী হয়ে ওঠে প্রতিটি পুরুষ।

হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম একটা সেতু। ঝুলন্ত সেতু, যেন শূন্যের ওপর দুলছে। আর তার একদিকে গোধূলির রঙ ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। কত কত যে পাখি সেই সেতুর ওপর, কেবলই কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে দিচ্ছে শূন্যতা। সেতুর নিচে তিরতির বয়ে যাওয়া ছিপছিপে নদী। টলটলে সিঁদুররঙা তার জল।

ধীরে ধীরে আমি পৌঁছে গেলাম সেতুর ছবির জগতে। রঙচক্রে দীর্ঘ পর্যটন শেষে আবার ফিরে এলাম ঘর-গেরস্তে। রিপা খাতুন সেতুর নিচে বয়ে যাওয়া টলটলে নদীর ঢেউ দেহে নিয়ে চুমু খেল আমাকে। বলল, আমি তোমার জন্যে, কেবলই তোমার স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখে অপেক্ষায় আছি।

জিগেশ করলাম, কতকাল বসে আছ তুমি এইভাবে?
রিপা খাতুন বলল, দীর্ঘ বছর। পাঁচ বছর হতে পারে। হতে পারে দশ বছর।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, কারও কারও জীবন থেকে সারা জীবনও পেরিয়ে যেতে পারে।

বসলাম ঘরের দাওয়ায়। শেষ বিকেলের সিঁদুররঙা নরম রোদ ছড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। রিপা খাতুন ছিল উঠোনে দাঁড়িয়ে। হাসছিল। হঠাৎ দেখলাম, রিপার হাসি থেকে কী রকম যেন রহস্য ছড়িয়ে পড়ছে। কেঁপে উঠলাম। কাঁপতে কাঁপতে জিগেশ করলাম, তোমার শরীরে দীর্ঘ এই বছরে আর কার কার স্মৃতি তুমি বাঁচিয়ে রেখেছো রিপা খাতুন?
বউ হাসতে থাকে।
আবারও জিগেশ করলাম, তোমার হৃদয়ে দীর্ঘ এই বছরে আর কার কার স্মৃতি তুমি বাঁচিয়ে রেখেছো হে?
রিপা খাতুন কথা বলে না। গোপন যন্ত্রণার মতো আমার বুকের ভেতর থেকে উঠে এলো, উহ!

রিপা খাতুন বলল, দেহ সম্ভোগের অনুভূতি প্রাণিমাত্রই এ রকম তীব্র যে, তা প্রাণীর চাহিদা। তবে আমি একজন মাত্র পুরুষের দেহ সম্ভোগ করেছি তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে।

ঝিমোতে থাকি আমি। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ভাঙন হচ্ছে কোথাও। ভাঙনের শব্দ হচ্ছে। বিস্ফোরক শব্দ। শব্দের ভেতর আলাদাভাবে শুনতে পেলাম, বউ বলছে, সম্ভোগ স্মৃতি আমি তোমার জন্যে লিখে রেখেছি। এই নাও।

ঘুম ঘুম চোখে ঘুমের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে আমি তখন ডুবতে আরম্ভ করেছি। এরপর অন্ধকার। অন্ধকারে নানা রঙের ছায়াশরীর। অন্ধকারে নানা রঙের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। রঙের নানা রকম আঁকিবুঁকি অন্ধকারে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। আলোর রেখা ছায়ার শরীর হয়ে ওঠে। এই আরেক জগৎ।

শব্দ ওঠে। মিহি শব্দ। ভারি শব্দ। ছায়াশরীরের চিৎকার। ফিসফাস কথাবার্তা। শুনতে পেলাম, খুব মৃদু শব্দের ঢেউ তুলে পাঠকাঠির বেড়া কাটছে উঁইপোকা। শুনতে পেলাম, একটি তক্ষক পাখির ডাক। দেখতে পেলাম, রিপা খাতুনের ছায়াশরীর ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। এই দৃশ্য আমার বুকের ভেতর হাহাকার ছড়িয়ে দিল।

এরপর দৃশ্য এবং শব্দের ভেতর দিয়ে আমি যেতে লাগলাম। যেতে যেতে এসে দাঁড়ালাম একটা পাহাড়ের পাদদেশে। বিস্ময়ে নিশ্বাস থমকে গেল বুকের মধ্যে। বিচিত্র রঙের নানা পাখি এই পাহাড় ঘিরে। পাহাড় যে, বোঝাই যায় না। যেন পাখির পাহাড়। ছোট ছোট সব পাখি। নানা রকমের রঙ শরীরে। পাহাড় ঘিরে ওড়াউড়ি করছে তারা। হেঁটে বেড়াচ্ছে পাদদেশে। আমার পায়ের কাছ দিয়ে। পাহাড়চূড়া দেখাই যায় না, কেবলই নানা রঙের পাখির নড়াচড়া চোখে পড়ে। কিচিরমিচির শব্দে চারদিক মুখর।

