আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর প্রবন্ধ ‘জীবনানন্দ ট্রমা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২

জীবনানন্দের পর বাংলা কবিতা কোথায় গেল, কোন দিকে আগাইতেছে? প্রশ্ন করি। একটা নিবিড় পাঠ অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, জীবনানন্দের পরের কবিতা কমবেশি তার এই ট্রমা দ্বারাই আক্রান্ত। তার এলিমেন্টসই বেশি। তবে একটু পার্থক্য আছে। জীবনানন্দেরটা খাঁটি, শরীরের ভেতর রক্ত চলাচলের মতো, পরবর্তীদের কবিতায় ট্রমাগুলি কিছুটা নকল, কিছুটা ঐতিহ্যের অভ্যাস।

পরবর্তী দশকেই অবশ্য আর একজন কবি বাংলা কবিতায় নিয়া আসেন স্বপ্ন, আশ্বাস, আত্মবিশ্বাসের বাণীবদ্ধ কবিতাবলি। চল্লিশের আধুনিক ও শক্তিশালী কবি ফররুখ আহমদের কবিতার মধ্যে বিশ্বাসী ধারার যেই উত্থান দেখা যায় তা আধুনিকতার বেরামের বিরুদ্ধে অনেকটা উপশমের কাজ করছে। তার নিজস্ব পোয়েটিক ডিকশন, রূপক, উপমা ইন্টারটেক্সচ্যুয়ালিটি এবং তার কবিতার বিষয় আশয় এত বেশি ইসলামিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর যে, তা বাংলা কবিতার একটা আলাদা, প্রাণময়, গৌরবের কবিতা-ভূবন সৃষ্টি করছিল।

কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির ব্যাপক পরিবর্তন, গ্লোভালাইজেশন এবং মুনাফালোভি, আদর্শহীন কর্পোরেট ব্যবসায়িক সংস্কৃতির কারণে তলে তলে মানুষের কনশাসনেস, মানুষের শিল্প-রুচিবোধ যেভাবে বদল হইতেছিল, যেভাবে কবিতার ‘শুদ্ধ ফর্ম’ ভেঙ্গে উত্তর আধুনিক ভাষায়-ফার্গমেন্টেড, বহুস্তরভিত্তিক চেতনাবোধের কাব্যকলা-কৌশলের চর্চা হইতেছিল— সেই বদলের ধারায় ফররুখের কোনো উত্তরসূরি আর পাওয়া গেল না। এইটাই হয়ত স্বাভাবিক ছিল। তাছাড়া কবি এবং পাঠকের কাছে অন্ধকার এবং আত্মহত্যার মায়া-ভূবনটিই বেশি আকর্ষণীয় এবং নন্দনীয় হয়ে থাকলো।

তাহলে উপায় কী? এই জীবনানন্দ ট্রমা-কেন্দ্রিক কবিতা-বলয় থেইকা কবিতার স্বরূপে, কবিতার অন্তর্নিহিত ভাষাবোধে, কবিতার নিরাময়ী, শুশ্রুষাময় মালভূমিতে আমাদের পদচারণা কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশের কবিতা কোন দিকে আগাইব? তার উত্তরে বলা যায়, বাংলদেশের কবিতাকে তার নিজের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় পরিচয়, তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মগৌরবের কাছে ফিরে আসতে হবে। তার যৌথ সাংস্কৃতিক ফলন এবং অর্জনের কাছে ফিরে আসতে হবে। তথাকথিত এনলাইটেন্টমেন্টের হাত ধরে ‘খোদাহীন’ আধুনিকতার গহ্বরে বিশ্বাসের যে গ্রামটি হারাইয়া গেছিল, তার খোঁজ করতে হবে। মানে মানুষ হিসেবে আমাদের যে যৌথ জীবন, বিশ্বাস, যে জ্ঞান ও প্রতীতি, যে আচার নিষ্ঠা আমরা দৈনন্দিন ভাব ও ভাষায় পালন করতেছি, তার দিকে ফিরে আসতে হবে।

কবিতা আমার জীবন বা কবিতা ছাড়া আমি বাঁচবো না— এই জাতীয়, দায় দায়িত্বহীন, শেখা বুলি বাদ দিয়া ভাবতে হবে তার হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক অঙ্গীকারটা, ধরতে হবে তার উদ্দেশ্যটা। জানতে হবে, সে কীভাবে তার দেশ, কাল, মানুষ, মানুষের জঙ্গম কালচারের সাথে নিজেকে রিলেট করে। কবিদের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব দরকার, কিন্তু তাই বইলা একাকিত্ব যেন তার সাইকিকে, তার কনশাসনেসকে গ্রাস না করে। এটি কী করে সম্ভব? এটি সম্ভব যখন কবি ও পাঠকেরা নিজেদেরকে এই মহাপৃথিবীর বিস্ময়কর পরিকল্পনা, তার উদ্দেশ্যপূর্ণ সঞ্চালন, এবং এই সঞ্চালনটির নিউক্লিয়াসে থাকা ‘পরম’কে চিনতে পারবে, সেখান থেইকা একদিন হয়ত নতুন ভাষার সৃষ্টি হবে।

হেগেল এরকম একটা চিন্তা ধারণ করছিলেন। মানুষের ঐতিহাসিক সঞ্চালন, তার কনশাসনেস এর উত্থান, যা পরম আদর্শকে অনুসরণ করে একটা বৃহত্তর মিলন ধারার সাথে মিশে যাওয়ার জন্য তৈরি হইতেছিল। হেগেল আরও বলছেন, অসুখী চেতনা হইল, বিশ্ব ও ধর্মীয় চেতনার অস্বীকারের ফল। অন্যরা যেমন ধর্মকে প্রায়শই ব্যর্থ জীবনের আশ্রয় হিসাবে দেখে, তেমন করে দেখলে হবে না। একটি অতীন্দ্রিয় সত্তার ওপর পুরা মনোনিবেশ করার মাধ্যমে জীবনে সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায়। দুনিয়াতে মানুষ এবং বস্তুর স্বরূপের চেতনায় প্রবেশের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হইল এই একক, স্বার্থপর ব্যক্তিকতা থেইকা দায়িত্বশীল, ইতিহাস এবং সমাজমনষ্ক ব্যক্তিকতার ভেতর দিয়া যাওয়া। আর এইভাবে চেতনা বিকাশের পরবর্তী ধাপ হলো ধর্ম।

ধর্ম মূলত নিজের সম্বন্ধে সচেতন একটি সমষ্টিগত চেতনা। এবং তাই এইটা নৈতিক জীবন এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে ভারসাম্যকে ধইরা রাখে। হেগেল ধর্মের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করেছেন, যার প্রতিফলন হইলঃ শিল্প, মিথ এবং নাটক। যেদিন আধুনিক মানুষ এই পরম-চেতনাবোধ থেইকা সরে আসছে এবং কেবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের নাম করে, নিজের ‘পরম’ সত্তাকে ভুলে- তথাকথিত এনলাইটেন্টমেন্টের নির্যাসে, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, তার ক্রিয়েটিভ নেতি এবং নাস্তিবোধের দিকে মন ও মেধাকে কেন্দ্রীভূত করছে সেদিন থেইকাই তার স্বরূপ, তার ঐতিহাসিক চেতনার রুগ্ন, মূমুর্ষ অবস্থার সৃষ্টি হইছে। জীবনানন্দও এই ফাঁদে পা রাখছিলেন এবং আধুনিক বাংলা কবিতার লিগ্যাসিতে ক্রনিক, রুগ্ন চেতনাবোধের উপহার দিয়া গেছেন।

লেখক: কবি