আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘বিস্ময় থেকেই জ্ঞানের সূচনা’

প্রকাশিত : মার্চ ২৫, ২০২৪

মানুষ যা জানে না সেই অজানাকে জানার আগ্রহই জ্ঞানের উৎস। যার ভেতর জানার আগ্রহ আছে সে জগতের কোনো ঘটনাকেই সামান্য বলে অবজ্ঞা করে না। কারণ সে জানে, সকল কাজেরই কারণ আছে। সে জানে, খুবই তুচ্ছ ঘটনা থেকে যা সৃষ্টি হচ্ছে সেই ঘটনার সাথে মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনারই সুশৃঙ্খল একটি সম্পর্ক রয়েছে। আপেল গাছের নিচে আপনমনে বসে আছেন আইজ্যাক নিউটন। হঠাৎ একটা আপেল টুপ করে পড়ল তার সামনে। আপেলটার দিকে চোখ পড়তেই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর একটা চিন্তা ঢুকে গেল, আপেলটা নিচের দিকে পড়ল কেন? ওপরেও তো উঠে যেতে পারতো! ওপর থেকে কোনো জিনিসকে ফেললে সবসময় কেন সেটা মাটির দিকে নেমে আসে? নিশ্চয়ই পৃথিবী সকল পদার্থকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলেন তরুণ নিউটন। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করলেন, পৃথিবী আসলেই সকল পদার্থকে নিজের দিকে প্রতিমুহূর্তে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি পদার্থের মধ্যে হয়ে থাকে। আরসব মানুষের মতো নিউটন ভাবেননি, আপেল তো নিচের দিকেই পড়ে। এটা আর নতুন কী! যদি ভাবতেন তাহলে তিনি মহাকর্ষ বল আবিষ্কার করতে পারতেন।

দেখা যাচ্ছে, বিস্ময়কর এই আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে কৌতূহল। এখানেই সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ মানুষের পার্থক্য। সাধারণ মানুষ দ্যাখে, প্রতিদিন সূর্য ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যার ভেতর কৌতূহল আছে সে প্রতিদিন সূর্য ওঠার কারণ জানতে চায়। কেননা সে জানে, কারণ ছাড়া জগতে কোনো ঘটনাই ঘটে না। আরেক মহাবিজ্ঞানীর নাম এখানে আনা যেতে পারে। পিসা শহরের একটি গির্জায় উপাসনা করতে গেছেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। ১৭ বছর বয়সের টগবগে তরুণ। উদাত্ত স্বরে ফাদার কথা বলে যাচ্ছেন। আর সবার মতো গ্যালিলিও বসে শুনছেন তার কথা। শুনতে শুনতে একসময়ে তার দৃষ্টি পড়লো গির্জার ছাদ থেকে লম্বা শেকলে ঝোলানো ব্রোঞ্জের তৈরি লণ্ঠনের দিকে। লণ্ঠনটি হাওয়ায় ধীরে-ধীরে দুলছে। একবার বামদিকে, আরেকবার ডানদিকে। বেশ কিছু সময় তিনি চেয়ে রইলেন লণ্ঠনটির দিকে। কেন যেন তার মনে হলো, বামদিক থেকে ডানদিকে যেতে এবং ডানদিক থেকে বামদিকে যেতে লণ্ঠনটি একই সময় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হলেই তো হবে না, প্রমাণ দরকার। বাড়ি ফিরে গ্যালিলিও ভারি একটা জিনিসকে হালকা সুতো দিয়ে বেঁধে ঘরের আংটার সাথে ঝুলিয়ে দিলেন। এরপর হাত দিয়ে ভারি জিনিসটা দুলিয়ে দিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন।

ভারি জিনিসটির দোলনে কতটুকু সময় লাগছে সেই সময় পরিমাপ করতে তিনি নিজের নাড়ির স্পন্দন গণনা করতে লাগলেন। গ্যালিলিও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, প্রতিবার দোলনের জন্য সমান সংখ্যক নাড়ির স্পন্দন লাগছে। মানে, প্রতিটি দোলনের সময় সমান। এই ঘটনার পর তিনি সরল দোলকের সূত্রাবলি উল্লেখ করেন এবং দোলকের সাহায্যে সময় পরিমাপের ব্যবস্থা করেন। গ্যালিলিও লিখেছেন, “কতবারই তো গির্জায় গেছি। হাজার হাজার বার ঝোলানো লণ্ঠন বাতির দিকে চোখ পড়েছে। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি, ওই লণ্ঠনের প্রতিটা দোলন একই সময়ে শেষ হয়।” গ্যালিলিওয়ের এই কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, হাজার হাজার বার তিনি গির্জার ওই ঝোলানো লণ্ঠন দেখেছেন। কিন্তু তার সেসব দেখা ছিল হাজার হাজার মানুষের মতো। কিন্তু হঠাৎই এক সন্ধেয় তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন লণ্ঠনের দোলনকাল সম্পর্কে। এই কৌতূহল থেকেই তিনি আবিষ্কার করলেন দোলক। যা সময় পরিমাপের বিস্ময়কর আবিষ্কার।

