আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘মাওলানা’

প্রকাশিত : মে ১২, ২০১৯

ঝকঝকে নরম বিকেল। আসর নামাজ শেষ হয়েছে একটু আগেই। আসরে আজ মুসল্লি হয়েছিল পাঁচজন। গতকাল আসর নামাজে মুসল্লি এসেছিল চারজন। এর আগের দিন... মাওলানা আবুল খায়ের গড়গড় করে গত একসপ্তাহের প্রতিটা নামাজে কত মুসল্লি এসেছিল, তা বলে দিতে পারে। সে হিসেব রাখে। স্কুলমাঠে পাকসেনারা ঘাঁটি গাড়ার পরদিন থেকে মসজিদে মুসল্লি কমতে শুরু করেছে। নীরিহ গ্রাম। লোকজন ভয় খেয়ে গেছে। আলহাজ্ব চৌধুরী আকমল হোসেনও নামাজে ঠিকমতো আসছেন না। কিন্তু তিনি তো ভয়খাওয়া লোক নন? হজ করে এসেছেন তিনবার। মসজিদের জায়গাটাও তারই দান। গ্রামের একমাত্র পয়সাঅলা লোক। তার এক হাঁকে গ্রামবাসী এক জায়গায় জড়ো হয়। সেই লোক যদি ভয় খেয়ে মসজিদে আসা বন্ধ করে দেয়, তবে গ্রামের লোকজনের আর কীই বা দোষ!

মসজিদের পাশে নদী। শীতলক্ষ্যা। গ্রামের পেট কেটে চলে গেছে দক্ষিণে। বেশ চওড়া নদী। তীরে গাছপালা। মসজিদের পেছনে নদীর ঢালুতে একটা বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে নদীতে নামার সহজ পথ। পাঁচ ওয়াক্ত এ ঢালুপথে নেমেই মুসল্লিদের অজু করতে হয়।

টিনের একচালা মসজিদঘর। চারদিকের বেড়াও টিনের। দরজাটা অবশ্যি বাঁশের চাটাইয়ের। মাটির মেঝে। তার ওপর পাটি বেছানো। পাটিতে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছে মাওলানা। বেশ মিষ্টি তার কণ্ঠস্বর। দরদ ভরা। আর পড়েও সে হৃদয় দিয়ে। পড়তে পড়তে তার চোখ ভিজে ওঠে। ঝাপসা চোখ মুছে নেয় পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে। এরপর আবার পড়তে আরম্ভ করে।

ইন্নামা তুন জিরু মানিত তাবায়াজ জিক্্রঅ খসিয়ার রাহমানা বিল গয়িব। ফাবাসসিররু বি মাগফিরাতিউ অ আজরিন কারিম... (তুমি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারো যে উপদেশ মেনে চলে, এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে। অতএব তুমি তাকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের সংবাদ দাও।)

বাইরের মাঠে একটা গরু হাম্বা হাম্বা ডেকেই যাচ্ছে। সেদিকে ভুরুক্ষেপ নেই মাওলানার। তার সবটুকু মনোযোগ এখন কোরআনে। নদীর পাড়ের গাছপালায় পাখিদের হট্টগোল। হঠাৎ গুলির শব্দ। হঠাৎ অনেক মানুষের আর্তচিৎকার।

থেমে যায় তেলাওয়াত। মাওলানা দেখল, মসজিদ মাঠের গরুটা হাম্বা ডাক ছাড়তে ছাড়তে খুঁটার দড়ি ছিঁড়ে দৌড় দিয়েছে। পাখিদের হুড়োহুড়ি লেগে গেছে গাছে গাছে। তাদের ডানার ঝটপটানি বেড়ে গেছে। কিচিরমিচিরও। বুক ধক করে উঠল মাওলানার। হায় আল্লাহ, আলামত তবে আরম্ভ হয়ে গেছে!

কোরআন ভাঁজ করে সে এসে দাঁড়ালো মাঠে। উত্তরদিকের আকাশ ঢেকে গেছে আগুনের কালো ধোঁয়ায়। দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা উঠছে ওপরের দিকে। বুক কাঁপতে থাকে মাওলানার। ঠকঠক কাঁপে পা। বুক শুকিয়ে আসে। ও খোদা, এ কী গজব তুমি নামাইলা এই বঙ্গদ্যাশে? উত্তরদিকে পালপাড়া। গ্রামের হিন্দু এলাকা। লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ... বিড়বিড় করতে থাকে মাওলানা। চেয়ে রইল উত্তরদিকের আকাশে। মানুষের আর্তচিৎকার মাওলানার খুব ভেতরে গিয়ে বিঁধছে। তবু নির্বিকার সে। কী করতে পারে সে? হায়েনা যখন এগিয়ে আসে, তার সামনে কে দাঁড়াবে? মন খারাপ হয়ে যায় মাওলানার। খুব বেশি মন খারাপ হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে নদীর ঢালু ধরে নামতে থাকে। কড়াই গাছের উঁচু শেকড়টার ওপর বসে। বসেই থাকে। কোনো কিছু দ্যাখে না। শোনেও না। যেন তার ভেতর কোনো দৃশ্য নেই। কোনো শব্দ নেই। এভাবে বসে থাকতে থাকতে একসময়ে তার খেয়াল হয়, সন্ধে হয়ে আসছে। তাই তো, মাগরিবের আজানের সময় হয়ে গেল। মাওলানা উঠল।

মাগরিবে আজ মুসল্লি হলো তিনজন। আয়নাল শেখ, আক্কাস আলি আর খাঁ বাড়ির আজমল বুড়ো। মাওলানার হিসেবে দ্যাখা যাচ্ছে, এরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেই আসছে। এদের বাইরে দু’একজন কমছে-বাড়ছে। নামাজ শেষ হলে আজমল খাঁ বলল, দেখলা মৌলানা, গজব নাইমা গেছে। হিন্দুগো বাড়িঘর পোড়াইলো। এইবার পোড়ইবো আমাগো ঘরদোর। দেইখা নিও তুমি। ওগো দিয়া কোনো বিশ্বাস নাই। আক্কাস আলির মুদি দোকান আছে হাটখোলা বাজারে। সে মুদি-দোকানির মতোই তাই বলল, আরে না চাচা, পাকসেনারা মুসলমান মারবে না। ওরা মুসলমান। ওরা মাইরা ফিনিস কইরা ফেলবে হিন্দুগো। শালারা তো মালাউন।

আবুল খায়ের কিছু বলে না। একটু বিরক্ত হয়। মানুষকে পুড়িয়ে মারছে আরেক মানুষ, আর এরা মসজিদে বসে খুঁজছে মানুষের জাত! হত্যার কি কোনো জাত আছে? মৃত্যুর কি কোনো জাত আছে? কে বোঝাবে কাকে? মাওলানা চিমনি খুলে হারিকেন জ্বালাতে বসে যায়। এরপর রেহালের ওপর কোরআন খুলে বসে। মুসল্লি তিনজন বেরিয়ে যায়। আবুল খায়ের পড়তে থাকে, আউয়ুজু বিল্লাহ হিমিনাশ শয়তানির রহিম, বিসমিল্লাহ হির রহমানুর রহিম... এইটুকু পড়ার পরেই পানিতে তার চোখ ভিজে উঠল। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছল। দরজার বাইরে চুপচাপ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। চারদিক নীরব। মানুষের আর্তচিৎকার এখন আর নেই। কোথায় গেল অতগুলো মানুষ? মরে গেছে? পালিয়ে গেছে? হারিয়ে গেছে? কতজন মরেছে? কতজন পালাতে পেরেছে? কতজন শিশু তার মাকে হারিয়েছে? কতজন স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে? কতজন স্বামী তার স্ত্রী-সন্তান হারিয়েছে?

এতসব কিছু মাওলানা তো জানে না। এ হিসেব অনেক জটিল। মাওলানা এ হিসেব কষতে পারে না। সে হিসেব রাখতে পারে মুসল্লিদের। এ হিসেব অনেক সহজ। মাওলানা মানুষ হিসেবেও সহজ। সহজ মানুষ, সহজ হিসেব।

একটু শুয়ে পড়া দরকার। শরীরটা কী রকম ভার ভার ঠেকছে। মনে হলো মাওলানার। কোরআন ভাঁজ করে বাঁশ দিয়ে বানানো তাকে রেখে ঘরে এলো সে। মসজিদের গা-ঘেঁষে তার ঘরটা। এটাও টিনের। ছোটটো একটুকরো ঘর। একটা টেবিল-চেয়ার আর একটা চোকি ছাড়া ঘরে তেমন কিছু নেই। বাঁশের খুঁটির সাথে দড়িতে ঝুলছে জামাকাপড়। চোকির পাশে ইটের ওপর একটা কেরোসিন স্টোভ। এই হলো মাওলানার সংসার। একার সংসার। আগে প্রতিদিন গ্রামের এক একটা  বাড়ি থেকে খাবার আসত, কিন্তু এ প্রথাটা মাওলানার আত্মসম্মানে খুব লাগে। তাই সে চৌধুরী সাহেবকে বলেছিল, গ্রামের সব বাড়ি থেকে প্রতিমাসে কিছু টাকা তুলে দিতে। এটা ওই খাবারের বদল। এরপর থেকে মাওলানা নিজেই রেঁধে খায়। আর মাঝে মধ্যেই তার দাওয়াত পড়ে চৌধুরী বাড়িতে। সে-বেলা রান্নাবান্নার ঝামেলা তার আর থাকে না।

নিজের এই ঘর, এই ছাপড়া সমজিদ, নদী, গাছপালা— এ সবকিছুই মাওলানার ভালো লাগে। সারাদিন কী নির্জন চারদিকটা! এই পরিবেশে মাওলানা বুকের ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। প্রকৃতির সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার ফলে যে কারো ভেতর এক রকম আধ্যাত্ম অনুভূতি কাজ করে। মাওলানারও করে। দিনের বেশিরভাগ সময় তার কেটে যায় কোরআন-হাদিস পাঠে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, দিনে এক-দু’বেলা রান্না আর ভোরে মক্তব পড়ানো। এই তো হলো গিয়ে তার কাজ। কিন্তু এখন মক্তবও নাই। পাকসেনারা আসার পর থেকে ছেলেমেয়েরা এমুখো আর আসে না।    

চোকির ওপর শুয়ে থাকতে থাকতে একটু ঘুমমতো এসেছিল, হঠাৎ বাইরে হারিকেনের আলো। কে যেন এসে দাঁড়ালো দরজার মুখে। মাওলানা জিগেশ করল, কে?
আমি মোবারক হুজুর।
মাওলানা উঠে এলো, কিছু বলবা মোবারক?
চদ্রিসাব আপনেরে ডাইকা পাঠাইছেন। রাইতে আপনের দাওয়াত। ওনার সাথ খানা খাইবেন। উনি কয়া পাঠাইলেন।
ঠিকাছে, যাও। এশার নামাজটা পড়ে আমি আসছি।

মোবারক চলে গেল। এশার নামাজে মুসল্লি এলো দুজন। আয়নাল শেখ আর আক্কাস আলি। ফরজ পড়ে তারা চলে গেল। আবুল খায়ের একা একা দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ল। এরপর হারিকেন হাতে বেরিয়ে পড়ল।

বারান্দায় চোকির ওপর বসে ভাত খাচ্ছে মাওলানা ও চৌধুরী সাহেব। সামনে মোবারকত দাঁড়িয়ে আছে। যদি কিছু দরকার পড়ে! খেতে খেতে চৌধুরী সাহেব জিগেশ করলেন, ভয় পাইছো মৌলানা? মাথা তুলল মাওলানা। বুঝতে পারল না কীসের ভয়ের কথা তিনি বলছেন। জিগেশ করল, কীসের ভয়?

এই যে পাকবাহিনী হিন্দুগো বাড়িঘর জ্বালাইয়া দিল। শোনো, ভয় পেয়ো না। তারা আমাদের কিছু করবে না। তারা এদেশে আসছে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। তারা মুসলমান মারবে না।

এক ঢোঁক পানি খেয়ে মাওলানা বলল, কিন্তু তারা মুসলমানদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গুলি করে মেরে ফেলছে এ দেশের মুসলমানদের। এটা তো মিথ্যে না চাচাজি।
অবশ্যই মিথ্যে না। কিন্তু তুমি আমারে কও তো মৌলানা, এ দেশের কয়জন মানুষ মুসলমান? শুধু মুসলমান নাম থাকলেই মুসলামন হয় না। বিশ্বাস লাগে, বুঝলা? ঈমান। যার ঈমান নাই সে মুসলমান না।
এইটা আপনি ঠিক কইলেন না চাচাজান। পাকসেনারা এই দ্যাশে ইসলাম নিয়া আসে নাই। তারা আইছে এই দ্যাশ দখল করতে।
চৌধরী সাহেব পানির গেলাস হাতে তুলে নিয়ে বললেন, মৌলানা, তুমি হজ্ব করছ?
জি না, করিনি। হজ্ব করার ক্ষমতা আমার নাই।
দু’ঢোঁক পানি খেয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখলেন চৌধুরী সাহেব। এরপর বললেন, শোনও মৌলানা, তুমি হজ্ব করো নাই। তুমি করছ মৌলানা পাশ। আমি তোমার মতো মৌলানা পাশ করি নাই। আমি করছি হজ্ব। তুমি জানো, ইসলামের পাঁচটা স্বম্ভের মইদ্যে হজ্ব একটা। ঠিক কীনা?
মাওলানা ঘাড় নাড়ল, জি ঠিক।
তুমি মৌলানা, আমি হাজি। তফাৎ কি? কোনো তফাৎ নাই। শোনো মৌলানা, আমার মরহুম আব্বাজান ছিলেন তোমার মতোই মৌলানা পাশ। তার ইচ্ছা ছিল, আমিও মৌলানা পাশ দিই। মাদ্রাসায় পড়লামও কয়েক বছর। এরপর ছাইড়া দিলাম।
মাওলানা জিগেশ করল, ছেড়ে দিলেন কেন?
সে আরেক কিসসা। অত কথার কাম নাই অহন। কথা হইতেছে, পাকসেনারা যা শুরু করছে তাতে আমাদের একটা কিছু তো করতে হবে। নাকি হবে না?
মাওলানা মাথা দোলালো, জি, করতে তো হবেই। কিন্তু কি করবেন?
এ এলাকার শান্তি রক্ষা করতে হবে।
কীভাবে শান্তি রক্ষা করবেন? পাকসেনারা কি আপনার কথা শুনবে?

চৌধুরী সাহেব বলতে থাকেন, আমরা শান্তিকমিটি গঠন করছি। পাক-ভাইদের সাথে মিলেমিশে এলাকার শান্তি হেফাজত করব। এইটা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব, বুঝলা?
মাওলানা কথা বলল না। খাওয়া শেষ করে চিলুমচিতে হাত ধুয়ে ফেলল। মোবারক দৌড়ে গামছা এনে দিল।
চৌধুরী সাহেব বললেন, ওকি মৌলানা, খাওয়া শ্যাষ কইরা দিলা? কিছুই তো তুমি খাইলা না। নাকি আমার কথা তোমার পছন্দ হইতেছে না?
না-না চাচাজি। মাওলানা গামছায় হাত-মুখ মুছতে মুছতে বলল, মনটা খুবই ভার। খিদা নাই।
যা অবস্থা, তাতে খিদে থাকারও কথা নয়। একটু থেমে ফের বললেন চৌধুরী সাহেব, মৌলানা পাশের সঙ্গে হজের যে তুলনা আমি করছি, সেইটা ঠিক হয় নাই। আমি জানি, তুমি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, সারাক্ষণ থাকো কোরআনা-হাদিস নিয়া। তুমি অন্যরকম। তোমার ভেতর জ্ঞানও আছে। এইটা আমার পছন্দ। যে জানে আর যে জানে না, তারা দুজন কখনোই এক হইতে পারে না। তুমি জানো, আমি অতকিছু জানি না। কিন্তু আল্লাহ-নবির প্রতি ভক্তি রাখি। আমি জানি, মানুষ মাইরা ফ্যালানো কোনো বৈধ কাজ হইতে পারে না। কিন্তু বোকার মতো মরাও কোনো কাজের কথা নয়। যতই মুক্তি মুক্তি করো, পাকসেনাদের মুখোমুখি অরা টিকতে পারবে না। এরচে সমঝোতা করা কি নবির সুন্নত নয়?
মাওলানা বলল, কিন্তু চাচাজান, এটা তো ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ। কোনোভাবেই জিহাদ নয়। তবে কেন আমরা হত্যাকারী দখলদারদের সঙ্গে হাত মেলাবো?

হাত ধুতে ধুতে চৌধুরী সাহেব বললেন, পরিস্থিতি খারাপ, বুঝলা মৌলানা? এখন বাতাস বুঝে থুতু ফেলতে হবে। কত পরিশ্রম কইরা এই বাড়িঘর, জমিজিরেত করেছি। এখন সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে তো যেতে পারি না। আর, প্রাণের মায়া বলে একটা কিছু তো আছে। শোনো মৌলানা, তুমি সৎ মানুষ। নিষ্ঠাবান মুসলমান। এইটা আমি জানি। আর জানি বলেই তোমারে আমি পছন্দ করি। এ জামানায় তোমার মতো ভালো মানুষ দুর্লভ। আমার ইচ্ছা আছে, যুদ্ধটুদ্ধ থাইমা গেলে মসজিদটা আমি পাকা কইরা দিব। পাশে তোমারও একটা পাকা ঘর থাকবে। এখন তোমার বয়েস অল্প। বিয়ে থা করো নাই। ভবিষ্যতে করতে হবে।
আমি বলি কি, তুমি শান্তিকমিটিতে যোগ দ্যাও। সবদিক মিলায়া এইটা আমি বিবেচনা করছি। বাকিটা এখন তোমার ইচ্ছা।
দেখি ভেবেচিন্তে। আমি এখন তাইলে উঠি চাচাজান... মাওলানা উঠতে যাবে এমন সময় চৌধুরী সাহেব বলে উঠলেন, এখুনি যাবে কি? চলো একটু স্কুলমাঠটা ঘুরে আসি।
মাওলানা জিগেশ করল, সেনাদের ওখানে?
কেন, ভয় পাচ্ছ নাকি যেতে?
না, ভয় আমি পাই না। ঠিকাছে, চলেন।

প্রায় পাঁচ-ছ’টা হ্যাজাক জ্বলছে স্কুলঘরটার সামনে। দিনের মতো আলো ঝকঝক করছে। দূর থেকে চোখে পড়ল মাওলানার। মাঠের যত কাছাকাছি হচ্ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে মেয়েদের চিৎকার। তাদের বুকভাঙা কান্নার আওয়াজ জোরালো হয়ে উঠছে। তাঁবুর সামনে বসে ছিলেন কর্নেল আফসার হামিদি। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে মাওলানা এসে দাঁড়ালো সেখানে। স্কুলঘরে আটকে রাখা হয়েছে মেয়েদের। ঘরটার সামনে দুই সেনা রাইফেল হাতে পায়চারী করছে। ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করছে, কেউ কাঁদছে হাউমাও করে। কেউ আবার রাগে ফুঁসে উঠে দিকবিদিক তাল হারিয়ে চিৎকার করে বলছে, গুলি কর কুত্তার বাচ্চারা, আমারে গুলি কর। আয়, ঝাঁঝরা করে দে আমার বুক।
বাইরের এক সেনা থেকে থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে রিফলভারের নল দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, খামোশ রাহো, নেহি তো গুলি কার দেঙ্গে।
ডান হাতের আঙুল কপালে উঠল চৌধুরী সাহেবের, আসলালামু আলাইকুম কর্নেল সাব।
চৌধুরীকে দেখে ডান হাতটা একটু উঁচিয়ে কর্নেল সম্ভাষণ জানালেন, হ্যালো মি. চৌধুরী। বাইঠিয়ে। আপকা সাথ ও কৌন হো?
ইয়ে হে মৌলানা, সাব। হামারা গাঁওকা মসজিদ কা ঈমাম। বহুত বুজুর্গ আদমি হ্যায়। পড়নেঅলা।
কর্নেল নজর করে দেখলেন মাওলানাকে। গুড, ভেরি গুড। বাইঠিয়ে মাওলনা।

কর্নেলের সামনে তিন-চারটে চেয়ার পাতা ছিল। চৌধুরী সাহেব মাওলানাকে ইঙ্গিতে বসতে বলে বসলেন একটা চেয়ারে। মাওলানাও বসল।
এতক্ষণে মাওলানার চোখে পড়ল, পালপাড়া থেকে শুধু যুবতী কয়েকটা মেয়েকেই এরা লুঠ করে আনেনি, কয়েকটা গরু-ছাগলও এনেছে। স্কুলঘরের বারান্দায় প্রাণীগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে। এর মানে, প্রতিদিন এদের উৎসব হবে। মাংসের উৎসব!
চৌধুরী সাহেব বললেন, কর্নেল সাব, আজকা অপারেশনমে গাঁওকা আদমি সব তো ডরেহুয়ে হ্যায়। গাঁওকা আদমি সবকে সব শামকে পাহলেহি দরোজা-জানালা বন্ধ কার দিয়া।
কর্নেল বললেন, হুম, হামলোক মুসলমানো পার হামলা নেহি কারেঙ্গে। হামলোগ মুক্তি জো হ্যায়, উসি পার হামলা কারতে হ্যায়। আওর কাফেরু পার হামলা কারতে হ্যায়।
হা সাব, ও তো হামে জানতে হ্যায়। গাঁওকা আদমি ইয়ে তো নেহি সামঝতে। তো আপ ইস পার নেহি ঘাবড়াইয়ে। হামারা শান্তি কমিটিকা বহুত আদমি হ্যায়, ও সামভাল লেঙ্গে। কেহ গাঁওমে মুক্তিযোদ্ধা ঘুছনে না ছাখে উসপার চৌকান্না রাহে গা। আপ ফাকাৎ ইস গাঁওকা মুসলমানো পার হামলা নাহ কিজিয়ে। এহি মেরা আরজু হ্যায়।
মাটিতে বুটের গোড়ালি ঠুকতে ঠুকতে কর্নেল বললেন, ঠিক হ্যায় চৌধুরী। আপকা বাত মানলিয়ে। লেকিন নেহি মুক্তি, সামছে? এ হে পাকিস্তান হ্যায়।
জি কর্নেল সাব, এ হ্যায় পাকিস্তান। ইসলামিক তমদ্দুন হ্যায়। ইসলিয়ে হামারা শান্তিÍকামিটি লাগে হুয়ে হ্যায়। ইসলাম বলান্দ রাখনে কে খাতির।

মাওলানা চুপচাপ বসে আছে। স্কুলঘরের বারান্দায় একটা ছাগল ম্যাঁ ম্যাঁ ডাক ছাড়ছে। ম্যাঁ ম্যাঁ মানে কি মা মা? কে জানে! মাওলানা জানে না। মাওলানার এখানে আর ভালো লাগে না। কী কী যেন সব বলে যাচ্ছে চৌধুরী আর কর্নেল, সেসব তার কানে ঢোকে না। তার কান কেবল শুনতে পায় দরজার ওপাশে মেয়েদের বাঁচার আকুতি। একসময়ে চমক ভাঙে চৌধুরী সাহেবের কণ্ঠস্বরে, কাল তো জুম্বাবার, নাকি মৌলানা?
মাওলানা মাথা নাড়ল, জি।
কর্নেলকে চৌধুরী সাহেব বললেন, ইয়ে কর্নেল সাব, কালহি ম্যায় ছবকো সাথ সমঝায়েঙ্গে। উছ ছবকো বলদেঙ্গে, মুক্তি নজরায়ে তো আপকো খবর দেগা।
কর্নেল বললেন, ঠিক হ্যায় চৌধুরী। তুম হ্যায় সাচ্চা মুসলমান। লেকিন এক বাত, এই বলে মাওলানার মুখের দিকে তাকালেন কর্নেল। একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন। এরপর বললেন, কুছ পাহলে চৌধুরী বোলা, তুম পড়হিলিখি আদমি হু। তো মুঝে এক মছয়ালা বাতাইয়ে। আজ হামলোগ হিন্দু লোগুকা ছাবকেছব জ্বালা দিয়া। আওর মালামাল ছবকে ছব লুঠ লিয়া। আওরোতু কো লে আইয়ে। ইসলামমে কা-বোলে? এ ঠিক হ্যায় না কিয়া?
মাওলনা কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, নেহি।
চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন কর্নেল। কিয়া বলতা তু? তুম মুক্তি হ্যায়? ইয়ে চৌধুরী, ইয়ে মাওলানা মুক্তি হ্যায়?

চৌধুরী সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত নেড়ে বললেন, নেহি নেহি সাব। ইয়ে মাওলানা মুক্তি নেহি হ্যায়। ইয়ে আদমি সাচ্চা মুসলমান হ্যায়।
কর্নেলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, তো আভিহিতো বোলা কেহ এ ইসলামকা জিহাদ নেহি। কাফির অর মুশরিককা মাল তো ইসালাম হালাল কিয়া। এ তো গনিমতকা মাল হ্যায়।
মাওলানা বলল, নেহি কর্নেল সাহাব, এ গনিমতকা মাল নেহি। এ লুঠকা মাল হ্যায়। আপলোক ফাকাৎ কাফেরুকো নেহি মারতে, মুসলমানো কোভি মারতে হ্যায়। ইসকো আপ জিহাদ সামাছতে হ্যায়?
সামনের টেবিলে চাপড় মেরে কর্নেল বলল, আলবাত জিহাদ। হামলোগ ইসলামিক হুকুমাত বলান্দ রাখনেকে খাতির লাগেহুয়ে হ্যায়।             
মাওলানা এবার বলল, তো ছুনলিয়ে কর্নেল সাহাব, হযরত আবু হোরাইরা ছে রেওয়ায়েৎ হ্যায়, আউর নবিজি ফরমায়ে, জো ইসলামকি এত্তেবাকি তো উসকো হালাক কারনা, আলবাৎ ও আল্লাহকা জিম্মা নেহি মানতে।
কর্নেল ঠাস করে রিভরভার তুললেন মাওলানার বুক বরাবর। বলে উঠলেন, এ হে মুক্তি হ্যায়, নাহি ছাড়–ঙ্গা।

মাওলানা উঠে দাঁড়ালো। তার কি পা কাঁপছে? বুক ঢিবঢিব করছে? মাওলানা বুঝতে পারল না। তবে তার মনে হলো, ওই ট্রিগারটা একটু টেনে দিলেই সে আর বেঁচে থাকবে না।
চৌধুরী সাহেব ভয় খেয়ে গেছেন। ফ্যাসফেসে স্বরে বললেন, ইয়ে কর্নেল সাব, এ আদমি মুক্তি নেহি। সাচ্চা মুসলমান। মেরা বাত এতেবার কিজিয়ে।
কর্নেল ভারি গলায় বললেন, ঝুট হ্যায়। এ হে মুক্তি।
চৌধুরী সাহেব আগের মতোই ফ্যাসফেসে স্বরে বলে উঠলেন, নেহি কর্নেল সাব, মৌলানা নওজোয়ান আদমি হ্যায়। ইসলিয়ে খুন গরম হ্যায়। আপ ছকুন রাহে, হাম দেখতে হ্যায়।
কর্নেল এবার চৌধুরীর বুক বরাবর রিভলভার তাক করলেন। বললেন, তুম মুক্তি হ্যায়?
এবার আর কই যায়! চৌধুরী সাহেবের পা টলে উঠল। এই বুঝি গুলি করে দ্যায়। কাঁপা কাঁপা স্বরে তিনি বললেন, নেহি সাহাব, ম্যায় পিস কমিটিকা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব চৌধুরী আকমল হোসেন। সাচ্চা মুসলমান। হামারা বাপভি সাচ্চা মুসলমানথা।
হুম, বলে রিভলভার নামিয়ে কর্নেল বসলেন। বললেন, ছুনো মাওলানা, কালকা খুৎবায় তুম বয়ান কারোগি, হামারা লড়াই ইয়ে হ্যায় জিহাদি লড়াই। এ লড়াইমে জো হামারে সাথ রাহেগা ও মুসলমান হ্যায়। হামলোগ উসপার হামলা নেহি কারেঙ্গে। জো মুক্তি হ্যায় উসকো হাম মারেঙ্গে। আওর কাফেরুকো।
মাওলানা কথা বলছে না দেখে চৌধুরী সাহেব বলে উঠলেন, আলবাৎ বয়ান করেগা। এরপর মাওলানার দিকে চেয়ে বললেন, এই মৌলানা, চুপ কইরা আছো ক্যান? কও, বয়ান করবা। কও মিয়া।
মাওলানা কথা বলে না। কর্নেল হুংকার ছাড়েন, এ হে মেরা হুকুম।

চৌধুরী সাহেব বললেন, জি কর্নেল সাব, জুম্বামে মৌলানা বয়ান কারেগা। বোলেগা, ইয়ে হ্যায় ইসলামি হুকুমাতকা লড়াই হ্যায়। কী মৌলানা, সহজ কথা সহজ কইরা বুঝায়া দিবা। নাদান গ্রামবাসী, তেমন কিছু অরা বুঝে না।
কর্নেল কঠিন মুখে চেয়ে আছেন মাওলানার দিকে। বুট দিয়ে পায়ের নিচের মাটি ঠুকছেন। ওদিকে একটা মেয়ে দরজায় ধপাধপ লাথি মারছে। সেনা দুজন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদের শান্ত রাখতে চেষ্টা করছে। আর চেঁচিয়ে বলছে, অ্যাই চোউপ! অ্যাই চোউপ! গুলি কার দেঙ্গে।
কিন্তু ঘরের ভেতরে চুপ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
চৌধুরী সাহেব বললেন, তো কর্নেল সাহাব, ইজাজত দিজিয়ে। হামলোগ চালে। মাটিতে বুটের গোড়ালি ঠুকতে ঠুকতে কর্নেল বলল, ঠিক হ্যায় চৌধুরী, আয়ো। লেকিন এক বাত, মেরা হুকুম ইয়াদ রাখনা।
ঘাড় নাড়ায় চৌধুরী সাহেব, জরুর সাহাব, জরুর। আসসালামু আলাইকুম। এই মৌলানা, চলো।
মাওলানা আর একবার চারদিক চেয়ে দেখল। বিভীষিকা। এই স্কুলঘরটা এখন একটা বিভীষিকা। হাঁটতে আরম্ভ করলেন চৌধুরী সাহেব। মাওলানা দেখল, কর্নেলের থমথমে মুখ। শুনলো, দরজার ওপাশ থেকে মেয়েদের কান্নাকাটি। চিৎকার।
বারান্দায় ছাগলটা এখনো ডেকে যাচ্ছে।
পা বাড়ালো মাওলানা।

স্কুলমাঠটা পেরিয়ে এসেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন চৌধুরী সাহেব। দু’হাত ওপরে তুলে মোনাজাত ধরলেন, হে আল্লাহ, হে পরোয়ার দিগার, তোমার দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া। সিংহের থাবার নিচ থেইকা তুমি আমাদের বাঁচায়া নিয়া আসছো। আমরা নাদান বান্দা। ভুলত্রুটি হইলে মাফ কইরা দিও হে পরোয়ার দিগার। আমিন।
মাওলানা আমিন বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল চৌধুরী সাহেবের পাশে। চৌধুরী সাহেব বললেন, এই মৌলানা, কও আমিন। আল্লাহ হুম্মা আমিন, কও।
মাওলানা বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহ হুম্মা আমিন।
চৌধুরী সাহেব মাওলানার মুখে দিকে চেয়ে জিগেশ করলেন, কি মৌলানা, পারবা না খুৎবায় কথা বলতে? মানুষরে বোঝানো খুবই সহজ। তুমি যা কইবা, মুসল্লিরা তা-ই বিশ্বাস কইরা নিব। তুমি শুধু মাথায় রাখবা, তুমি যা করছ তাতে গ্রামের শান্তি রক্ষা হবে। তুমি চাও না গ্রামের মানুষ জালিমদের হাত থেইকা রক্ষা পাক?
মাওলানা জবাব দিল, জি চাই চাচাজান। কিন্তু কোরআন-হাদিস বিকৃত করে অন্যায়কে ন্যায় বলে রায় দেয়া যে মহা অপরাধ। আমি এই অপরাধ ক্যামনে করি, আপনেই কন।
চৌধুরী সাহেব বললেন, জান বাঁচানো ফরজ, এইটা জানো তো? তুমি সহজ কথায় মুসল্লিদের কইবা যে, পাক-ভাইরা যা করছে তা ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্যই করছে। এজন্য যে লুটপাট করা হচ্ছে, তা আসলে লুটপাট নয়। তা গনিমতের মাল। যে মেয়েদেও তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারাও গনিমতের মাল। তারা বিধর্মী। তাই তাদের সাথে এই আচরণ।
মাওলানা বলল, কিন্তু চাচাজান, পালপাড়ায় তারা যে আগুন ধরিয়ে দিল, মেয়েদের ধরে এনে আটকে রেখেছে, এসব কীভাবে আমি সমর্থন করব? কী বলব মুসল্লিদের? লুণ্ঠনের মালামাল গনিমত হয় কোন বিচারে? এরা নিজেদের ক্ষমতা দখলের জন্য ইসলামের নাম ভাঙাচ্ছে।
চৌধুরী সাহেব বললেন, চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
হাঁটতে হাঁটতে তিনি জিগেশ করলেন, তাইলে তোমার এখন কি বিবেচনা? কি ঠিক করলা?

মাওলানা জবাব দিল, আমি এখনো জানি না। তবে আমি জানি, অন্যায়ভাবে আরেক দেশ ও সম্পদ অধিকারের উদ্দেশ্যে যে যুদ্ধ হয়, তা জিহাদ নয়। তা অন্যায় যুদ্ধ।
চৌধুরী সাহেব জিগেশ করলেন, জিহাদ তবে কি মৌলনা?
মাওলানা বলল, স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত করাই জিহাদ। এখানে অস্ত্রধারণ করতে হবে শুধুমাত্র আল্লহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। এ দেশের হিন্দুরা তো মুসলমানদের ধর্মীয় বিরোধিতা করছে না।  বরং হিন্দু-মুসলমান এ দেশে মিলেমিশে বসবাস করছে যুগ যুগ ধরে। পাকসেনারা শুধু হিন্দু মারছে না, মুসলমানদেরও গুলি করে মারছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড কীভাবে জিহাদ হয়, বলুন?
কথা বলতে বলতে মসজিদের কাছাকাছি তারা এসে পড়ল। চৌধুরী সাহেব বললেন, যাও মাওলানা। আর যা বললাম, ভাইবা দেইখো। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা কইরো, কী করবা আর! পড়েছো মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে। শোনো মৌলানা, তুমি আমারে চাচাজান ডাকো। আমিও তোমারে ভাতিজার মতোই ¯েœহ করি। আমি চাই, তোমার কোনো ক্ষতি না হোক।
মাওলানা জিগেশ করল, সত্যি কন তো চাচাজান, আমি যদি কাল খুতবায় ওদের পক্ষ নিয়া বয়ান করি, তাইলেও কি অরা আমাদের ছেড়ে দেবে?
অত ভাইবো না, মৌলানা। এ কারণেই আমরা শান্তিকমিটি গঠন করছি। বিষয়টা আমরা দেখতেছি। এখন যাও, আমিও চললাম। টর্চ হাতে এগিয়ে চললেন চৌধুরী সাহেব। মাওলানা এসে ঢুকল ঘরে। হারিকেন জ্বেলে টেবিলের ওপর রেখে সে শুয়ে পড়ল চোকির ওপর।
শুয়ে থাকতে থাকতে এই প্রথম মাওলানা ভয় পেল। কীরকম যেন মুত্যুর ভয়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার বুক বরাবর তাক করা আছে রিভলভার। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যু। মুত্যুকে সঙ্গে নিয়ে নির্জন ঘরে শুয়ে রইল মাওলানা। এই প্রথম নির্জনতাকে তার ভয় লাগতে লাগল। এর আগে কখনো একরম হয়নি। আজ হচ্ছে। উত্তরদিক থেকে কি মানুষ পোড়ার গন্ধ ভেসে আসছে? কই? মাওলানা জোরে দু’বার নিশ্বাস নিল। মরাপোড়ার গন্ধ তো পেল না। ঘরের ভেতর কে যেন নিশ্বাস নিচ্ছে। কী রকম ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মাওলানার। ঝট করে উঠে হারিকেন তুলে নিল হাতে। জিগেশ করলেন, কে? ঘরে কে?
সাড়া নেই।

মাওলানা হারিকেন হাতে চোকির ওপর থ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। কী মনে হওয়ায় লাফ দিয়ে নেমে চোকির নিচে উঁকি দিল। এবং চমকে উঠল। একটা মেয়ে। ড্যাবডেবে চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। ঠকঠক করে কাঁপছে। ঠকঠক কাঁপার মতো শীত এখন নয়। তবু সে কাঁপছে। কিন্তু মেয়েটি ওখানে গিয়ে লুকিয়েছে কেন? মাওলানা জিগেশ করল, কে তুমি?
মেয়েটির গলার ভেতর থেকে উঠে এলো কান্না। তবে তা চাপাস্বরে। মুখে হাত দিয়ে রেখেছে সে। মেয়েটা কি তবে পালপাড়ার, আজ বিকেলেই যাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে? মাওলানা বলল, তুমি ভয় পেয়ো না বইন। বেরিয়ে এসো। এখানে তোমার কোনো বিপদ নাই।
মেয়েটা এবার দু’হাত বাড়িয়ে মাওলানার দু’পা ধরে বলল, আপনে আমারে বাঁচান হুজুর, দোহাই আপনের আল্লা-রসুলের। আমি হিন্দু। পাকসেনারা আমারে পাইলে ধইরা নিয়া যাবে।
মাওলানা জিগেশ করল, তুমি কি পালপাড়ার মেয়ে?
পা জড়িয়ে ধরেই মেয়েটি জবাব দিল, জি হুজুর।
পা ছাড়ো। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। এখানে তোমার কোনো ভয় নাই। তুমি শান্ত হয়ে একটু বোসো। উঠে আসো। এই চোকির ওপর বসো। কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটি উঠে এলো। মাওলানার মনে হলো, বছর পনেরো হবে বয়েস। পরনের জামা ছিঁড়ে ফালি ফালি হয়ে গেছে। কাদামাটি মাখামাখি হয়ে দেখাচ্ছে ভাতের হাঁড়ি মোছার ত্যানার মতো। বিধ্বস্ত মেয়েটার চোখমুখ। শরীরও যেন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ। বিধ্বস্ত। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
মাওলানা দড়ির ওপর থেকে একটা চাদর পেড়ে মেয়েটাকে বলল, এইটা ন্যাও। গায়ে জড়ায়া চোকিতে গিয়া বসো।
মেয়েটা কাঁপা কাঁপা হাতে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়ালো। কিন্তু বসল না।
কী হলো, বসো। বললাম তো, তোমার ভয় নাই। আমাদের নবিজি নারীজাতিকে খুবই সম্মান করতেন। আমি একজন মাওলানা। নবির সুন্নত অনুসরণ করি। আমারে তোমার ভয় নাই।
মাওলানা দেখল, মেয়েটির পা টলছে। শরীরও কাঁপছে খুব। যেন কোনো মুহূর্তে ধপাস করে পড়ে যাবে। অতি কষ্টে যেন ভেতরের কান্না ভেতরেই আটক রেখেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাওলানা বলল, বসো বইন, বললাম তো এইখানে তোমার কোনো ভয় নাই।
মেয়েটা চোকির ওপর বসল। কিন্তু মাওলানা বসবে কোথায়? সে দাঁড়িয়ে রইল। চুপচাপ কাটল কিছু সময়। মেয়েটি চাদরে মুখ ঢেকে বসে বসে কাঁদছে। মাওলানা জিগেশ করল, তোমার নাম কি?
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা জবাব দিল, সুলেখা।
মাওলানা বলল, শোনো সুলেখা, তোমার তো খিদে পেয়েছে। তাই না?
সুলেখা কথা বলল না। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মাওলানা হাঁড়িতে চাল নিয়ে তিনবার পানিতে ধুয়ে ফেলল। এরপর স্টোভ জ্বালালো। ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে দিল তার ওপর। এরপর ছোট চাকু দিয়ে আলুর খোসা ছাড়াতে লাগল টেবিলের ওপর। ভাতের ভেতর আলু সেদ্ধ দেয়া হবে। দুপুরের একটু ডাল আছে, গরম করে নিলেই হবে।
সুলেখা চাদরের ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ দেখছিল এসব। সে আর এখন কাঁদছে না। তবে শরীরটা অবশ লাগছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝি এখুনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে। সারাদিনের বিভৎসতার কোনো ছবি সে আর ভাবতে চায় না। ভুলে থাকতে চায় মৃত্যুকে। কিন্তু তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মায়ের পুড়ে মরার দৃশ্য। ছোট ভাইটা এখন কোথায়? বাবা? বেঁচে আছে? নাকি পুড়ে মরেছে? আর ভাবতে পারে না সুলেখা। ভেতরটা ভারি হয়ে আসে। চোখ বুজে বাঁশের খুঁটির সাথে মাথাটা একটু হেলিয়ে দিল সে।

খেতে বসে সুলেখা জিগেশ করল, আপনে খাবেন না হুজুর?
মাওলানা জবাব দিল, না। রাইতে আমি চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খাইছি। তুমি খাও।

প্রথম লোকমা মুখে তুলতেই হেঁচকি উঠে এলো সুলেখার। মাওলানা তাড়াতাড়ি পানির গেলাস এগিয়ে দিল। পানি খেয়ে ভাতের থালার দিকে চেয়ে বসে রইল সুখেলা। মাওলানা বলল, কি হইল, খাও।
সুলেখা বলল, জানেন হুজুর, ওরা আমাদের ঘরে আগুন ধরায়া দিল। আমার চোখের সামনে দেখলাম, বড়ঘরে মা পুইড়া যাইতেছে। চিৎকার করতেছে। চারদিকে আগুন। মানুষের দৌড়াদৌড়ি। আমি তহন দৌড়াইয়া মুরগির খোঁপে ঢুইকা পড়লাম। গ্রামের যুবতী মাইয়াদের ওরা ধইরা নিয়া গেল। ছোট ভাইটার কথা খুব মনে পড়তেছে। ও কি মরছে না বাঁইচা আছে, জানি না। জানি না, আর কখনো দেখতে পাব কীনা।
কথা শেষ করতেই ঝরঝর পানি ঝরতে লাগল তার দুচোখ বেয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাওলানা। বলল, কেঁদো না সুখেলা। ভাত খাও।
দু’লোকমা খেয়ে আর খেতে পারল না সুলেখা। মাওলানার চোখের দিকে তাকালো। মাওলানা বলল, না খেতে পারলে খেয়ো না। হাত ধুয়ে ফ্যালো। সুলখার দিকে হাত ধোয়ার বাটি এগিয়ে দিল মাওলানা।
কাঁপুনি একটু কমেছে সুলেখার। কিন্তু হাহাকার লাগছে। এই মাওলানার এখানেও সে নিরাপদ নয়। মাওলানা লোক ভালো, এতক্ষণে এটা সে বুঝেছে। কিন্তু শেষরাইতের নামাজে লোকজন আসবে মসজিদে, তখন? মাওলানাকে দেখল সুলেখা, মানুষটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাকল, হুজুর, আপনে বসেন।
মাওলানা বলল, আমার বসতে হবে না সুলেখা। তুমি একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো। আমাকে কিছু বিষয় ভাবতে হবে।
কি বিষয়?
তোমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়েও। আজ জুম্মাবার। জুম্মার খুতবায় আমাকে পাকসেনাদের কুকীর্তিকে ইসলামি জিহাদ বলে বয়ান করতে হবে। আর যদি তা না করি, তবে তোমার মতো আমারও বিপদ। আমরা দুজনই আসলে এখন একজন। আমাদের সামনে মৃত্যু। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।
সুলেখা জিগেশ করল, আপনে কি ঠিক করছেন?
মাওলানা বলল, আমি এখনো কিছু ঠিক করি নাই। কী করব তাও বুঝতেছি না। এদিকে ফজরের ওয়াক্ত আগায়া আসতেছে। কথা বলতে বলতে সুলেখার মুখের দিকে তাকালো মাওলানা। সুলেখা চেয়ে আছে তার দিকে। চোখমুখ ফোলা ফোলা। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। তবু কোথায় যেন একটা লাবণ্য আছে মেয়েটার, মাওলানার মনে হলো। সুলেখার ওপর থেকে সে চোখ সরিয়ে নিল।
সুলেখা জিগেশ করল, আপনের মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নাই? অরা কই থাকে?
মাওলানা আবার সুলেখার দিকে চোখ ফেরালো। বলল, আমার কেউ নাই সুলেখা। আমি এতিমখানায় মানুষ হয়েছি। সেখানকার মাদ্রাসায় পড়েছি।
আর কিছু জিগেশ করল না সুলেখা। চুপচাপ বসে রইল।
মাওলানার মুখেও কথা নেই। গভীর রাত। বাঁশঝাড়ের ওদিক থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। নদীর দিক থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে রাতজাগা পাখির ডাক। আর কোনো শব্দ নেই। কেবল নির্জনতা। বসে থাকতে থাকতে মাওলানা দেখল, সুলেখা খুঁটির সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাওলনারও একটু ঘুমঘুম ভাব এসেছিল। চোকির এককোণে বসে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে তার মনে হলো, ফজরের সময় বুঝি হয়ে গেছে! টিনের সাথে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে চেয়ে সে দেখল, সাড়ে চারটে। আজান দিতে হবে। কিন্তু সুলেখা? সে তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আজানের পর তো মুসল্লিরা আসবে। ওরা এসে দেখবে, একটা মেয়ে মাওলানার ঘরে চোকির ওপর ঘুমোচ্ছে। ফজর নামাজে আজ কে কে আসতে পারে? ভাবতে ভাবতে মাওলানা নামল চোকি থেকে। হারিকেনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। বাতাস একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে ঢালু বেয়ে মাওলানা নেমে পড়ল ঘাটে। ওজু করতে হবে। বাঁশের খুঁটির সাথে কাঠের তক্তা পেরেক দিয়ে ঠুকে বানানো হয়েছে ঘাট। তক্তার ওপর পা রাখতেই ভূত দ্যাখার মতো চমকে উঠল মাওলানা। একটা লাশ। ঠেকে আছে তক্তার সাথে। দেখে মনে হচ্ছে, পুরুষ মানুষ। বিকৃত হয়ে গেছে দেহ। হঠাৎ মৃত্যুর গন্ধ পেল মাওলানা। লাশ পচার গন্ধ পেল। মাথার ভেতর টলোমলো করে উঠল তার। দ্রুত পায়ে ফিরে এলো ঘরে। সুলেখা ঘুমোচ্ছে। কী নিষ্পাপ দেখাচ্ছে মেয়েটার ঘুম ঘুম মুখ। আহা, এই মেয়েটাকে ওরা নষ্ট করবে। এরপর মেরে ফেলবে। নদীতে ভাসিয়ে দেবে লাশ। মানুষের জীবন কি এতই তুচ্ছ?
মাওলানা ডাক দিল, সুলেখা? সুলেখা ওঠো, আমাদের পালাতে হবে।
ধড়মড় করে উঠে বসল সুখেলা, কী হইছে? আগুন? ওরা আইসা গেছে? চলেন পালাই।
হ সুলেখা, চলো আমরা এখান থিকা পালায়া যাই। নাইলে ওরা আমাদের মাইরা ফেলবে।
সুলেখা উঠে এসে মাওলনার হাত ধরল। এরপর নদীর পাড়ের গাছপালার অন্ধকারে মিশে গেল দুটি ছায়াশরীর।

রচনাকাল: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