ভালোলাগা ঝিরঝির ঢেউ আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। চেয়েই রইলাম বিপুল বিস্ময়ের মতো দৃশ্যমান এই দৃশ্যের দিকে।
কী এক ঘোরের মধ্যে থেকে শুনতে পেলাম পাখির ভাষা। পাখির ছোট্ট বুকের ধুকপুক। ডানার ফরফর শব্দ।

বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে একসময় বিহŸল হয়ে ওঠে আমার ভেতর। বিহ্বল একজন মানুষ ফিরতে থাকে সংসারে। শর্ষে ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে থাকি। শর্ষে ফুলের মৌতাত ছড়ানো গন্ধ মাতাল করে তোলে আমাকে। আনন্দে বিহŸলতায় হাত বোলায় শর্ষে ফুলে। টুপ করে ঝরে পড়ে একটা ফুল। তুলে নিই। আর তখন দেখলাম, ছেড়ে আসা পাহাড়ে যে পাখি দেখেছিলাম, এখানেও তার কয়েকটা পড়ে আছে। মৃত। পাখিগুলোর মাথা নেই। গলার কাছটায় রক্ত জমাট হয়ে আছে।
মুহূর্তে টলে উঠল আমার পা। মাতালের মতো বিড়বিড় করে উঠলাম।

লাল ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে বসে আছে আলের ওপর। এ রকম মায়ামাখা টলটলে মুখ ছায়াবীথি ছাড়া আর কারও আমি দেখিনি। কী নিষ্পাপ আর স্নিগ্ধ এই মুখ। তবে এই মুহূর্তে মেয়েটির নিষ্পাপ মুখচ্ছবির ভেতর ক্রুরতার একটা ছায়া পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের ধারারো ছুরি দিয়ে পাখির গলা কাটছে। পাখিরা পালিয়েও যাচ্ছে না। বরং দেখে মনে হলো, পাখিগুলো যেন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলা কাটার অপেক্ষায়। একটা একটা করে তারা এগিয়ে আসছে। আর মেয়েটি মাথাটা আলাদা করে পাখির দেহটা ছুঁড়ে দিচ্ছে শর্ষেক্ষেতের ভেতর।

হঠাৎই কী রকম যেন অন্ধকার হয়ে এলো চারদিকে। কারা যেন ফিসফাস করছে। মনে হলো, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে কোথাও। এখানে আর আমি নিরাপদ নই। কিন্তু যাব এখন কোথায়? অন্ধকারে ফিকে আলোর নানা ছায়াশরীর ছোটাছুটি করছে। সামনে। পেছনে। ডানে। বামে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে। রক্তের বৃষ্টি। লাল লাল বৃষ্টি। পাখি পাখি গন্ধ এই বৃষ্টির। কাতর ধ্বনি বৃষ্টিপাতের।

কাতরতা ছড়াতে থাকে আমার ভেতর। হাঁটতে থাকি। দৌড়োতে থাকি। হাঁপাতে থাকি আমি। বুক ঢিবঢিব করে। তেষ্টা পেতে থাকে।

দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার সামনে গাছপালায় ঘেরা নির্জন একটি কুঁড়ে। অবাক বিস্ময়ে কুঁড়েটার দিকে আমি চেয়ে রইলাম। রাত্রি গভীরতার দিকে যাত্রা করেছে। রাতের নিজস্ব সুললিত শব্দে চারদিক মুখর। ওপরে রুপোর থালার মতো ঝকঝকে চাঁদ। নরম আর উজ্জ্বল এক রকম আলো চারদিকে। গাছপালার ছায়া ছায়া আলো-অন্ধকারের ভেতর থেকে ডেকে যাচ্ছে পাখি। কী যেন কাতরতা স্বরে। ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি। হঠাৎ হঠাৎ ঝিরঝির হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে উঁচু উঁচু গাছপালা।

স্নিগ্ধতা কেবল চারদিকে। এই অন্ধকারে। চাঁদের রহস্যময় দেহে। আশ্চর্য কুহক ছড়ানো একটা দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি স্থির হয়ে যাই। চেয়ে থাকি কুঁড়ের দিকে। টিনের একচালা। চারদিকে পাটকাঠির বেড়া। উঁই ধরে বেড়ার বেশিরভাগ অংশ খসে খসে পড়েছে। হতশ্রী মানুষের হতশ্রী ঘর। আমি তো একজীবনে এরকম হতশ্রী মানুষই হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এরকম হতশ্রী ভেঙেপড়া নির্জন একটি ঘরে ঘুমোতে। জেগে থাকতে।

আমার বুকের ভেতর মুগ্ধতার একটা নদী বয়ে যেতে থাকে। মাথার ভেতর চাঁদের আলোয় ঘুমিয়ে থাকা ভেঙেপড়া একটি ঘর। এই এক মুহূর্ত। জীবন-যাপনের আর কোনও কিছুই আমার মনে পড়ে না। কারও মুখ মনে পড়ে না। আমি মানুষ কীনা, তাও তার আর মনে থাকে না। তবে মনে থাকে, আমি একটি প্রাণ। এই পৃথিবীর মুগ্ধ একটি প্রাণ। মুগ্ধ প্রাণে চেয়েই থাকি কুঁড়ের দিকে। ভালো লাগে। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এই যে মুহূর্ত পেরিয়ে যাচ্ছে, এই সময়টাতেই আমি বেঁচে আছি পৃথিবীতে। এর আগে বেঁচে ছিলাম না। এরপরও বেঁচে থাকব না।

কুঁড়ের ভেতর থেকে নিশ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছে। গভীর ঘুমের মধ্যে থেকেই মানুষ এরকম নিশ্বাস ফেলে। ডেকে উঠলাম, কেউ আছেন ঘরে... কেউ কী আছেন...
কেঁদে উঠল একটি শিশু। একটি নারীর স্বর শোনা গেল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলছে, উঁ-উঁ, এই তো... নে, খা।
এরপর চুকচুক শব্দ। শিশুটি মায়ের বুক চুষতে থাকে।
ডেকে উঠলাম আবার, কেউ আছেন ঘরে?
নারীকণ্ঠ হতচকিত। ভাঙা ভাঙা শব্দে ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে এলো, কে?
জবাব দিলাম, আমি একজন মানুষ।
নারী বলে, এখানে কাকে চান?
কাউকে না। দরজাটা একটু খুলুন। এই ঘরে আমি থাকতে চাই। এই ঘরে আমি ঘুমোতে চাই।
জবাব নেই। একটু সময় পর দরজা খুলে যায়।
থমকে গেলাম আমি।
থমকে গেল নারী।

আমি দেখতে পেলাম রিপা খাতুনকে। রিপা খাতুন দেখতে পেল আমাকে। ঘরের ভেতর কেঁদে উঠল ছায়াবীথি। বউ বলল, ঘরে এসো।
ফুরফুরে হাওয়া ছুটে গেল আমার ভেতর। বললাম, এই তবে আমার ঘর! এতদিন কেন জানতে পারিনি, বলো তো বউ?
বউ হাসে।
আমি তো একজীবনে এরকম একটি ঘরেই বেঁচে থাকতে চেয়েছি।
বউ জবাব দিল, বেঁচে তো আছই।
কেঁদে ওঠে ছায়াবীথি, দুদ্দে... দুদ্দে...

বউ ঢুকে যায় ঘরের মধ্যে। আমিও পা রাখলাম চৌকাঠে। এরপর হঠাৎ কী রকম যেন এলোমেলো হয়ে গেল মাথার ভেতর। শব্দের গুঞ্জন শুনতে পাই। কোত্থেকে যেন ভেসে ভেসে আমার কাছে চলে আসছে শব্দ। শব্দের ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে ভেতর। প্রকাশ পেতে চায় শব্দেরা। শব্দেরা ছটফট করে। ছটফট করতে থাকি আমিও। এরপর জেগে উঠি। মাথার ভেতর সার বেঁধে কয়েকটি বাক্য দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম, এই বাক্য তবে শব্দ প্রকাশের বাহন। শব্দেরা শরীর চায়। শব্দেরা প্রাণ চায়। কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম।

বারুদের গন্ধে লোবানের গন্ধে স্থির হতে হতে হারিয়ে ফেলি পথ
পথের অনেক ঠিকানা। এপথে সেপথে ওপথে যারা গেছে
তারা কেউ লিখে যায়নি পায়ের ক্লান্তির কথা
আমার পায়ে শেকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে
কারও সাথে যেতেও পারছি না আমি
যার সাথে যাব সে তো ডাকাত, পথে আমার
সর্বস্ব লুট করে নেবে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
একটি বাড়ি দেখলাম নারী দেখলাম পুকুরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে হাঁস
আর তখন গন্ধ পেলাম বারুদের
ঘুম ভেঙে গেলে গন্ধ পেলাম লোবানের

ঘুমের ভেতরে যে আমি, সে কে?
দাঁড়িয়ে রয়েছি যে আমি, সে কে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য
বারুদ আর লোবান আমাদের প্রতিবেশী
প্রতিদিন গন্ধ পাই যাতায়াত পথে।

লেখা শেষ হয়ে গেলে চেয়ে রইলাম অক্ষরগুলোর দিকে। কী জ্বলজ্বলে এক একটি অক্ষর। যেন চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি কী এই অক্ষরগুলোর প্রাণদাতা? কোথায় থাকে অক্ষরের প্রাণ, আমি তো তা জানি না। তবে কোথায় পেলাম এদের? এখন আমার সামনে একটি কবিতা।
আমিই কী লিখেছি এই কবিতা?
এই যে এখন বসে আছি একটি কবিতার মুখোমুখি, কে এই মানুষ? কিছু সময় আগে যে ছিল, সে-ই বা কে?