আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর প্রবন্ধ ‘বাংলা ভাষার স্বাভাবিকতা’

প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২৩

বাঙালি মুসলমান কবি সাহিত্যিকেরা আল্লাহ লেখেন না, লেখেন ঈশ্বর, দোয়া লেখেন না, লেখেন প্রার্থনা। তেমনিভাবে নামাজ লেখেন না লেখেন উপাসনা। কুরআন, হাদিস লেখেন না, লেখেন বেদ, পুরান উপনিষদ। আল্লাহ, নবী, রাসূল, মোহাম্মদ এরকম ইসলামি, মুসলমানি নাম এবং শব্দ বলা এবং লেখাতে তাদের ভীষণ আপত্তি। বরং হিন্দু দেব দেবী বা গ্রেকো-রোমান পুরাণের দেব দেবীদের কথা বলতে তাদের কোনো সমস্যা নাই। দুই একদিন আগে নব্বইয়ের দশকের এক কবি আর এক কবির স্মরণে লিখছে যে, কবি প্রকৃতি থেকে আসছে আবার প্রকৃতির কাছে চইলা গেছে। মানে প্যাগান বিশ্বাস, মানুষের যেন কোনো সৃষ্টিকর্তা নাই!

 

ভাবতে অবাক লাগে ‘ভারতীয়তা’ বা ভারতীয় হিন্দু সভ্যতা কেন্দ্রীক, চালু অলিখিত বাংলা সাহিত্য নর্ম এবং কলকাতার কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক হেজেমনির মাধ্যমে তৈরি করা বাংলা ভাষা ব্যবহার কোড এবং এথিকস, কিভাবে বাংলাদেশের মুসলমান কবি সাহিত্যিকেদের মাথা শেইপড এবং ব্লক করে দিছে! তারা তাদের বাপ দাদাদের কৃষিজীবন ভিত্তিক - মুসলমানী সভ্যতা এবং সংস্কৃতি অস্বীকার করে। শুধু অস্বীকার করছেই না, মুসলমানি এলিমেন্টস যারা ব্যবহার করে তাদেরকেও থামিয়ে দিতেছে। সত্য কথা বলতে কি- এইটা শত শত বছরের ভারতীয় হিন্দু, পৌত্তলিক সভ্যতার প্রকল্পের অংশ- যেমন পশ্চিমে লিবারেলিজম ইসলাম বিরোধী একটা প্রকল্প।

 

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু রাঢ়ি -গৌড়ীয় সভ্যতা সংস্কৃতি কেন্দ্রিক সাহিত্য আগ্রাসনের কারণে মুসলমান কবি লেখক সাহিত্যিকেরা নিজেদের পরিচয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি এই পূর্ববাংলার(বঙ্গ, সমতট) ভূমি সন্তান- কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, মুজুরের মুখের ভাষা যা তাদের ধর্মবাহিত হইয়া বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হইছে, সেই ভাষা তারা ব্যবহার করতে চান না। তারা লজ্জা পান, কেউ বা বিষয়টিকে ঘৃণা করেন! এখন বাংলায় উনিশ/বিশ শতকের হিন্দু জমিদারদের শাসন ত্রাসন নাই, আছে কলকাতা এবং ভারতীয় মাথার বাংলাদেশের সেক্যুলার লেখক শিল্পিদের ভাষাশাসন, ভাষার চোখ রাঙানি।

 

১৭৫৭ সনে ইংরেজদের কাছে মুসলমানদের পতনে ব্রিটিশ শাসনের যে উত্থান হইছিল, তার ফলে প্রায় ১০০ বছর মুসলমান কবি সাহিত্যিকেরা হতাশ, নিরাশ হইয়া তেমন কিছু লেখেন নাই। ঠিক এই শূন্য স্থানটি পূরণ করেন সুযোগসন্ধানী হিন্দু উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সমাজ। যার ফলেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরগুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রামমোহন রায়, মাইকেল এবং রবীন্দ্রনাথের মত লেখকের। এরা দুই হাত ভরে ইংরেজদের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন এবং বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার সাথে সাথে বাংলা ভাষা যেন বাঙালি হিন্দুর একমাত্র সম্পত্তি- এই একটা ন্যারেটিভিটি তৈরি করতে সক্ষম হোন। তাই বাংলা ভাষায় আঠার শতক পর্যন্ত যে ফার্সি, আরবি এবং তুর্কি শব্দের যে স্বাভাবিক ব্যবহার ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়।

 

বিশেষত ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, ইংরেজ পাদ্রীদের সাথে যোগ দিলেন মত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি, রামরাম বসু এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তারা ইংরেজদের সহায়তায় বাংলা ভাষা থেকে বেছে বেছে আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ বাদ দিয়া বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতবহুল করলেন। অথচ ইংরেজ আসার আগে মুসলমান শাসন যুগে, বিশেষত স্বাধীন সুলতানি যুগে বাংলা ভাষার যে সেবা, শুশ্রূষা এবং চর্চা হয় তা এক কথায় অভূতপূর্ব। সেই সময়েই মহাভারত এবং রামায়ন বাংলায় অনুদিত হয়। অথচ হিন্দু সেনরাজাদের আমলে, যারা বাংলা ভাষার চর্চা করত তাদেরকে পাপিষ্ঠ বলে ‘রৌরব’ নামক নরকে স্থান দিতে হবে বলে সেন আমলের সংস্কৃত পণ্ডিতেরা রায় দেন।

 

বাংলায় মুসলমানদের আগমন এবং শাসন প্রতিষ্ঠা না হইলে আমরা হয়ত এখন সংস্কৃত ভাষাতেই লেখালেখি করতাম। বৌদ্ধরা হিন্দু সেনরাজাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নেপাল, আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করে। এইভাবে তারা চর্চাপদকেও নেপালে সাথে নিয়া যান। চর্চাপদের বাংলা তখন পুরাপুরি বাংলা না, তা ছিল সৃজ্যমান বাংলা। মুসলমান শাসক এবং সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার যে বিকাশ ঘটছিল তার প্রমাণ মেলে চণ্ডীদাসের (১৩৭০-১৪৩০) ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে। এই কাব্যে ফার্সি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। তা ছাড়া যুগসন্ধিক্ষণের কবি ভারতচন্দ্র তার `অন্নদামঙ্গল` কাব্যেও সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা শব্দের পাশাপাশি আরবি, ফার্সি শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেন। ‘না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল। অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।’ এই বিখ্যাত লাইন থেকে তা বোঝা যায়।

 

সুতরাং দেখা যায় যে, বাংলা কবিতায় আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ, এবং মুসলমানি বিষয়, ভাব, সঙ্গ, অনুষঙ্গ ব্যবহারের স্বাভাবিক ধারাটি বাদ দেয়ার পেছনে ঊনিশ শতকের ইংরেজ এবং দেশীয় হিন্দু এলিট লেখক সাহিত্যিকদের একটা যৌথ পলিটিকাল এবং রেসিস্ট ষড়যন্ত্র ছিল। ভারত স্বাধীনতা লাভের আগে ও পরে হিন্দু শক্তিশালি লেখকদের মাধ্যমে যে বাংলা সাহিত্য রচিত হইল তা মূলত তাদের নিজেদের হিন্দু সভ্যতা কেন্দ্রিক তথা ভারতীয় সভ্যতা ভিত্তিক। আবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দু ভাব-দর্শন এবং মুসলিম বিদ্বেষজাত- এই বলয়টিতে সাথে যোগ হইল ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ’। যার মূল ফেনেমনন হইল বাঙ্গালি হিন্দুরাই আসল বাঙ্গালি। ফলে বাংলা ভাষায় আরবি, ফার্সি বা তুর্কি শব্দের স্বাভাবিক এসিমিলেশন তথা ইসলামিক ইতিহাস ঐতিহ্যজাত বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য চর্চার পথ রুদ্ধ হইল এবং তা ১৯৪৭ সনের দেশ ভাগের পর পূর্ব বাংলা এবং এখনকার বাংলাদেশে অব্যাহত থাকলো।

 

বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে স্বাধীন হইল কিন্তু বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকেরা সেই ‘ভারতীয়তা’ বা ভারতীয় হিন্দু সভ্যতার হার্ড ডিস্ক তাদের মেধা, মনন, ভাব এবং প্রকাশে ধরে রাখল। তাই এই সভ্যতাভিত্তিক- ঈশ্বর, প্রার্থনা, উপাসনা, পুজা, সীতা, রাম, লক্ষণ, বিষ্ণু কালি ইত্যাদি শব্দ এবং বিষয়, সঙ্গ,অনুষঙ্গ ব্যবহারে কোনো দ্বিধা থাকে না। অন্যদিকে কোনো মুসলমান কবি সাহিত্যিক মুসলমানি বিষয় এবং আরবি, ফার্সি শব্দ যেমন- নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, আল্লাহ, খোদা, নবী, দোয়া, ওমর, উসমান, খলিফা ইত্যাদি ব্যবহার করলে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তারা ভুলে যায় যে বাংলা ভাষা আসলে মুসলমান সুলতানদের ভালোবাসা এবং যত্নের কারণেই ভাষা হিসাবে টিকে যায় এবং আমরা আজ বাংলায় কথা বলি। তাই বলা যায় বাংলা ভাষার মূল প্রপাইটার মুসলমানেরাই।

 

এখন দেখবেন কবিতায়, বিশেষত বাংলাদেশের কবিতায় কোনো নতুনত্ব নাই, প্রাণ নাই। এর অন্যতম কারণ কবি সাহিত্যিকেরা সেই ‘ভারতীয়তায়’ বেশী রকম আটকা পড়ে গেছে। ঘুরে ফিরে সেই উপনিষদ, বেদ, হিন্দু পুরান, রামায়ণ, মহাভারত, চর্চাপদ, শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন কেন্দ্রীক একটা কাব্যব্যবস্থা, একটা পোয়েটিক-নর্ম কবিদেরকে ঘেরাও করে রাখছে। তাই কখনো কখনো মনে হয় বাংলাদেশের কিছু কবি সাহিত্যিক যেন সত্তর, আশির দশকের পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কার্বণ কপি। অথচ এইটা হবার কথা ছিলো না। একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে, নিজস্ব ধর্ম ,নিজস্ব কালচার ভিত্তিক যে যৌথ জীবন, যে ভাষা-ব্যবস্থা গইড়া উঠছে সেইটাকে কেন্দ্র কইরা নতুন কবিতা, নতুন কাব্যভাষা তৈরি করা যাইত। তবে কেউ না কেউ আগাইয়া আসবে এই আশায় আছি। ইতোমধ্যে কারো কারো কবিতায় বাংলাদেশের প্রাণটা আবছা খুঁজে পাইতেছি।

 

আশার কথা হইল- এখন যুগ পাল্টাইছে। বিশ্বব্যাপী, লিবারেল সেকুলার ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার বিপরীতে বিশ্বাসীধারার যে যুগটি চালু হইছে তার হাত ধরেই পৃথিবীতে একটা সুস্থ, ব্যালেন্সড সভ্যতা এবং সাহিত্যিক ধারার উত্থান লক্ষ্য করা যাইতেছে। আর এইটার প্রকাশ ঘটতেছে বিপুল সোস্যাল মিডিয়ার কখনো গণতান্ত্রিক কখনো নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে। এখন আর সেই ব্রাক্ষণ সাহিত্য সম্পাদক নাই যে কোনো আরবি ফার্সি শব্দ দেখলেই সে লেখাটাকে বাদ দিয়া বা চাপা দিয়া বাংলা ভাষার স্বাভাবিকতাকে থামাইয়া দিবে। তাই বর্তমান সময়ের কবি সাহিত্যকদের কাজ হবে বাংলা ভাষার স্বাভাবিকতার ধারাটিকে বজায় রাখা অর্থাৎ যে সব আরবি, ফার্সি শব্দ দেশের আপামর জনসাধারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে, কথাবার্তা, যোগাযোগ এবং কাজ কারবারে ব্যবহার করে এবং যে সব শব্দ আমাদের হয়ে গেছে অর্থাৎ বাংলা ভাষায় রপান্তরিত হয়ে গেছে, সেইগুলিকে কবিতা, গল্প উপন্যাস তথা শিল্প সাহিত্যে ব্যবহার করা। সাথে সাথে মুসলিম সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মুসলিম সংস্কৃতি ভিত্তিক বিষয় আশয়, সঙ্গ, অনুষঙ্গ লেখালেখিতে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা।

 

লেখক: কবি