আর্কিমিডিস বাথটাবে গোসল করতে গিয়ে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার পর অনুভব করলেন, জলের ভেতর তার শরীরটা যেন বেশ হালকা হয়ে গেছে। আর কেউ হলে ভাবতো, এটাই স্বাভাবিক। এমন তো গোসলের সময় হয়ই। আর্কিমিডিস কিন্তু বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন না। তিনি নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, জলের ভেতর কেন তার দেহটা হালকা হয়ে গেল? কৌতূহল থেকেই তিনি আবিষ্কার করলেন, কোনো বস্তুকে তরল পদার্থে ডোবালে ওই বস্তুর সমান পরিমাণ তরল অপসারিত হয়। যে পরিমাণ জল অপসারিত হয় সেই পরিমাণ ওই বস্তুর ওজনের সমান।

বছর সাতেক বয়সি একটি শিশু খাটের ওপর বসে বল হাতে খেলছিল। বলটি হঠাৎ হাত থেকে পড়ে মেঝের ওপর গড়িয়ে গেল। এই দেখে পাশেই বসে থাকা মাকে সে জিগেশ করলো, আম্মু, বলটার তো জীবন নেই। তাহলে গড়িয়ে গেল কিভাবে? তুমিই তো পড়িয়েছো, যার জীবন আছে সেই শুধু চলাফেরা করতে পারে। যারা চলাফেরা করতে পারে না তারা জড়। শিশুটির এই কৌতূহল আসলে বিজ্ঞানীর কৌতূহল। কিন্তু শিশুটি বিজ্ঞানী নয়। কারণ, বলটি জড় হয়েও কেন গড়িয়ে গেল সেই বিষয়ে শিশুটি মাথা খাটায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীর কৌতূহলী মন বারবার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। যতক্ষণ না যৌক্তিক ও পরীক্ষা করে পাওয়া কোনো সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছতে পারেন। এখানেই শিশুটির কৌতূহল আর বিজ্ঞানীর কৌতূহলের পার্থক্য।

মানুষ যখন শৈশব পেরিয়ে আসে, সে তখন আসলে তার কৌতূহল হারিয়ে ফেলে। এরপর সামাজিক মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা, তাদের মতো করে জগৎ ও জীবনকে দেখার চোখ ও মন তৈরি হয়ে যায়। এভাবেই মানুষ জীবনের ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ওঠে। এরপর বুড়িয়ে যায়। মরে যায়। এসব মানুষের সাথে জগতের আরসব প্রাণীর কোনোই তফাৎ নেই। কিন্তু মানুষ ও আরসব প্রাণীর ভেতর পার্থক্য থাকা দরকার। না-হলে সৃষ্টিকর্তার জগৎসৃষ্টির উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে উঠবে না। সহজ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জগতের একমাত্র প্রাণী মানুষ যারা লজ্জাস্থান ঢাকতে পোশাক পরে। আর কোনো প্রাণী কি পরে? প্রজ্ঞার অনন্য গুণে মানুষ গুণান্বিত। আর কোনো প্রাণীর ভেতর এই প্রজ্ঞা নেই। আর তাই, প্রকৃতির রহস্য জানতে চাওয়ার আগ্রহ মানুষের সহজাত। প্রকৃতির রহস্য নিয়ে আর কোনো প্রাণীর কৌতূহল নেই। তাদের কাছে, চারপাশের যা-কিছু যেমন আছে তেমনটাই স্বাভাবিক। ঠিক একইভাবে বেশিরভাগ মানুষের কাছে প্রকৃতির নিয়মগুলো স্বাভাবিক। অথচ কেন এসব নিয়ম, তা নিয়ে কোনোই কৌতূহল সাধারণ মানুষের ভেতর ক্রিয়া করে না। যাদের ভেতর কৌতূহল নেই তাদের ছাগল-ভেড়া হয়ে জন্ম নেয়াও যে কথা, মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াও একই কথা।

মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের ভেতর থেকে প্রকাশ ঘটে না। যাদের ঘটে তারাই প্রকৃত অর্থে মানুষ। প্রকৃতিরাজ্যের আরসব প্রাণী থেকে মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কৌতূহল। যা সে জানে না সেই অজানাকে জানার তীব্র আকাক্সক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষাই জ্ঞানের প্রথম সিঁড়ি। যে মানুষের ভেতর যত বেশি জানার আগ্রহ সেই মানুষ তত বেশি মনুষ্যবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। বিশ্বজগতের কত কত রহস্য, তার কতটুকুই আর আমরা জানি! অজানাকে জানার আগ্রহ মানুষের আদি প্রবৃত্তি। যা সে জানে না, তা  সে জানতে চায়। এ জানায় আছে আনন্দ। গভীর আনন্দ। এই আনন্দ কিন্তু পশুপাখির নেই। কারণ চারপাশের পরিবেশ ও পৃথিবী বিষয়ে তাদের জানার কোনো আগ্রহ নেই। তাই, জানার আনন্দও নেই। অজানাকে জানার চেষ্টা যে মানুষ করে, সে-ই আসল মানুষ। জ্ঞানী মানুষ। গরু-ছাগলের মতো খাওয়া আর ঘুমানো মানুষের স্বভাব নয়। অথচ মজা দ্যাখো, আমাদের চারপাশের মানুষজন কেউই অজানাকে জানার চেষ্টা করছে না। টাকা আয়ের জন্য দিনভর কঠোর পরিশ্রম করছে, আর রাত হলে ভুসভুস করে ঘুমোচ্ছে। তারা মনে করে, তার আবাসভূমি এই পৃথিবী সে যেরকম দেখছে, সেই রকমই। এর আলাদা আর কোনো রকম নেই। এই চিন্তাভাবনা নিয়েই জীবনযাপন করছে বেশিরভাগ সামাজিক মানুষ।

এই পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, আলো-হাওয়া, আকাশের নিচে শূন্যের ওপর উড়ে যাওয়া পাখি, কোনোকিছুই সামাজিক মানুষের ভেতর বিস্ময় তৈরি করে না। যেখানে বিস্ময় নেই, সেখানে জ্ঞান নেই। বিস্ময় থেকেই আসলে জ্ঞানের সূচনা। সভ্যতার ইতিহাসে কিছু কিছু মানুষের খোঁজ আমরা পাব যাদের ভেতর বিস্ময় ছিল, অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। হবেনই বা কেন! খেয়ে, পরে আর ঘুমিয়ে দেয়ার জন্যই তো মানুষ পৃথিবীতে আসেনি। পৃথিবীর আরসব জীব থেকে এখানেই মানুষের পার্থক্য। হযরত মুহম্মদের (স.) ওপর আল্লাহ জিবরাঈল ফেরেস্তার মাধ্যমে প্রথম যে অহি নাজিল করেন তা হচ্ছে, পড়ো। এখানে পড়া মানে জ্ঞান অর্জন করা। মানুষ যা জানে না, তা জানার চেষ্টা করা।

নিঃসীম ওই মহাশূন্যে কত কত যে গ্রহ, গ্যালাক্সি আর প্রাণের লীলা চলছে... সৃষ্টির সে এক মহাযজ্ঞ। মহাশূন্যের স্পেস এখনও সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু নির্ধারিত একটি দিবসে মহাশূন্যের সবকিছুই বিপরীত দিকে গতি নিয়ে একটি কেন্দ্রের দিকে ছুটে যাবে। অনন্ত এই মহাবিশ্বের কোনও এক স্পেসে নিজের অবস্থান কল্পনা করে চেয়ে দ্যাখো পৃথিবীকে। পৃথিবীর বুকে মানুষকে বিন্দুবৎ মনে হবে। কিম্বা কীটস্য কীট। যারা প্রাকৃতিক রীতির বিপরীত স্রোতে চলছে। মোহাবিষ্ট। স্বার্থান্ধ। জগৎজুড়ে ছড়ানো প্রকৃতির মহাগ্রন্থের প্রতি তারা উদাসীন। মানুষজাতিকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. উদাসীন কিম্বা মূর্খ। দুই. জ্ঞানী। তিন. বিনয়ী ও ধ্যানী। যে উদাসীন, সে তো উদাসীনই। আর যে জ্ঞানী, তার অবস্থা এমন যে, তার পাত্রে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। পানিভর্তি একটি গেলাশে কেউ পানি রাখতে পারে না। রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি ও ধর্মনীতিসহ মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এসব জ্ঞানীরা। বৃহত্তর মানুষ যেহেতু মূর্খ, ফলে জ্ঞানীদের জ্ঞান ফলাতেও বেশ সুবিধে হয়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ জগৎ-সংসারে অভাগার মতো পড়ে থাকে, যারা আবিষ্কার করতে থাকে, অনন্ত এই মহাসৃষ্টিতে কত ক্ষুদ্র আমি! নিজেকে বিন্দুবৎ জেনেই তার ভেতর জেগে ওঠে মহাবিশ্ব ও নিজেকে জানার তৃষ্ণা। তৃষ্ণা মেটাতে যতই সে নিজেকে জানতে পারে, তার ভেতর নিজের ক্ষুদ্রত্ব আরও বেশি করে প্রকাশ পায়। ফলে মানুষটি হয়ে যান বিনয়ী ও ধ্যানী।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক